বাড়ি ফেরা

দু’দিনের ছুটি, হাতে গোনা ক’টি টাকা
যেতে হবে বাড়ি বিকেলের ট্রেন ধরে
হাতে চিঠি ধরা বুকের ভেতর ফাঁকা
মা যে লিখেছেন কাঁপা কাঁপা অক্ষরে
বাবা তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে!

রেলের বগিতে ভিড় বেশি এবেলায়
কাজ সেরে সব ধরেছে ফিরতি গাড়ি
বসে ঝুলে আর লেগে থেকে গায়ে গায়
চলার ছন্দে ঘামের গন্ধ মিশে
কু ঝিক ঝিক হারিয়ে ফেলেছে দিশে।

চিলাহাটি নেমে ছয় কিলো যাবো হেঁটে
যেতে যেতে হবে নিজমনে কতো কথা
ছেঁড়া স্বপ্নেরা মগজের কোষ ঘেঁটে
বেদনা জাগাবে মৌনতা ভালোবেসে
সন্ধ্যের ছায়া কাঁদাবে আমাকে এসে

ধান কাটা ক্ষেতে যেতে হবে আড়াআড়ি
কুয়াশায় ভিজে সান্ত্বনা পাবে বুক
হাঁটুরের দল সওদা মাথায় করে
আমায় পেরিয়ে চলে যাবে তাড়াতাড়ি
জোনাকি জ্বলবে ভাঙ্গা সাঁকো র’বে পড়ে।

শূন্য উঠোনে ঝিঁ ঝিঁ ডাকে একমনে
কুয়োতলা থেকে জলের শব্দ আসে
ক্লান্তির ছাপ মুছে ফেলি প্রাণপণে
শৈশব এসে দাঁড়ায় আমার পাশে
বাতাসের গায়ে মায়ের গন্ধ ভাসে…

২,১৮৩ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “বাড়ি ফেরা”

    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      দেশ ছাড়তে কষ্ট তো একটু হবেই। কিন্তু দেখ, সেই জননীর নাড়ি ছেঁড়া থেকে শুরু করে বিচ্ছেদের অভিজ্ঞতা আমাদের কম কিন্তু নয়। সেগুলোকে পাশাপাশি সাজালে এক অমোঘ অভিজ্ঞানের সন্ধান পাই আমরা। অনুভব করি, মহাজাগতিক প্রসারণে অনন্ত চরাচরের দূরত্ব কেবল বেড়েই চলেছে, যেমন দূরত্ব বাড়ছে একটি মানুষের সাথে অন্যটির।


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
  1. সাইদুল (৭৬-৮২)

    অসাধারণ।
    এতদিন রেলের কবিতা বললেই মনে আসতো রাত নিঝঝুম, গাড়ি ভরা ঘুম, অথবা ফ্রম এ রেলওয়ে ক্যারেজ, আজ থেকে সম্ভবত এই লাইন গুলিও মনে পড়বেঃ
    চিলাহাটি নেমে ছয় কিলো যাবো হেঁটে
    যেতে যেতে হবে নিজমনে কতো কথা
    ছেঁড়া স্বপ্নেরা মগজের কোষ ঘেঁটে
    বেদনা জাগাবে মৌনতা ভালোবেসে
    সন্ধ্যের ছায়া কাঁদাবে আমাকে এসে


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  2. সাদাত (৯১-৯৭)

    মা বেঁচে নেই, তাই মাকে নিয়ে লেখা যে কোন কবিতাই আমার বুকে বেদনার বাদ্যই বাজায়। আমার সত্যিকারের ফেরার কোন জায়গা নেই......... কবিতা খুব ভালো হয়েছে ভাই.........

