এ ট্রিবিউট আফটার দ্যা ফাদার্স ডে
সোলায়মান চাচাকে আমি দীর্ঘদিন থেকে চিনতাম। লাবু ক্লাস সেভেন এবং এইটে, ১৯৮৮ এবং ১৯৮৯-এ, রংপুর ক্যাডেট কলেজের ওমর ফারুক হাউজের ৩১২ নম্বর রুমে আমার রুমমেট ছিল। আশ্চর্যজনক কো-ইন্সিডেন্স হলো আমার বাবা এবং লাবুর বাবা তাদের টিন-এইজে ঠাকুরগাঁ হাইস্কুলে রুমমেট ছিলেন। বাবার মুখে শুনেছি সোলায়মান চাচা খুব ভাল ফুটবল খেলতেন। লাবুও ভাল ফুটবলার। ১৯৯৩ সালে ‘ইন্টার ক্যাডেট কলেজ ফুটবল মিট’-এ লাবুর ফুটবলের চমৎকারিত্ব কখনো ভোলার নয়। একেই বোধহয় বলে, ‘লাইক ফাদার, লাইক সান’। কিছুদিন আগে লাবু যখন ফোনে তার বাবার এক্সট্রিম ডায়বেটিক সমস্যার কারনে একটা পা কেটে ফেলার সংবাদটা আমাকে দেয়, আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যে ‘পা’ একসময় মাঠ ভরা দর্শকের মন জয় করেছে, সেটাকেই ডাক্তারদের কেটে ফেলতে হলো। একেই কি বলে, ‘আয়রনি অফ ফেইট’ কিংবা ‘আয়রনি অফ লাইফ’!
কদিন থেকেই আমি আর বাবা সোলায়মান চাচাকে হাসপাতালে দেখতে যাব-যাব করছিলাম, কিন্তু আমার ব্যস্ততার কারনে হয়ে উঠছিল না। আমার এই ব্যস্ততার কারনেই আমি বাবাকে তার হাইস্কুলের বন্ধুর সাথে দেখা করাতে নিয়ে যেতে পারিনি। সন্তান হিসেবে নিজেকে বেশ তুচ্ছ মনে হচ্ছে। ২৩শে জুন সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে আমাদের ইফতার প্রায় শেষ, ঠিক সেই সময় লাবুর ফোন পেয়ে বেশ ঘাবড়ে গেলাম; আমার আশংকাই ঠিক হলো। বাবা সেসময় আমার পাশেই বসা। বাবাকে সেই মুহূর্তে ঢাকা সিএমএইচে নিয়ে গিয়ে তার প্রানহীন বন্ধুকে দেখানোর মনের জোর আমার সেদিন আর হয়নি। আমি শুধু ভাবছিলাম, বাসায় সবাই মিলে যেখানে আমরা আয়েশ করে ইফতার করছি, সেই মুহূর্তে লাবু এবং তার পরিবার কিভাবে ইফতার করছিল!
ঢাকা সিএমএইচে গিয়ে আমি লাবু এবং তার মায়ের বেশ শক্ত মনোবল দেখলাম। আসলে পরিস্থিতিই তাদের শক্ত করেছে। সোলায়মান চাচা তার সর্বশেষ ম্যাসিভ কার্ডিয়াক এ্যারেস্টের পরে টানা এগার দিন আইসিইউ-তে ছিলেন। কাজেই এই পরিবারটির শক্ত না হয়ে তো আর কোন উপায় নেই। এরই মধ্যে আমার কাছে লাবুর মা আমার বাবার শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নিলেন। লাবুকে আমি লাবনি আপার কথা জিজ্ঞেস করলাম; জানলাম তিনি দিনাজপুরে; বাবার মৃতদেহের জন্য সেখানে তিনি অপেক্ষায় আছেন। বাবার দুলালি তার নিস্প্রান বাবাকে শেষবারের মত দেখার জন্য সুদূরে অপেক্ষমান – এ চিন্তা বড়ই অসহনীয়।
আমি লাবুর স্ত্রী কান্তার সাথে কথা বলার মত মনের জোর পাচ্ছিলাম না। কিছুদিন আগেও কান্তার সাথে ফোনে কথা হয়েছিল; তার শশুরের স্বাস্থ্যের অবনতি নিয়ে সত্যিকারর্থেই সে বেশ দৌড়াদৌড়ি এবং মানিষিক চাপের মধ্য দিয়ে গেছে। লাবু-কান্তার একমাত্র ছেলে শামীমকে যখন মরচুয়ারিতে তার দাদার সামনে নেয়া হলো, এক হৃদয় বিদারক অবস্থা ছিল। নিস্প্রাণ দাদুকে কফিনে দেখে প্রাইমারি স্কুল পড়ুয়া এই বাচ্চাটার কান্নার দৃশ্যটা সহ্য করার মত ছিল না। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা, সোলায়মান চাচার বিদেহী আত্মা শান্তি পাক, এবং এই পুরো পরিবারের সবাই নিজেদের শক্ত রাখুক। রাত সোয়া দশটার দিকে ঢাকা সিএমএইচ থেকে দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে তাদের রওনা দেয়ার মুহূর্তে আমার যথেষ্ট শক্ত-সামর্থ বন্ধু লাবু, ৩৬ বিএমএ লং কোর্সের মেজর সালাহউদ্দিনের কান্নার দৃশ্যটা কিছুতেই মন থেকে মুছতে পারছি না। মন থেকে এই মুহূর্তে এটাই চাওয়া, পরমকরুণাময় সবার সহায় হন।
