রূপ আর বাবা মা’র গল্প

এখানে হুট করেই সন্ধ্যা নামে। মুরং পাড়ার ওপাশে শেষ ঝুপড়িটার ধার ঘেঁষে সূর্যটা হারিয়ে যায়। আঁধার নেমে এসে ঢেকে দেয় পাহাড়ের মাঝখানে দূরত্বটা। অনেক গুলো জোনাকি হঠাত করেই জেগে ওঠে আলোর মিছিল নিয়ে। একটা তক্ষক নিজের মনেই ডেকে ওঠে, একটানা, অনেকক্ষন ধরে। তারপর কোত্থেকে একটা ব্যাঙ, অনেক গুলো নাম না জানা পোকা থেকে থেকে ডেকে চলে। পৃথিবীর এক প্রান্ত যেন, অদ্ভুত নীরব, অনেকটা অন্যরকম। সন্ধ্যা নামে এই পাহাড়ে। একই রকম করে প্রতিদিন। হয়ত বদলে যায় অন্য ঋতুতে, একটুখানি। কিন্তু দুই পাহাড়ের মাঝখানে হুট করে সন্ধ্যা নেমে আসার এই গল্পটা বোধকরি একই থাকে প্রতিদিন, আজন্মকাল ধরে।

একটা অন্যরকম গল্প আছে, রোজ সন্ধ্যায় একজন বৃদ্ধ আসে, হাতে ধুনচি নিয়ে। নির্জন এইখানে। ওই আমার একমাত্র কথা বলার সময়। সৌম্যকান্তি একজন মানুষ, ঘুরে ঘুরে ধুপ দিয়ে যায়, আমি একটু একটু করে ওর গল্প শুনি। কত রকম গল্প, ছেলেটার বড় হওয়ার গল্প, বিশ শতক জমি কেনার গল্প, এই বয়সে ঐ হতচ্ছাড়া পাহাড়ে চড়ার গল্প আর হঠাত করেই সেই বহুদূর সমতলে ফেলে আসা পাঁচ ক্লাশে পড়া মেয়েটার জন্য মন কেমন করার গল্প।বুড়ো বয়সের সন্তানের জন্য মায়াটা বোধ হয় একটু বেশিই টানে। ওর অনেক কাজ। গুচ্ছের কাজ ফেলে আমার সাথে এত্ত প্যাঁচাল পাড়ার সময় কই ওর। ধুপের ধোঁয়ায় ঘরটাকে ঢেকে ফেলে ও চলে যায়। এইপাশ থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনে আমি আবার নিজের মত, সাপ, ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ শুনি।

রাত বাড়ে। আমার কাছে শব্দেরা ফিরে আসে বহুদিন পর।অনেক অনেক দিন পর। ফেলে আসা শহরের কত্তগুলো বছর, জীবন আর জিবিকারা শক্ত সব ইংরেজির জালে খুব করে জাপ্টে ধরেছিল। নিজের মত করে ভাবার একরত্তি সময় হয়নি আমার। কাল রাতে অনেক দিন পর সেই একযুগ আগের মত লম্বা সময় কথা হল রুপার সাথে।যদিও সেই সব দিনের মত নতুন নতুন স্বপ্ন বোনার বদলে সংসারের খুটিনাটি, রুপের নিত্য নতুন দুষ্টুমির খবর আর সামনের দিনগুলোতে কি করা যায় তাই নিয়ে, তবুও… হোক না। অনেক অনেক চিঠি লেখার দিন ছিলো তখন। দু’টাকার হলুদ খামে দিন তিনেকের পথ পেরিয়ে কত কত স্বপ্নেরা তখন পৌঁছে যেত একই ঠিকানায়। তারপর বদলে গেল সবকিছু। ঐ সময়ের হাজার স্বপ্নের একটা ছিল … আমাদের বাসার কোন এক কোনে একটা বাক্স থাকবে, চিঠির বাক্স। হয়নি, অনেক কিছুই আর শেষতক ঠিকমত হয়ে ওঠে না। একছাদের নিচের দিন গুলোতে এত এত ব্যস্ততা কত কিছু কেড়ে নেয়। ইচ্ছেগুলো বুদবুদ হয়ে মনের ভেতর বাড়তে থাকে, তারপর একদিন ঐ ব্যস্ততা বাড়তে থাকা বুদবুদটাকে বাস্তবতার সূচে আলতো করে হুল ফোটায়। প্রেয়সীরা ভুল বোঝে, আগেতো এমন ছিলে না তুমি।
আমি আর আমরা এখানে অনাহুত, সাপ, ব্যাং আর ঝিঁঝিঁ পোকারা মানতে চায় না আমাদের সহাবস্থানের প্রস্তাব। নিজের খুশিতে একে বেকে পথ চলতে চলতে তাই হিসহিস শব্দ করে সাপেরা পথ আগলে দাড়াতে চায়। চারদিকে কার্বলিক এসিডের শিশিগুলো প্রবল চেষ্টায় আটকে রাখে বসতিতে ওদের অবাধ আনাগোনা। টর্চের আলো ফেলে লাল মাটির পথ ধরে যেতে যেতে একটু ভয় ভয় লাগে। লাগুক না, ওদের ডেরায় এসে অনাহুত অতিথির এটুকু ভয় ন্যায্য প্রাপ্য।

