বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও
এর মধ্যে বেশ কয়েকদিন এই ব্যপারটা ঘটেছে। মনে বেশ দোলা দিয়েছে। পুরোনো স্মৃতির নতুন দোলা। কাকতালিয়ভাবে পরপর কয়েকদিন দেখি ঘড়িতে ৬টা বেজে ২৮ মিনিট। অর্থাৎ ৬.২৮ বাজে। আমার ক্যাডেট নম্বর ৬২৮। খুব স্বাভাবিক ভাবেই মনের অজান্তে ক্যাডেট কলেজের অনেক স্মৃতি স্ট্রীম অফ কনশাসনেসের মত একে একে ভেসে আসে। আর এটাই তো স্বাভাবিক! আমার মনে হয় ঘড়ির কাঁটার সাথে নিজের ক্যাডেট নম্বরের মত এমন চিরসঙ্গির সঙ্গতি দর্শনে আমার মত যে কোন ক্যাডেটের মন আলোড়িত হবে। না হওয়াটাই তো অস্বাভাবিক, তাই না?
আজ (শনিবার, ২৯ নভেম্বর ২০১৪) দুপুর ১২টায় আন্ডারগ্র্যাজুয়েটের ফাইনাল সেমিস্টারের সাথে Modes of Literature কোর্সের ক্লাশ ছিল। আজকের বিষয় ছিল Thematic Pattern of Ironic Mode, যেখানে মডেল এক্সাম্পল হিসেবে Percy Bysshe Shelley-র Ozymandias সনেটটা পড়ানো হবে। J Bard McNulty-র Modes of Literature বইটাতে এই কবিতাটা আছে। ক্লাশে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কবিতাটা যেন কোন পৃষ্ঠায়? কেউ একজন বলে উঠল, স্যার পেইজ নম্বর ৬০৩। বুকের ভিতর টা ছ্যাঁত করে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালাম।
রংপুর ক্যাডেট কলেজের ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত অবস্থানকালীণ সময়ের ১৪তম ব্যাচের তিতুমীর হাউজের আমাদের ক্যাডেট রহমানের ক্যাডেট নম্বর ৬০৩। ৬০৩ … ৬০৩ … ৬০৩ … অনেক্ষণ ধরে মাথার ভিতরে নম্বরটা ঘুরপাক খেল। বি.আর.ডি.বি.-এর ডেপুটি ডিরেক্টর হাবিবুর রহমান। একটা ব্রেইন স্ট্রোক … জাস্ট একটা মারাত্মক ‘ইসকেমিক স্ট্রোক’ … তারপর! তারপর! তারপর কি? একেবারে ‘অল্পবিরাম’। যাকে মেডিক্যাল টার্মে বলা হয় ‘কমা’। মাসের পর মাস ধরে আমাদের বন্ধু ক্যাডেট রহমান কমায় পড়ে আছে। রংপুর ক্যাডেট কলেজের ইতিহাসের একমাত্র ৬০৩। ৬০৩ … ৬০৩ … ৬০৩ …
আর ভাবতে পারছিলাম না। আসলে মনে হয় ভাবতে চাচ্ছিলাম না। ক্লাশে মনোযোগ দিলাম। আসলেই কি মনোযোগ দিতে পারছিলাম? আসলেই কি পড়াতে পারছিলাম? কি সুন্দর পড়ানোর অভিনয় করে গেলাম! নিজেকে সার্কাসের জোকার মনে হচ্ছিল। ঘরে যত কান্নার রোলই পড়ুক না কেন, জোকার সার্কাসে হাসিয়েই যায়। আমার মনে হয় এই হাসাতে-হাসাতে সে নিজে কষ্ট পেতেও ভুলে যায়। অথবা, হয়তো কষ্ট পাওয়ার তার সময়ই থাকে না। অথবা, এমনও হতে পারে যে, কষ্ট তার কাছে বিলাসিতা। কি বললাম? বললাম, বি-লা-সি-তা। বিরাট এক বি-লা-সি-তা । জোকারের জন্য তো কষ্ট পাওয়া অনুচিত, তাই না? যেমন মাষ্টারের জন্য – প্রাণের অতল গহবরে যাই চলুক, ক্লাশে পড়িয়েই যেতে হতে, নইলে যে টাফ-গাই মাষ্টার মশাইয়ের ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে। নিজেকে কি আসলে ‘জোকার’ নাকি ‘হিপোক্রিট’, কি আখ্যা দেয়া যায়, তাই ভাবছি।
কয়েক মাস আগে ৬০৩-এর অসুস্থতার শুরুর দিকে ক্যাডেট কলেজ ব্লগে একটা লেখা দিয়েছিলাম।
লিংকঃ http://www.cadetcollegeblog.com/pialbd/44384
আজ আবার একই প্রসঙ্গ। মাঝের এই কটা মাসে আমার এই ফিলিংস কোথায় ছিল? এতই ব্যস্ত আমি! এতই ব্যস্ত আমরা!
