‘স্যার, আপনাকে সালাম’

আগস্ট ১৯৭১। পাল বাড়ির উঠোনে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে অনেকগুলো মানুষ। একজন, দু’জন, তিনজন, একে একে বাড়তে থাকে সংখ্যা, পনের ছাড়িয়ে আঠার পর্যন্ত। বিভিন্ন বয়সের, বৃদ্ধ, তরুন, কিশোর। জড়ো হওয়া মুখগুলোতে তীব্র উৎকণ্ঠা, ভীতি আর গভীর শঙ্কা। কারো চোখে পানি, কারো ঠোটে তিরতির কাঁপন।বুকের ভেতর ভয়ংকর ধুকপুক, হাতুড়ির শব্দ। এতোদিনের চেনা মুখগুলোর দিকে তাকালেই ব্যাথাতুর শেষ দেখার অনুভূতি। ভীষন কষ্ট, বাঁচার তীব্র আকুতি। উদ্যত বন্দুক হাতে খাকি পোশাকের হায়নাগুলোর দিকে তাকাতে প্রবৃত্তি হয় না তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণায়। তবু ওদিকেই তাকাতে হচ্ছে, ওদের দিকে নয়, ঐ বন্দুকগুলোর দিকে। সত্যি কি গুলি করবে ওরা? সত্যি কি এতগুলো নিরীহ লোককে মেরে ফেলা যায়? ভয়ংকর অস্থিরতার মধ্যেও তীব্র অবিশ্বাস, একটুখানি হলেও আশা, হয়ত না, হয়ত না। মৃত্যুর খুব কাছে দাড়িয়েও আশাবাদী মন। উঠোন পেরিয়ে ঘরের ভেতর তখন ভাংচুর আর কুকুরের ছোটাছুটি।

জড়োসড়ো হওয়া মানুষগুলোকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো খালের ধারে। একটু দূরে ঝোপের ভেতর তখন এক কিশোর প্রাণপণে কান্না চেপে আছে। ঠোট কামড়ে নির্জীব পড়ে থাকা কিশোরের সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে। ভীত সন্ত্রস্ত চোখে তার অঝোর কান্না। কান্না আর ঝুম বৃষ্টির জলে কিশোরের দৃষ্টি আটকে যায় বারবার। তবু বেঁচে থাকার আকুতি, শীর্ণ শরীরটাকে আরো শীর্ণ করে নিজেকে লুকিয়ে রাখার জৈবিক অনুভূতি।তার ঝাপসা চোখের সামনে তখন বাবা, কাকা, দাদা, ভাই, তার পুরো পরিবার। একদল শকুন ঘিরে রেখেছে তার সবটুকু পৃথিবীকে, কিশোর বেলায় তার আপন আর নিজের করে জানা সব ক’জন মানুষ। হিংস্র হায়নারা পাক খাচ্ছে, নোংরা দাঁতগুলো খিঁচিয়ে ওরা অপেক্ষা করছে, ওদের জিহ্বায় বিষাক্ত লালা।

তারপর গুলি চললো, ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে, তারপর এলোপাথারি, একটানা, অনেকক্ষণ। নিরীহ, সহজ, সাধারণ মানুষগুলো একে একে ঝড়ে পড়লো, ঝড়ে পড়লো, ঝড়ে পড়লো। ঝাপসা চোখে কিশোর দেখে ভাইয়ের বুকে রক্তের ছোপ, কাকা বোধহয় শেষবারের মত মা দুর্গার নাম নিয়ে নিলেন, পড়ে যাওয়ার সময় তাঁর ঠোট কাঁপছিলো বিড়বিড় করে। বাবা কি স্বর্গের পথে শেষবারের মত তাঁর কিশোর ছেলেটির মুখ মনে করে স্মিত হেসেছিলেন? অঝোর বর্ষণে ছেলেটির চিৎকার চাপা পড়ে গেল। হুহু কান্না তার শব্দহীন। নির্বাক ছেলেটির মাথা ভর্তি কেবল শুন্যতা, অনুভূতিরা তাকে রিক্ত করে চলে গেছে। শুন্যতার ভোঁতা গুনগুন ছাড়া আর কোন অনুভূতি নেই তার। অনুভূতিরা সত্যি চলে গেছে। প্রাণপ্রিয় বাবা, কাকা, ভাইদের সাথে অনুভূতিরাও চলে গেছে স্বর্গদ্বারের কাছাকাছি। বোবা, শুন্য দৃষ্টি নিয়ে ছেলেটি তাকিয়ে আছে তার মৃত পৃথিবীটার দিকে। আকাশ ভরা কান্নার জল তখন একটু একটু করে লাল হচ্ছে, লাল বৃষ্টি, আরো লাল হয়ে সেই বৃষ্টির জল তখন মিশে যাচ্ছে আরো অসংখ্য শহীদের রক্ত মিছিলে, স্বাধীনতা আর বিজয়ের পথে। বোবা, বোধশুন্য কিশোরের চোখে তখনও ভয়াল নির্লিপ্ততা, অনুভূতিহীন ভোঁতা চোখ, অনুভূতিরা ফেরত আসেনি।