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      সাদাত, তোমায় এ কবিতাটি লেখার প্রেক্ষাপট বলি। আমার দাদাবাড়ি চিলাহাটি থেকে ৬ কিলো দূরে নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার নয়ানী বাগডোকরা গ্রামে। বাবার চাকুরীসূত্রে আমরা রংপুরে থাকতাম। সেখান থেকে সড়কপথে দেড় ঘন্টায় সৈয়দপুর, তারপর সৈয়দপুর থেকে ট্রেন ধরে চিলাহাটি যেতে হতো। রেল ভ্রমণের সেই স্মৃতি আমার কিশোর বয়সের অমূল্য সম্পদ। যখন কবিতাটি লিখি, তখন আমার দাদী বার্ধক্যজনিত কারনে খুব অসুস্থ ছিলেন। বাবা ছিলেন তার সন্তানদের মাঝে সব বড়। তিনি মৃত্যুশয্যায় বাবাকে দেখতে চাইলেন। কবিতায় বর্ণিত যাত্রীটি আমার বাবা। তিনি সেবার তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন। (সম্পাদিত)


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    কবিতাটা পড়ে উদাস হয়ে গেলাম।
    মায়ের কাছে পৌঁছুবার চিরাচরিত অনুভূতি খেলে গেলো।
    বহুকাল মায়ের সঙ্গে দেখা নেই সামনাসামনি। স্কাইপে দেখা হয়।

    জবাব দিন
  4. মেহেদী হাসান জাহিদ

    “ক্যাডেট কলেজ” আমার স্বপ্ন ছিলো

    অনেক স্বপ্ন ছিলো আমার যে, ক্যাডেট কলেজে পড়ালেখা করবো। কিন্তু পরিস্থিতি আমার সব আশা সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। না পেরেছি কাউকে বলতে, না পেরেছি কাউকে কিছু জানাতে। শুধু নিজে নিজে সেই স্বপ্নের মায়াজাল বুনেছিলাম, আবার সেটা ছিঁড়েও ফেললাম। কিছুই করার ছিলো না আমার সেদিন, যেদিন আমার স্বপ্নগুলো ভেঙে গিয়েছিল। অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার কারণে। তবুও কিছু করার ছিলো না আমার, কিছু করতেও পারিনি আমি। স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমি যে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম, তা আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। ঠিক তখনি বুঝতে পারলাম যখন আমার বাবা মারা গেলেন। অনেক কিছুই ভেবেছিলাম সেদিন যে, আমার আর স্বপ্ন দেখে কাজ নেই। তাইতো স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সেদিন থেকে শুধু একটাই স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, কোনদিন একটা ভালো চাকুরী পাবো। আমার পরিবারটাকে ভালোভাবে পরিচালনা করবো। কিন্তু সেই স্বপ্নটাও ভেঙে যেতে যেতে আজ দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর পর একটা চাকুরী পেলাম। তবে এখনও স্বপ্ন দেখি, ক্যাডেটদের নিয়ে। ক্যাডেটদের জীবন নিয়ে। নিজেতো ক্যাডেট হতে পারলাম না, অন্যের ক্যাডেট হওয়া দেখে নিজে নিজে আফসোস করি। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের হয়তো বড় কোন স্বপ্ন দেখতে নেই! আর দেখলেও বোধহয় তা সত্যি হতে নেই! সবই আল্লাহ্’র ইচ্ছা। আল্লাহ্ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।

