সুখ দুঃখ নিয়ে এই ছোট্ট জীবনে অনেক ভাবতে হয়েছে আমাকে। সেটা যে কারনেই হোক আমার চিন্তাধারা খুলে যায় ২০০৪ সালে শহীদ ক্যাডেট কোচিং এ থাকাকালীন ভবন-১ এ থাকতে। ৪ তালার হাবিব স্যার এর ফ্ল্যাট এ শুয়ে এক বিকালে বেডমেটের সাথে কথা বলতেসিলাম। রাজীব নাম ছিল ছেলেটার। খুব গরীব পরিবারের ছেলে, শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শিখেনি বলে কারও সাথে তেমন কথা বলত না, আর আমার ডুয়েল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার ছিল আই মীন খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তনশীল ছিলাম বলে আলাদা থাকতাম,তাই আমার বেডমেট হিসাবে স্যার ওকে ঠিক করে দিয়েছিলেন এই ভেবে যে আমিও বেশি কথা বলিনা আর রাজীব ও বলেনা, কাজেই সমস্যা নাই,যে যার মত থাকবে।
আমার জীবনে আমি দাবা খেলা শিখেছি রাজীব এর কাছ থেকে। খুব অবাক হয়ে দেখতাম যার ফ্যামিলিতে বছরে একটা শার্ট কিনে দিতে বাবাকে ৩৬৫ দিন রিকশা চালাতে হয় সেই ছেলে দাবা খেলাতে বিশাল পারদর্শী। টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক ভাষার টান লুকানোর আপ্রাণ চেষ্টা থাকতো,প্যারেন্টস ডে তে কখনো আমি ওকে রুম এ পাইনি। প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধ সমৃদ্ধ রাজীব ছাদ এ বসে যাদের বাবা-মা আসতো না বা ২ সপ্তাহে একবার আসতো তাদের সাথে কাগজের বল আর জুতা দিয়ে ব্যাট বানিয়ে ক্রিকেট খেলত। রাজীব আমাকে একদিন বলেছিল-
~~~আনন্দ আর সুখের মধ্যে অনেক পার্থক্য দোস্ত।~~~
আমি কিছুই না বুঝে সব বুঝসি ভাব নিয়ে হু হু করতাম। রাজীবের সাথে আর কখনো দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই হয়ত। রাজীবের কথাগুলো,ওর চারপাশ নিয়ে ভাবতাম ক্যাডেট কলেজে চলে যাবার পর। খুব অবাক হয়ে একদিন আবিষ্কার করলাম ক্লাস ৭ এ থাকতে লং-আপ হয়ে থাকা অবস্থায় কষ্ট সহ্য করার জন্য আমি রাজীব কে নিয়ে ভাবছি। এত কিছু থাকতে রাজীব কেন সেটা আজও আমি জানিনা। ছেলেটার মধ্যে আলাদা একটা সত্ত্বা ছিল যেটা দেখেই নিজের ভিতরের সত্ত্বাকে অনুভব করার তীব্র ইচ্ছা আমাকে নাড়া দেয়। কলেজ জীবনে ৬ বছরের দীর্ঘ সময়ে আমি কখনোই কোন জুনিয়র কে দিয়ে জুতা পালিশ করাইনি এবং সেটা একবারের জন্য ও না। যখনই দিতে যেতাম রাজীব ভেসে উঠত চোখের সামনে, ওর অসহায়ত্ব, ওর স্বপ্ন, ছোট বোনটাকে বিয়ে দিবে কোন এক সচ্ছল পরিবারে সেই আশা। সুখের স্বপন।
মানুষ অনেক বিচিত্র প্রাণী। সে চাইলেই নিজের স্বার্থে অজান্তে কিংবা সজ্ঞানে নিজের ব্রেইন থেকে অপকর্মের স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে। অনেককেই সুখ দুঃখ নিয়ে অনেক আক্ষেপ করতে দেখি। আজকাল ফেইসবুকের একটা সুন্দর ট্রেনড বলা যায়- হ্যাপিনেস ইজ/স্যাডনেস ইজ- লিখে নিজের কোন কিছু একটা লিখে দেয়া। জিনিসটা ভালোই লাগে আমার। সুখ দুঃখ প্রকাশ করার বা খোঁজার একটা চেষ্টা তো অন্তত।