তারপর, সহসা কিশোরের সবটুকু ভাবনা, চেতনা আর জীবনের পরিধি ছুঁয়ে অনুভূতিরা ফিরে এলো। অসহ্য অনুভূতি, সব হারানোর, নিঃস্ব হবার, বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে দেবার অনুভূতি। অনুভূতিরা ফিরে এলো, বার বার, বার বার, প্রতিবছর, ঐ মাসটায়, ঐ দিনটায়। প্রতিবার সেই একই অনুভূতি, প্রতিবার সেই বোবা আর বোধশুন্য হয়ে যাওয়া, তারপর দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে অনুভূতিদের ফিরে আসা।

পি কে পাল স্যারের সাথে আমার কখনো কথা হয়নি। দেখা হয়েছিলো। একবার। রংপুর ক্যাডেট কলেজে, অধ্যক্ষের বাংলোয়। নিঃসংগ সেই কিশোর তখন তাঁর ফিরে আসা অনুভূতিদের নিয়ে বর্ষা মুখর ৭১ এর মতই নিরবে আর একবার বিদায় বলেছেন ৩৬ বছর আগেই শুন্য হয়ে যাওয়া পৃথিবীকে, স্বেচ্ছায়।

একটা ছোট্ট চিরকুটে লেখা ছিলো ‘বিদায় পৃথিবী। ১৯৭১ এর আগস্ট, –প্রতিবছর এই মাসটা এলে আমি মানসিক ভাবে অস্থির হয়ে যাই।—– ৩০ লক্ষ শহীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।‘

———-*****—————-*****—————-*****———*****————-

পুনঃশ্চ পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে রংপুর ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষের বাংলোয় পি কে পাল স্যারকে শেষবারের মত দেখা কয়েকজনের মধ্যে আমি একজন। স্যারের লিখে রাখা চিরকুট আর অন্য শিক্ষকদের ভাষ্য থেকে শুধু জেনেছিলাম, দীর্ঘ্য সময় ধরে স্যার ৭১ এর একটি ভয়ংকর স্মৃতি বয়ে বেড়িয়েছেন। যা তাঁকে খুব গভীর ভাবে প্রভাবিত করতো। অন্যদের মুখে শুনেছি ঐ মাসটাতে স্যার ভীষণ চুপচাপ হয়ে যেতেন। তবে ঐ পরিস্থিতিতে ৭১ এ নিহত শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা ও প্রত্যেকের পরিচয় জানার মত কাউকে আমি খুঁজে পাইনি। খুব বেশী আশ্চর্য্য হয়েছি স্যারকে খুব কাছে থেকে দেখা মানুষগুলো কেউ বিষয়টির বিস্তারিত জানতেন না। হয়ত স্যারই তাঁর নিভৃত ৭১ টাকে শেয়ার করতে চাননি। কেউ যদি শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা , তারিখ ও সময়টা জানাতে পারেন আমি সংযোজন করে নেব। লেখাটার শেষভাগে এসে স্যারকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু জীবনের শেষ বাক্যটাতে যিনি লিখতে পারেন “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” তিনি আমার কাছে কেবলি একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন বীর শহীদ। একজন শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর যোগ্য শব্দ আমার জানা নেই। শুধু অস্ফুটে বলতে চাই ‘স্যার, আপনাকে সালাম’।

