উল্টোমুখী

শীতের নরম রোদ্দুর । উঠোনে পাটি পেতে লাল রঙা লেপটা শুকোতে দিয়েছেন মা । সোনালী রোদ ছলকে যাওয়া মোটাসোটা লাল লেপটা দেখে খুশির ঝিলিক খেলে গেল নিশির মনে। গুটিসুটি মেরে বসে পড়ল লেপের ওপর।হাতে সুনীলের ‘প্রথম আলো।’ মা ওকে এ অবস্থায় দেখলে চিলচিৎকার জুড়ে দেবেন,এত বড় ধিঙ্গি মেয়ে কাজকর্ম বাদ দিয়ে রোদ পোহাচ্ছে বলে। কিছুক্ষণ আগে মা-মেয়ের এক দফা যুদ্ধ হয়ে গেছে।সকাল থেকে মা নিশিকে ঘরের কাজে হাত লাগাতে বলছেন।কিন্তু নিশি মার কথা গায়ে মাখছেই না।সে বরাবরই অলস স্বভাবের।তার ওপর এখন কলেজে শীতের ছুটি চলছে। এই শীতকালটা এলে তার আলসেমি একেবারে তরতর করে চূড়োয় উঠে যায়।সবসময় নরম উষ্ণ লেপমুড়ি দিয়ে উপন্যাস পড়তে ইচ্ছে করে। সাথে যদি গরমাগরম আলুর চপ আর ধোঁয়া ওঠা চা জুটে যায়,তাহলে তো ষোলকলা পূর্ণ ! সোনায় সোহাগা!ছোটবেলায় তার এই আরামপ্রিয়তা দেখে বাবা আদর করে বলতেন ‘আমাদের পুশি ক্যাট’ !মা পুরোই নিশির বিপরীত।তিনি নিজেই মাঝে মাঝে বিস্ময় প্রকাশ করেন এই মেয়েকে তিনিই পেটে ধরেছিলেন!মা উজান হলে নিশি ভাটি ! মা সবসময় ঘরদোর পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। কোথায় একটু ধুলো থাকলেও তার মনে হয় পাড়াজুড়ে তার বদনাম হবে ! প্রতিবেশিনীরা তাকে অপরিছন্ন নোংরা ভেবে বসবে !আর নিশি !নিজের ছোট্ট টেবিলটা গোছাতে গেলেও সে হাঁপিয়ে ওঠে!

রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীতে ডুবে আছে নিশি।এই বইটা এখন তার পঞ্চইন্দ্রিয়কে নিবিষ্ট করে রেখেছে।হুম…জীবনে একবার চন্দননগরে যেতেই হবে!মোরান সাহেবের এই বিশাল বাড়ি,যেখানে রবি-কাদম্বরী জীবনের অসাধারণ সুরেলা কিছু মুহূর্ত কাটিয়েছেন সেটা একবার নিজ চোখে না দেখলেই নয় ! অবশ্য যদি সেটা এখনো টিকে থাকে ।
‘এইসব কি নিশি !’
কল্পনার তন্ময়তা থেকে মা তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনলেন।বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা বিদ্যুতের মত খেলে গেল।
‘কী হয়েছে মা ! একটু পড়তে দাও না !’
‘ঘরে এত্তবড় কলেজপড়ুয়া মেয়ে থাকতেও আমাকেই সব কাজ করতে হয় !কয়টা দাসী-বান্দি আছে এই বাড়িতে যে তুই শুধু পায়ের ওপর পা তুলে ভাত গিলবি ?’
খাওয়ার খোঁটা সহ্য করতে পারেনা নিশি।রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
‘কী করতে হবে, বল?’
‘৬-৭টা পেঁয়াজ কুচিকুচি করবি,৫-৬টা মরিচও কাটিস।কয়েকটা পাতিল,কড়াই আর বাটি নোংরা হয়ে আছে।ওগুলো ভাল করে মেজে ফেল।’
এঁটো বাসন মাজতে হবে ! ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে নিশির। রান্নাঘরে গিয়ে দেখে একটা পাতিলে পাঙ্গাস মাছ ভেজানো।মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় নিশির।কোন মাছই সে খায়না ! আর দুপুরবেলার মেন্যু কি না পাঙ্গাস মাছ !নিশি রান্নাঘর থেকেই চেঁচায়, ‘ তোমার ওই গন্ধঅলা লেগুনের পাঙ্গাস মাছ আমি কিন্তু খাব না!’
‘না খাইলে আমি কী করব ! নিজে নিজে ডিম ভেজে নে।’
সব কাজ বাদ দিয়ে ডিম ভাজতে লেগে গেল নিশি।ফ্রাইপ্যান খুঁজতে গিয়ে দেখে সেটায় ফুলকপি ভাজি।শেষে কড়াইতে ফেটানো ডিম ছেড়ে দিল।উল্টে দিতে গিয়ে ডিম ভেঙ্গে তিন টুকরা! নিজেই নিজেই সান্ত্বনা দেয়,কোন ব্যাপার না ! খাওয়ার সময় তো ভেঙ্গেই খেতে হত!ভাজা ডিমের গন্ধে ক্ষুধাটা চাঙ্গা হয়।এক্ষুণি না খেলেই নয়!আরেকটা চুলায় ভাত হচ্ছে ।নিশি আলগোছে ঢাকনা খুলে দেখে ‘ হবে হবে’ অবস্থা। ও সেই আগুনগরম ভাত প্লেটে ঢেলে ডিমভাজা দিয়ে খেতে বসে।ঘি হলে জমত বেশ।ফ্রীজে ঘি আছে,মার বানানো। এক হাতে খেতে খেতে আরেক হাত দিয়ে ঘিয়ের বয়ামটা খুলতে চেষ্টা করে সে ।ঘি লেগে ঢাকনাটা পিচ্ছিল হয়ে আছে।ঝনাৎ!কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাচের বয়াম হাত ফসকে এক্কেবারে মেঝেতে।কিছুক্ষণ আগেই ঝকঝকে তকতকে করে মেঝে মুছেছেন মা।এই ঘি মার সুদীর্ঘ এক মাসের সাধনার ফসল।এক মাস ধরে সর জমিয়ে জমিয়ে ঘি বানানো হয়েছে।আতংকে নিশির হৃহপিণ্ড লাফাতে থাকে।খাওয়া বাদ দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করতে লেগে যায় সে।বয়ামের ভাঙ্গা টুকরাগুলো জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।ঘর মোছার ন্যাকড়া দিয়ে এক নিঃশ্বাসে ছড়িয়ে যাওয়া ঘি টুকু মুছে নিল। ঘৃণা ভরে ন্যাকড়াটা ছুঁড়ে ফেলল।এই ন্যাকড়া সে কখনো হাত দিয়ে ধরবে,তা ছিল তার কল্পনার বাইরে!তারপর প্লেটটা নিয়ে সোজা নিজের রুমে। ভাত খাওয়া তখন প্রায় শেষের দিকে। হঠাৎ মার আর্তচিৎকার শোনা গেল। ডাইনীং স্পেসের যেখানে ঘি পড়েছিল সেখানে মা পিছলে পড়েছেন।কোমর আর ডান পায়ে ব্যথা পেয়েছেন বেশ।নিশি মাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল।মা হঠাৎ ক্ষেপে উঠলেন , ‘ মেঝেতে কি ফেলছিলি বল ? অকর্মা কোথাকার !’