    জবাব দিন
  5. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    কবিতার কথা কিছু বলার আগে জিজ্ঞেস করে নেই, চিলাহাটী কি তোমার বাড়ী, মোস্তফা?
    কবিতা নিয়ে এখন প্রায় প্রতিদিনই বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করি কবিতার একাধিক ওয়েবসাইট। কিন্তু বহুদিন পর এমন একটা কবিতা পেলাম, যা পড়ে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল এবং কবিতার স্নিগ্ধতার রেশ মনে রয়ে গেলো। সব বড় কবিদের সব কবিতাই ভাল নয়, আবার সব তেমন বড় নয় এমন কবিদের সব কবিতাই তুচ্ছ নয়। এই কবিতাটা এ দেশের যে কোন বড় কবির ভালো কবিতার সমতূল্য।
    "মা যে লিখেছেন কাঁপা কাঁপা অক্ষরে
    বাবা তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে!" - মায়ের এ ডাক কে উপেক্ষা করতে পারে? ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মায়ের ডাকে সাড়া দিতে দামাদোর নদী সাঁতরে পার হয়েছিলেন।
    "চিলাহাটি নেমে ছয় কিলো যাবো হেঁটে
    যেতে যেতে হবে নিজমনে কতো কথা
    ছেঁড়া স্বপ্নেরা মগজের কোষ ঘেঁটে
    বেদনা জাগাবে মৌনতা ভালোবেসে
    সন্ধ্যের ছায়া কাঁদাবে আমাকে এসে" - এই স্তবকটা এ কবিতার প্রাণ। প্রতিটা পংক্তি পড়েছি, আর অনুরূপ কিছু নিজস্ব চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছি।
    "হাঁটুরের দল সওদা মাথায় করে
    আমায় পেরিয়ে চলে যাবে তাড়াতাড়ি" - কী বাস্তব চিত্র! এ প্রজন্মের অনেকের এমন অভিজ্ঞতা নেই, আর হবেওনা কোনদিন।
    "শৈশব এসে দাঁড়ায় আমার পাশে
    বাতাসের গায়ে মায়ের গন্ধ ভাসে…" - এই কবিতার এর চেয়ে ভালো সমাপ্তি আর কিছু হতে পারে বলে ভাবতে পারছি না।
    এই অতি চমৎকার কবিতাটার জন্য তোমাকে ক্ল্যাপ্স, ক্ল্যাপ্স! :clap: :clap: :clap:

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      জী, স্যার। আমার দাদাবাড়ি চিলাহাটি থেকে ৬ কিলো দূরে নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার নয়ানী বাগডোকরা গ্রামে। নানাবাড়ি একই উপজেলার গোমনাতী গ্রামে। মা-বাবার চাকুরীসূত্রে আমরা রংপুরে থাকতাম। সেখান থেকে সড়কপথে দেড় ঘন্টায় সৈয়দপুর, তারপর সৈয়দপুর থেকে ট্রেন ধরে চিলাহাটি যেতে হতো।

      যখন কবিতাটি লিখি, তখন আমার দাদী বার্ধক্যজনিত কারনে খুব অসুস্থ ছিলেন। বাবা ছিলেন তার সন্তানদের মাঝে সব বড়। তিনি মৃত্যুশয্যায় বাবাকে দেখতে চাইলেন। কবিতায় বর্ণিত যাত্রীটি আমার বাবা। তিনি সেবার তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন।

      আপনার প্রশংসাসিঞ্চিত চমৎকার মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। বেশি কিছু লিখতে পারছি না আজ, চোখ ভিজে আসছে। (সম্পাদিত)


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
      • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