১,৭৭৪ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “‘স্যার, আপনাকে সালাম’”

  1. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    পিকে পাল স্যার কে আমরাও অল্প সময়ের জন্য পেয়েছিলাম, সবচেয়ে আর্শ্চয্য কি জান, আমাদের সিনিয়রদের কাছ থেকে পিকে স্যারের যে চিত্র পেয়েছি, তাতে তিনি বেশ রসিকতা করেই কথা বলতেন। কিছু কিছু কথা নিয়ে তো রিইউনিয়নে ভাইয়ারা স্যারের সামনেই বেশ মজা করেছিলেন।

    কিছুই বুঝতে পারিনি আমরা......।।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  2. তানভীর (০২-০৮)

    আমরা স্যার কে এক বছরের মতো পেয়েছিলাম ভি পি হিসেবে ।অনেক নরম এবং সাদাসিদে মানুষ ছিলেন , বেশ চুপচাপ ।তার এই ঘটনার কথা জানতাম ,তবে এই ব্যাপারে কখনোই কথা বলেন নি । স্যার কে অনেক জালিয়েছি, এখন অনুতপ্ত 🙁
    স্যার যেখানেই আছেন আশা করি ভালো থাকবেন ।

    জবাব দিন
  3. মুহিব (৯৬-০২)

    এত সাধারণ এবং ভাল একজন মানুষ আমি আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। স্যারের সেই দরাজ কন্ঠ আজও আমার কানে বাজে। এই দুঃসংবাদটা যেদিন শুনেছি নিজের কানকেও অবিশ্বাস হচ্ছিল। খুব কম সময় পেয়েছি মানুষটাকে। কিন্তু খুব কাছের মনে হয়েছিল।

    জবাব দিন
  4. রিফাত (২০০২-২০০৮)

    কলেজে ঢোকার পর স্যার কে ভি পি হিসেবে পেয়েছিলাম .....অনেক স্মৃতি আছে স্যার কে নিয়ে .......তারপর স্যার রংপুর চলে গেলেন .....একদিন খবরে স্যারের মৃত্যু সংবাদ পেলাম ....সহজভাবে নিতে পারি না ব্যাপারটা ...কেমন যেন লাগত !!!
    স্যারের অতীত সম্পর্কে ভাসা ভাসা কিছু শুনেছিলাম.....
    যেখানেই থাকুন স্যার ....ভালো থাকুন ....
    স্যারকে নিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ ভাই .....!

    স্যার, আপনাকে সালাম’ ::salute::

    জবাব দিন
  5. আমীন (০১-০৭)

    স্যার আমার ক্যাডেট কলেজ ভর্তির ভাইভা নিয়েছিলেন মনে আছে।উনার একটা প্রশ্ন ছিম এরকম," মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কতজন শহীদ হয়েছেন?তোমাদের কোন আত্মীয় কি যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন?"

    স্যারকে সালাম। ::salute::

    জবাব দিন
  6. sir কে আমি পাই নাই, কিন্তু অনেক গল্প শুনসি, সব ই funny , এই রকম একটা ঘটনা sir এর জীবনে ঘটসে এইটা চিন্তা ও করতে পারি না .... কি কষ্টেই না তিনি এইভাবে বিদায় নিলেন? রেশাদ তোর লেখার জন্যে ভীষণ ধন্যবাদ আর sir কে সালাম.....

    জবাব দিন
  7. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    পি কে পাল স্যারকে পাইনি তবে উনাকে নিয়ে আগে একটি পোস্ট এসেছিলো (খুব সম্ভবত জিহাদের)। তার মারফত জেনেছিলাম নিভৃতচারী এই বীরের কথা। এসব জায়গা গুলোতে আমি কিছু বলতে পারি না। শুধু বলি, স্যার আপনাকে সালাম। যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।