দীর্ঘ কর্মজীবনে সোলায়মান চাচা দিনাজপুরের বীরগঞ্জ কলেজের পদর্থবিজ্ঞানের একজন জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। আমার বাবা তাঁর এই বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমাকে এক পর্যায়ে বললেন, তাঁর উত্তরবঙ্গের বন্ধুদের মধ্যে যাঁরা বীরগঞ্জ কলেজে কর্মরত ছিলেন, তাঁদের প্রায় সকলেই দূনিয়া ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। এই কথাগুলো বলার মুহূর্তে বাবার অভিব্যক্তিগুলোকে আমি ঠিক ভাষায় আনতে পারছি না।
আমাদের অনেকেরই মা-বাবা দূনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। কেউ ‘মা’ হারিয়েছেন, কেউ হারিয়েছেন ‘বাবা’। এর মধ্যে যাদের পরিবারে মুরুব্বীরা এখনো আমাদের মাঝে আছেন, তাঁরা প্রায় কম-বেশি সকলেই বিভিন্ন রকমের শারীরিক রোগ-জটিলতায় ভুগছেন। মা-বাবা-রা যাঁরা আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন, বিধাতা যেন তাদের পরলৌকিক জীবনকে শান্তিময় করেন। আর যাঁরা এখনো আমাদের ছায়া দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা যেন সুস্বাস্থ্য ও আনন্দের সাথে দীর্ঘায়ু লাভ করেন।
সেই রাতে বলা লাবুর কিছু কথা কানে যেন বেজেই চলেছে, “মা-বাবা-কে একলা কোথাও ছাড়বি না তোরা কেউ। তোদের মা-বা-কে সংগ দেবার সুযোগ আছে। এই সুযোগ হাতছাড়া করিস না”।
চমৎকার হয়েছে লেখাটা, লাবুর কথা গুলো বুঝতে বেশি দেরি করা যাবেনা।
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
ঠিকই বলেছেন ভাইয়া
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
লিখে যাও, আমরা পড়ছি!
দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ
মানের চাপ ভেন্টিলেট করার উদ্দেশ্যে লেখা, ভাইয়া!
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
মন বড্ড ভারাক্রান্ত করা লেখা । আমাদের অনেকেই পারে তবু অনেকেই পেরে ওঠে না সময়ে বুঝতে আর সেই মতো বাবা-মাকে সময়-সান্নিধ্য দিতে ।
আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি ভাইয়া।
দোয়া করবেন।
লাবু ওর সামরিক জীবনের বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং হওয়া সত্বেও চেষ্টা করে গেছে। আমার আরো বেশ কয়েকজন বন্ধুকে দেখছি দূরে থাকা সত্বেও পরিবারের মুরুব্বীদের চিকিতসার জন্য যথেষ্ট সময় দেবার চেষ্টা করেছে। ইদানিং বেশ কয়েকজনকে দেখছি পরিবারসমেত মা-বাবা-র সাথেই থাকছে।
সবাই ভাল থাকুক!
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
কি নিদারুন লেখা ! কি কঠিন বাসতবতা !
বাস্তবতা বড়ই নির্মম।
Truth is stranger than fiction.
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম
"বাবার দুলালি তার নিস্প্রান বাবাকে শেষবারের মত দেখার জন্য সুদূরে অপেক্ষমান – এ চিন্তা বড়ই অসহনীয়" - স্পর্শ করে গেলো এ কথাগুলো।
লাবুর কথাগুলো নাড়া দিয়ে গেলো।
সুন্দর লেখা, যথার্থ শিরোনামে।
ধন্যবাদ ভাইয়া!
আমিও যে এক মেয়ের বাবা!
চ্যারিটি বিগিনস এট হোম