বকবকানির বাকবাকুম

রাত দুইটা বেজে উনিশ মিনিট। আমি পঞ্চগড়ে। সবাই ঢাকায়। জরুরি কাজে এসেছি। আগের দিন রাত পৌনে এগারটায় বাসে চেপে, হাইওয়ের অস্বাভাবিক ট্রাফিক ঠেলে সতেরো ঘণ্টা পাড়ি দিয়ে পরদিন বিকাল চারটায় পৌছেছি। আরেকটু হলে তো শিকড় গজিয়ে যেত। বিকাল-সন্ধ্যায় টানা ঘুম। এখন আর ঘুম আসছে না। ফেসবুকে সময় কাটাচ্ছি। ওদিকে পরিবার মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ম্যাসেঞ্জারে সাড়া পাচ্ছি না। ফোনে ডিস্টার্ব করতেও ইচ্ছা করছে না।

কিছুক্ষণ অনেক ছোট বয়সের দুজন জুনিয়রের সাথে একই প্লাটফর্মে ভার্চুয়াল ক্যাচাল করলাম। তাদের গুড নাইট বলার পরেও তাদের স্ক্রীণে ঢুকে গপ্পসপ্প করছিলাম। নাহ! বুড়ো হয়ে যাচ্ছি! অবুঝ হয়ে যাচ্ছি! অন্যরা হয়ত ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলে না, কিন্তু আমি অযাচিত হয়ে গল্পের মাঝে ঢুকে প্রাইভেসি লংঘন করেই যাচ্ছি। যে জিনিসটা অন্যের কাছ থেকে পেলে বিরক্ত হই, তাই কিনা এতক্ষণ ছোটদের সাথেই করছিলাম। রবীন্দ্র-ভাষায় “মরি! ছিঃ ছিঃ! একি লজ্জা!”

আরিশাকে মিস করছি অনেক। মানুষ অনেক খারাপ হলেও বাবারা নাকি কখনোই খারাপ হয় না। কারনটা নাকি, বাবা হলো ছেলের প্রথম হীরো, আর মেয়ের প্রথম ভালবাসা!! আগের রাতে বাসা থেকে পৌনে দশটায় বাসে চাপার উদ্দেশ্যে যখন বেরুচ্ছিলাম, মেয়েটা শক্ত করে গলা জড়িয়ে এমন আদর করছিল, কেঁদেই ফেলেছিলাম প্রায়! প্রতিটা চুমুতে ভালবাসার ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। এত্তটুকু মেয়ে কি ভালবাসা বোঝে? নাকি, সেটা তার আদর-আদর খেলা ছিল? ভালবাসা নাকি বংশানুক্রমিক নিম্নগামি, প্রথমে সন্তান, তারপরে নাতি-নাত্নি!! আসলেই আরিশাকে মিস করছি অনেক। বৌয়ের জন্য কখনো এমন উতলা হয়েছি বলে তো মনে হয় না। কারনটা সম্ভবত, বৌ হচ্ছে “টেকেন ফর শিওর; টেকেন ফর গ্রাণ্টেড”!! কিন্তু বাবার দুলালি!! পাপার প্রিন্সেস!! প্রাইজলেস প্রিন্সেস!! সে তো “অলওয়েজ ফর শিওর নয়”, তাই না!! আসলে আমি মেয়েটাকে সময় দেই অনেক কম। অন্য সময় আত্মপক্ষ সমর্থনে বলি, “সময় দিতে পারি না”। এই মুহূর্তে ভাবছি, তাহলে অন্যান্য ভাল বাবারা কিভাবে সময় দেয়? তারা কি ম্যাজিক জানে? নাকি আমিই টাইম ম্যানেজম্যাণ্টে জিরো? নাকি আমি একটা পচা বাবা? সিম্পলি এন আগলি রটেন ড্যাড?

মেয়েটাকে বড্ড বেশি মিস করছি। আজই প্রথম এমন হলো, তা মোটেও নয়। মাঝে মাঝে অফিসে কাজের ফাকেও এমন হয়। একাকীত্বেই বেশি হয়। আমি কি স্বার্থপর? হ্যা, সম্ভবত আমি স্বার্থপর। আসলেই আমি স্বার্থপর। নাকি আমার মতন আরো অনেকেই স্বার্থপর? নাকি, প্রায় সবাই স্বার্থপর? আচ্ছা, কেউ কি আসলে স্বার্থপরতার উর্ধ্বে যেতে পারে? সিচুয়েশনাল স্বার্থপরতা! পজিশনাল স্বার্থপরতা! ইগো সংক্রান্ত জটিলতা! — আমার তো মনে হয়, মানুষই স্বার্থপর (অন্য প্রাণীদের সম্পর্কে কল্পনার যোগ্যতা রাখি না); সবচেয়ে বেশি সে কেবল নিজেকেই ভালবাসে। — বাচ্চাকে ভালবাসি। কেন? কারন, আমার বাচ্চা। আমিত্ব এখানেও!! — নাহ!! জটিল হয়ে যাচ্ছে। — আসলেই আরিশাকে মিস করছি অনেক। কিন্তু লিখতে বসে এখন উপলব্ধি হলো, লিখতে ভালই লাগছে। একটা খারাপ লাগা, একটা ভাল লাগার স্বার্থপরতা দিয়ে রিপ্লেসড হচ্ছে। — আরেকটা কুটিল চিন্তা মাথায় আসছেঃ এই লেখাটা হয়ত অনেকেই পড়বে; দেখিই না তারা কি মন্তব্য করে!! — আচ্ছা আমিই শুধু এমনটা ভাবছি, নাকি আরো অনেকেই এমনটা ভাবেন?? — ধুর!! কি হবে এত কিছু ভেবে!!

এখন রাত তিনটা বেজে পাচ মিনিট। ঘুম ভালমতই ছুটেছে। মেয়েটা পাশে ঘুমালে হয়ত তাকে জড়িয়ে ধরতাম। তখন আবার নিশ্চয়ই বুকটা হুহু করে উঠত। কষ্টের ভাল লাগা! কিংবা, ভাললাগার কষ্ট! মেয়ের মায়ের কথাঃ “মেয়েদের বড় হতে সময় লাগে না”।

গানটা নিশ্চয়ই অনেকেই শুনেছেন, “কেন পিরীতি বাড়াইলা রে বন্ধু, ছেড়ে যাইবা যদি”!!!

— রাত তিনটা উনিশ মিনিট

৬,১৫৪ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “বকবকানির বাকবাকুম”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ভাই, এটা স্বার্থপরতা নয়। পিতৃত্বের অনুভূতি।
    সম্ভবত সব বাবা'র অনুভূতিই আপনার মত!
    যাই হোক, এসব মায়া-মমতার বাঁধনকে বড্ড ভয় পাই। তাই যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করি...
    আপনার এবং আপনার পরিবারের সকলের জন্য রইল অনেক অনেক শুভ কামনা!


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।