এর মাঝে গত সপ্তাহে কোন এক ছুটির দিনে বেশ সকাল-সকাল মোবাইল ফোনের আওয়াজে ঘুম থেকে জাগতে হলো। আমাদের আগের ব্যাচের – ১৩তম ব্যাচের – ফয়েজ ইসলাম ভাইয়ের ফোন। বাংলাদেশ নেভীর কমাণ্ডার ফয়েজ ইসলাম। গিটার হাতে মঞ্চের হীরো আমাদের ইসলাম ভাই।
– পিয়াল, তোকে সকাল-সকাল জাগালাম। আচ্ছা রহমানের কি খবর?
– আগের মতই আছে ভাইয়া। কোন পরিবর্তন নাই। অনেক শুকিয়ে গেছে।
– আচ্ছা, ওর ওয়াইফের ব্যাংক একাউন্ট নম্বরটা দিতে পারবি?
– পারব ভাইয়া, আমি আপনাকে পরে জানাচ্ছি।
তারপরে কি হলো? কয়েকটা দিন পার হয়ে গেল। আমিও কাজের মাঝে ডুবে গেলাম। বেমালুম ভুলে গেলাম ইসলাম ভাই তাঁর এতবড় এসাইনমেন্টের চাপের মাঝেও শুধুমাত্র এক জুনিওর ক্যাডেটের পাশে দাঁড়াতে চাচ্ছেন। আর আমি? ছি! নিজের প্রতি ঘৃণা যে কতটা কষ্টকর তা জীবনে ক’বার উপলব্ধি করেছি ঠিক মনে পড়ছে না। তবে আজ টের পেয়েছি। যখন থেকে বইয়ের ৬০৩ নম্বর পৃষ্ঠাটাতে চোখ পড়েছে, তখন থেকে এখন পর্যন্ত সাঙ্ঘাতিক রকমের একটা মানসিক যন্ত্রনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ৬০৩ ভাবীকে ফোন দিলাম। তিনি খুব সাবলীল ভাবে ফোন রিসিভ করলেন। সালাম দিলেন। আমার বাসার সবার খোঁজ খবর নিলেন। তিনি বোধহয় কষ্টের মাঝে মিশে গেছেন। কষ্ট যার নিত্যসঙ্গী – এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে দুটো ছোট-ছোট বাচ্চা নিয়ে যার সকাল-বিকাল-রাত সব একাকার, তার বোধহয় নতুন করে কষ্ট পাওয়ার আর কিছুই বাকি থাকে না। আমি লজ্জায় ছোট হয়ে গেলাম। নিজের উপরে ঘৃণা আরো তীব্র হলো। তীব্র ঘৃণা! এ যে কি যন্ত্রণা বোঝাতে পারছি না।
– ভাবী আপনার নাম আর একাউন্টস ডিটেইলসটা একটু কাইণ্ডলি এস.এম.এস. করে পাঠাবেন।
– ভাই, আমি তো বাচ্চাদের খাওয়াতে বসেছি। একটু দেরী হবে ভাই।
রাতে ৬০৩ ভাবী এস.এম.এস.-এ তাঁর নাম এবং ব্যাংক একাউন্টস ডিটেইলস জানালেন। বাংলাদেশ নেভীর কমাণ্ডার ফয়েজ ইসলাম ভাইয়াকে এস.এম.এস.-টা ফরওয়ার্ড করলাম। ভাইয়ার সাথে ফোনে কথাও হলো। লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে কথা বললাম।
লজ্জা কাকে বলে! আমি আজ উপলব্ধি করলাম। পৃথিবীর বুকে নিজের কাছে পাওয়া লজ্জা যে কতটা পাশবিক, কতটা ভয়ঙ্কর, কতটা নির্মম – আজ টের পেলাম। ঠিকই আছে! আমার মত স্বার্থপর মানুষের জন্য এটাই হয়তো দরকার ছিল।