        অভিভূত হ'লাম। আমি ১৯৭৮-৮০ সালে সৈয়দপুরে কর্তব্যোপলক্ষে অবস্থান করেছিলাম। নানা কারণে সৈয়দপুরের ঐ দু'বছর আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে আছে। বর্তমানে যেটা সৈয়দপুর বিমান বন্দর, সেটার রানওয়ে যখন বানানো শেষ হয়েছিলো, প্রতিদিন সকালে রানওয়ে ধরে দৌড়াতাম। ঐ মাটিতে আমার অনেক ঘাম মিশে আছে।
        নীলফামারীতেও গিয়েছিলাম সড়কপথে। ডোমার, ডিমলাতেও গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে দারোয়ানী নামে একটা জায়গা ছিলো। সেখানে একটা কটন মিলস ছিলো। পিডিবি'র একটা বড় ট্রান্সমিশন স্টেশন ছিলো। নীলফামারীতে, খুব সম্ভতঃ জলঢাকায়, একটা কুষ্ঠ হাসপাতাল ছিলো। একদিন সেটা পরিদর্শন করতে গিয়ে যখন দেখলাম, এক খৃষ্টান নান কুষ্ঠরোগীর ঘা আক্রান্ত পা নিজহাতে গরম জলে ধুয়ে দিচ্ছে, তখন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। পাদ্রী সাহেবের সাথে কথা বলেও খুব ভালো লেগেছিলো।
        আমার গ্রামের বাড়ী লালমনিরহাট জেলার আদিতমারিতে, তবে আমি ঢাকাতেই বড় হয়েছি। বৎসরান্তে অবশ্য নানাবাড়ী দাদাবাড়ী বেড়ানো উপলক্ষ্যে রংপুর ও লালমনিরহাটে যাওয়া আসা হতো।
        সৈয়দপুরের কথায় ফিরে আসি। আমি যখন সেখানে ছিলাম, তখন আমার বয়স ২৩। কলেজে থাকতে দ্বাদশ শ্রেণীতে জন মিল্টন এর "On His Having Arrived At The Age Of Twenty Three" পড়েছিলাম। যখন কলেজে কবিতাটা পড়ি, তখন আমার বয়স ১৮। কবিতাটা বোর্ডের পরীক্ষার জন্য খুব ইম্পর্ট‌্যান্ট ছিলো, তাই খুব ভালো করে একটা নোট বানিয়েছিলাম। নোট বানাতে গিয়ে কবিতাটা অন্তরে মিশে গিয়েছিলো। যখন সৈয়দপুরে এসে ২৩ হ'লাম, তখন কবিতাটার কথা খুব মনে পড়তো, আর আশ্চর্য হয়ে ভাবতাম, কবি এই বয়সের অনুভূতিটাকে এত সুন্দর করে প্রকাশ করতে পারলেন কীভাবে! কবিতাটার লিঙ্ক এখানেঃ (সম্পাদিত)

        জবাব দিন
  6. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap:
    :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap:

    তোমার কবিতার সুরভিতে মন উচাটন হয়েছে, কবি!

    আমার মায়ের কোলপোঁছা মেয়েটি কতকাল তাঁর থেকে দূরে থাকে! সেই যে কৈশোরে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়েছি আর ফিরে যাওয়া হয়নি। ক্লজেটে মায়ের আটপৌরে শাড়িটি রাখা সযত্নে। টেবিলে সাজানো ছবি, দেয়াল জুড়ে বিশাল পোস্টারে সাঁটা মায়ের হাসিমুখ। বইয়ের প্রথম পাতায় ঝকমকে অক্ষরে লেখা, ভাল থেকো, মুনিয়া! আমার সাজানো গোছানো ঘরে সব আছে, কেবল তের নদীর ওপারে থাকেন আমার মা।

    অসাধারণ লেখা, ভাইয়া! ::salute::

    জবাব দিন
  7. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "কবিতায় বর্ণিত যাত্রীটি আমার বাবা। তিনি সেবার তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন" - শোকাতুর বাবার বেদনাবিধুর অনুভূতিকে নিজ বুকে ধারণ করে কি অনবদ্য একটা কবিতাই না তুমি রেখে গেলে, মোস্তফা! :hatsoff:

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      মাহবুব ভাই, এটি ভিনসেন্ট ভ্যানগগের 'দি পোটাটো ঈটারস'-এর একটি স্টাডি। মূল ছবি আঁকার পূর্বে তিনি এক একটি চরিত্রকে বহুবার স্টাডি করেছিলেন। পেন্সিলে, চারকোলে, তেলরঙে। তেমনি স্টাডি করেছিলেন পুরো ছবি। আলু নেদারল্যান্ডের সাধারণ্যের খাদ্য। ভ্যানগগ সাধারণ্যের জীবন ভালোবাসতেন। তাই নিত্যকার প্রচণ্ড কায়িক পরিশ্রমের দিনাবসানে সাধারণ চাষাদের একসাথে অতি সাধারণ রাতের খাবার গ্রহনের দৃশ্যই তাঁর এই মাস্টারপিসে তুলে এনেছেন। যা শ্রমজীবি নিরলংকার সমাজ-দর্শনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছিল।


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।