রাজীব নামের ছেলেটা আমার জীবনে না থাকলে হয়তো এতদিনে আমি নষ্ট হয়ে যেতাম। আল্লাহ আমার মধ্যে খারাপ গুন অনেক দিয়েছেন তবে একটাই ভালো জিনিস যেটা সেটা হল সময়ের সাথে সাথে দেখিয়ে দেন যে এটা খারাপ।
সুখ আর আনন্দ এবং দুঃখ আর কষ্ট র মধ্যে আমরা গুলিয়ে ফেলি এটা না জেনেই যে সুখ এবং আনন্দের মধ্যে যেমন পার্থক্য তেমনি দুঃখ এবং কষ্টের মদ্ধেও অনেক পার্থক্য নাহলে বাংলা ব্যাকরন বই এ সুখ এর বিপরীত শব্দ দুঃখ আর কষ্টের বিপরীত শব্দ আনন্দ দেয়া থাকতো না। জীবনের সমস্ত আনন্দগুলো মিলিয়েও হয়তো মাঝে মাঝে একটু সুখের সমান হয় যদি কেউ জানে সুখ আসলে কি। তেমনি কষ্ট জিনিসটাও আপেক্ষিক, কিন্তু দুঃখ না। রাজীবের অনেক দুঃখ ছিল আর আমার ছিল কষ্ট। আজ ২১ পেরিয়ে ২২ এর দ্বারপ্রান্তে এসে একটু হলেও বুঝি জীবনে কষ্ট আর আনন্দের পরিমান অনেক,না চাইতেই আসে জীবনে। কিন্তু সুখ আর দুঃখ কে অর্জন করতে হয়। ইউনিভার্সিটি জীবনে অনেক চমক,আনন্দ।চাইলেই যেকেউ আনন্দের বন্যায় ভেসে যেতে পারে এবং নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী ভাবতে পারে এটা না বুঝেই যে সে আসলে সুখী নয়।
আমার জীবনে যতটুকু অর্জন তার ১০০ ভাগ সিম্পল থাকার জন্য যেটা রাজীব আমাকে শিখিয়েছে। মাঝে মাঝে লিখি, এক জীবনে অনেক সৌভাগ্য যে আমার কোন লিখা পরে বাবার বয়সী বড় ভাই হাউমাউ করে কাঁদেন, কোন ষোড়শী তরুণী তার স্বপ্নের সাথী ভাবে আমাকে। জিনিসগুলো আমাকে আনন্দ দেয়, অনেক আনন্দ। মাঝে মাঝে মানুষের সাথে মন খুলে মিশি, একেবারে ভিতরের কথা বলি,জীবনের কথা। সামনে থাকা মানুষটি অবাক হয়। চোখে মুখে অবিশ্বাস খেলা করে।
জীবনকে বুঝতে হলে এর কাছে আসতে হয়। আনন্দের এই দুনিয়ায় এত সময় খুব কম মানুষেরই আছে আজকাল। তাই হয়তো এই রাস্তায় আমি অনেক একা। তবে মাঝে মাঝে রাজীব দেখা দেয়। সময়গুলো অনেক সুখের আমার জন্য। অনেক কষ্টের মাঝে ভালো থাকার ক্ষুদ্র উপকরণটি খুজে পেতে অজুহাত লাগেনা।
রাজীব ভালো থাকিস। 🙂
খুব ভালো লিখছিস। যোগাযোগ আছে ছেলেটার সাথে?
:clap: :clap: :clap:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
ভাই আমি ওর খোঁজে ওর পুরানো বাসা পর্যন্ত গিয়েছিলাম। ওরা অন্য কোথাও চলে গেছে। খুজে পাইনি। 🙁
ধন্যবাদ ভাই। 🙂
ধন্যবাদ রাজীব ভাই। 🙂
:clap: :clap: :teacup:
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল
ভাল লিখেছো :thumbup:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
সুন্দর লিখছ।
আহারে, পোলাডা কই আছে কে জানে।
দোয়া করি সে যেন জীবনে আনন্দ আর সুখ দুটোই খুঁজে পায়।
... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!
ধন্যবাদ ভাই। 🙂
ভীষণ পরিণত লেখা।
মর্মস্পর্শী।
ধন্যবাদ ভাই। 🙂