একটা ময়না আছে, ওই দূরে, শেষ টিলাটার ওপরে। কথা জানে।ভাত খায়, এত্তগুলো মরিচ মাখানো ভাত।হলুদ রঙের খাচাটার ভেতর দিনমান বসে থাকে আর থেকে থেকে রকি নামে কাউকে ডেকে ওঠে। সামনে গিয়ে দাড়ালে চোখ ঘুরিয়ে তাকায়। চিনতে চেষ্টা করে। একবার তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমি রকি নই, বুঝে ফেলে। আমি জানি, সামনের দিনগুলোতে ও আমাকে চিনতে পারবে, মুখ ঘুরিয়ে নেবে না। একটা মাত্র ময়নার কথা বললাম, আরো আছে, তিনটা তিতির। একটা পুরুষ আর দু’জন নারী।এদের গল্পটা এখনো বুঝিনি ভাল করে, তবে তিতির সাহেবের রাজকীয় চলন বলন শব্দের চেয়ে ছবিতে ভালো ফুটবে বোধহয়।

ভোর হলে একটা লম্বা পথ পাড়ি দেব কাল। রুপের সাথে কথা হয়নি সারাদিন। আমার দুষ্টু ছেলেটাকে অদ্ভুত সুন্দর শোনায় টেলিফোনে, অনেক মায়া ওর আমার আর ওর মা’র জন্য। আমাদেরও……রুপের জন্য। আজকের খবরগুলো বড় অন্য রকম। মন খারাপ করা।

৪,০২৫ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “রূপ আর বাবা মা’র গল্প”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    ১ম B-)

    পুলাপাইন আইলস্যা হয়ে গেছে (আমিও এদের মধ্যে একজন 😛 )

    ৭৭ বার দেখা, ৫ বার শেয়ার করা একটা ব্লগে এসেও মন্তব্যে আমিই প্রথম!


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  2. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    এখন অন টপিকে-

    ভালো লাগার একটা অনুভূতি সারাটা ব্লগে ছড়িয়ে আছে। তবে এটা ময়ঙ্কে বিষণ্ণ কয়রে দেয়।

    বিষণ্ণতার ব্যান চাই :grr:


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  3. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    একানব্বুই-বিরানব্বুইয়ে কাটানো হীলের ক্যাম্প-জীবনে ফিরে গেলাম।
    এরকম ভাবনা চিন্তা, চিঠি-পত্র লিখালিখির সময় ছিল সেটা।
    তবে ফোনালাপ?
    উঁহু, এক্কেবারেই ছিল না।
    আর অভ্র বা ল্যাপটপ ছিল না বলে, লিখে রাখা বা শেয়ার করা হয় নাই কিছুই। কক্ষনো।

    ভাল লেগেছে...
    :clap: :clap: :clap:


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।