কদিন আগে কোথায় যেন পড়লাম, মৃত্যুর পরে মানুষ হয়ে যায় ‘লাশ’ কিংবা ‘বডি’ – নাম ধরে তাকে আর কেউ তখন ডাকে না। আর এখন আমাদের ক্যাডেটদের অবস্থা গিয়ে দাঁড়িয়েছে একটা নিউমারিক আইডেন্টিটিতে। এ’এক আজব পরিচয়। জাস্ট একটা নম্বর। আজ ৬০৩ … নম্বর দেখে সৃতিতে জাগরুক হওয়া এক বন্ধুর মুখ। অনেকদিন তাকে দেখতে যাইনি। এখন আর সাহসেও কুলায় না। শুকিয়ে নাকি একসার হয়ে গেছে। আমি আর ভাবতে পারছি না।
আজ ৬০৩-এর জন্য শুধু দোয়াই করে যাচ্ছি। কিন্তু আসলে ‘কি’ দোয়া করছি? কোন মিরাকেলের দোয়া করছি? নাকি, যেটা সবার জন্য ভাল, সেটারই দোয়া করছি। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, ৫৯৯ থেকে ৬৪৮ (মাঝের ৬০৩ বাদে) সবাই ওর জন্য হয় একটা মিরাকেলের অপাক্ষায় আছে; অথবা হয়তো মনের অজান্তেই মহান স্রষ্টার হাতে তাকে ছেড়ে দিয়ে সবার জন্য যেটা ভাল সেটাই চাইছে। এ’বড় জটিল দোয়া, জটিল চাওয়া! এর কোন ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা করা সম্ভবও না।
আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, আমাদেরই কেউ একদিন ৬২৮ নম্বরটা দেখে আমাকে নিয়ে এমনই করে ভাববে। যেদিন আমার আবস্থা … … … আমার অস্তিত্ব … … … আমার পরিচয় … … …
দোস্তো ৬০৩, লাইনটা আজ খুব মনে পড়ছে রে! ‘বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও’। আমাকে চিনে রাখ দোস্তো … … … স্বার্থপরের নমূনা হিসেবে চিনে রাখ।
রহমান ভাইয়ের জন্য অনেক দোয়া থাকলো...
মুক্তি হোক আলোয় আলোয়...
..........
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
লিখাটা পড়ে গিয়েছি দিন দুয়েক আগেই কিন্তু কি লিখবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এখনো পারছিনা। আপাতত এটাই লিখে গেলাম। 🙁
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
সুস্থ হয়ে উঠুন হাবিবুর ভাই।
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য
পড়লাম।
তোমার অনুভুতিটা অনুমান করার চেষ্টা করলাম।
লিখার মত আর কিছু খুজে পাচ্ছি না।
দুঃখিত।
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
কয়েকবারের নিষ্ফল চেষ্টাতেও বলার মত কিছু পেলাম না।
🙁 🙁 🙁
পুরাদস্তুর বাঙ্গাল