কোমর আর পায়ের ব্যথায় মা শয্যাশায়ী।বিছানা ছেড়ে উঠছেন না ।নিশি ধরে ধরে তাকে বাথরমে নিয়ে যায়।অনেকটা বাধ্য হয়েই নিশিকে ঢুকতে হল রান্নাঘরে।পাঙ্গাস মাছটা ফ্রীজে ঢুকিয়ে রেখে মুরগী বের করে পানিতে ভিজিয়ে রাখল।নাক কুঁচকে এঁটোবাসন ধুয়ে ফেলল।মুরগীটা কীভাবে রাঁধবে বুঝতে পারছে না ।মা তাকে বেশ বকাবকি করেছে।মাকে জিজ্ঞেস করার মুখ নেই। নিশির টিভির বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ল।মাংসের রেডি মশলা তো বাজারে পাওয়া যাচ্ছেই। ওটা দিয়ে কোনরকম কাজ চালানো যাবে।কিন্তু মশলা আনতে এখন আবার মোড়ের দোকানে ছুটতে হবে !চূড়ান্ত পর্যায়ের বিরক্তি নিয়ে নিশি মশলা কিনে আনল।তারপর প্যাকেটের গায়ে লেখা প্রস্তুত প্রণালী অনুযায়ী রান্না করার যথাসাধ্য চেষ্টা করল।কিন্তু কই ! কোন মুখরোচক সুগন্ধ তো বেরুচ্ছে না ! মা রাঁধলে সারা বাড়িতে জিভে জল আনা গন্ধ ভেসে থাকে।নিশি ভাল করে মুরগীর তরকারীটা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। যে চেহারা হয়েছে তাতে খাওয়ার রুচি হচ্ছেনা!ঝোলটা খুব টলটলে হয়ে গেছে ! এ মা ! সেরেছে ! দু’টো চুল ভাসছে ।চুল দু’টো ফেলে দিয়ে নিশি ওর অগোছালো খোলা চুলগুলো চামচ দিয়ে আঁটকে রাখে। নিজেরই ঘেন্না লাগছে এই খাবার চেখে দেখতে।তবু একটু মুখে দেয়।নিজে রায় দেয়- নিঃসন্দেহে সুখাদ্য নয়!তবে অখাদ্যও বলা যাবে না!রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে মার ঘরে যেতে গিয়ে ধপাস! আবার সেই ঘি মাখা জায়গায়।জায়গাটাকে অনেক গালাগাল করে সে।দুমাদুম ঘুষি দিতে মন চায়! তীব্র আক্রোশে ডিটারজেন্ট দিয়ে জায়গাটা ভাল করে মুছতে থাকে,যাতে কণামাত্র ঘিও না লেগে থাকে।
এ ক’দিনে নিশি আগের চেয়ে অনেক বেশি কর্মঠ হয়ে উঠেছে।বাধ্য হয়েই হওয়া।মা যে সেই ৫ দিন আগে বিছানা নিয়েছেন,আর উঠতে পারছেনই না।কাল এক্সরে করাতে নিয়ে যেতে হবে।এত দায়িত্ব ওর ওপর যে ওর মনে হয় ৫ দিনে পুরোদস্তুর গৃহিণী বনে গেছে সে।সকালে তবু পাউরুটি-কলা দিয়ে চালানো যায়,কিন্তু দুপুর থেকে শুরু হয় আসল ঝামেলা।তখন ভাত রাঁধো রে ! কুটনো কোটো রে!তরকারী রাঁধো রে!মা ইন্সট্রাকশন দেন-হ্যাঁ,শোন মরিচ কিন্তু ৪-৫টার বেশি দিবি না…চুলার আঁচ কমিয়ে ১৫ মিনিট রেখে দে…না,না…ওটা এখনো হয়নি।আরও কিছুক্ষণ রেখে দে…।দুপুরের রান্না কখনোই সে ৪ টার আগে শেষ করতে পারেনা।কাজ করতে করতে নিশি আফসোস করে,হায় ! কোথায় রবি,কাদম্বরী! মোরান সাহেবের বাগানবাড়ি!কোথায় তার কল্পরাজ্য!কোথায় লেপমুড়ি দিয়ে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে নিয়ে উপন্যাস পড়া! সে কি না আর দশটা মেয়ের মত ঘরের কাজ করছে! এভাবে রাঁধতে রাঁধতে ওর হাতে তেল ছিটকে ছোট্ট একটা ফোস্কা পড়ে গেছে।পেঁয়াজ কাটার সময় সময় চোখ লাল হয়ে যায়,দরদর করে পানি বেরোয়।পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছিল একবার।পরশু তার রান্না মুরগীতে লবণ হয়েছিল কম।ভাত হয়েছিল আধফোটা।আরেকদিন বেগুন ভাজা কাঁচাই রয়ে গিয়েছিল।গতকাল থেকে অবশ্য রান্নায় ভুলভাল কম হচ্ছে।মা খেয়ে বলেছে দারুণ হয়েছে! সেই থেকে রান্নায় কিছুটা উৎসাহ পাচ্ছে সে।হাজার হোক রান্নাও নাকি একটা শিল্প!

নিশি প্লেটে ভাত-তরকারী নিয়ে মার ঘরে আসে।একটা অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে।মা ‘প্রথম আলো’ পড়ছে! এই মাকে কোন বই তো দূরের কথা,খবরের কাগজও পড়তে দেখেনি সে!
‘দাও,দাও,আমার বই দাও!’
‘সারাজীবন তো এসবই পড়ে গেলি! মাকে পড়তে দে ক’টা দিন!’
নিশি ঘ্যানঘ্যান করে, ‘ মা,তুমি সুস্থ হওনা কেন ? আমার শীতের ছুটিটা পুরাই মাটি! অ্যাঁ…!’
‘আচ্ছা ,থাক,তুই আজ রেস্ট কর।আমি দেখি খোঁড়ায় খোঁড়ায় কাজ করতে পারি কিনা ।’
‘হইছে ! হইছে ! এক্কেবারে পঙ্গু হওয়ার ধান্দা!তোমাকে কাজ করতে হবে না! আরেকটু সুস্থ হও আগে!আমিতো রান্নাবান্না শিখেই গেছি।’
মা হাসেন ! যাক,তার উল্টোমুখী মেয়ে কিছুটা হলেও দিক পরিবর্তন করেছে!

১২ টি মন্তব্য : “উল্টোমুখী”

  1. রিদওয়ান (২০০২-২০০৮)

    আপু,
    আমার মা আর বোনদের দেখেছি। এক সময় সম্পর্কটা উলটে যায়। মেয়ে মায়ের ভুমিকা নেয়, মা তার কাছে সন্তানে পরিনত হয়। তোমার লেখাটা আমার খুবই ভাল লাগল। :thumbup: আশা করি নিয়মিত লিখবে। আরও লেখা আশা করছি তোমার কাছ থেকে।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।