শবে বরাত আর নস্টালজিক আমি

১) তখন আমার বয়স হবে ৩ কি ৪ – স্পষ্ট মনে আছে হালুয়াতে ছাঁচ ফেলা হত। মাছের ছাঁচ, ফুলের ছাঁচ, কি জানি লেখা ছাঁচ – আরো হরেক রকম। আমাকেও দেয়া হত করতে। আমি করেছিলাম – ছাঁচের গায়ে হালকা তেল মেখে তারপর বুটের ডালের হালুয়া লেপে দিতে হয়। তারপর আস্তে আস্তে আলতো করে টিপে দিতে হয়। আর তারপর ছাঁচ থেকে সাবধানে আলাদা করলে কি সুন্দর ডিজাইন। আমার খাওয়ার চেয়ে দেখতে খুব ভাল লাগত – তাই আমি এসবকরার চান্স পেতাম। এখনও মনে মনে করি আর প্রতি শবে বরাতে আম্মুকে জিজ্ঞেস করিঃ আম্মু হালুয়া বানানোর ছাঁচগুলো কই?

২) তখন আমার বয়স ৬ কি ৭ – এবার অনেক ধর্ম কর্ম শিখে ফেলেছি। অনেক সুরা মুখস্থ জানি। আমার একটা মোটকা হুজুর ছিল – তিনি এত আদর করতেন যে আমি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে আরবী শিখে ফেলেছিলাম। ওই বয়সে একডজন সুরা মুখস্থ বলতাম – লিখে দিতেও পারতাম। কিন্তু শবে বরাতে এলো অনেক বড় বড় সুরা। অনেক বড় বড় নামায। আমি সেই বয়সে ‘আমলে নাজাত’ একটা বই পড়ে খুঁজে খুঁজে বের করেছিলাম ৪ রাকাত নামায প্রতি রাকাতে ৫০ বার সুরা ইখলাস পড়তে হবে। আমি চ্যালেঞ্জ নিলাম। প্রথম সাহস করা, মনে যে কি সরলতা ছিল বোঝাতে পারবো না। এইটুকু বলতে পারি – আমি আল্লাহর একজন একনিষ্ঠ বান্দা হব এটা আমার নিয়ত ছিল। তারপর কিযে পরিশ্রম মনে হল। আমার পা মশা কামড়ে ঝি ঝি ধরিয়ে দিল। আমি তবুও নড়ি না। ঠিক ঠিক পড়ে ফেললাম। এরপর সুরা ইয়াসিন – সুরা আর রাহমান – কি বিশাল বিশাল সুরা – ধরলে শেষ হয় না। এত কিছু মানুষ পড়ে। আমি কেন পারবো না? সে সময় সুরা আর রাহমান কে ভালবেসে ফেললাম। এখনও ভালবাসি। তখন ভাল লেগেছিল, দোয়ায়ে গাঞ্জুল আরশ। এরপর একটা সিজদা আর মন থেকে দোয়া চাইতে হবে। কি চেয়েছিলাম মনে নাই। কিন্তু প্রচন্ড তৃপ্তি পেয়েছিলাম। সাধনা করতে পেরে নিজের ছোট্ট জীবনকে তখন ধন্য মনে হল। আর এত গুলা বছর পেরিয়ে আজকের এই ২০১৩ সালে সেই ছিড়াবিড়া ‘আমলে নাজাত’ বইটা থেকে সেই পৃষ্ঠার নামায বের করে আমি ঠিক একই ইবাদাত করলাম, একই সুরা পড়লাম, একই দোয়ায় গাঞ্জুল আরশ। এবার খুব সোজা লাগল। কিন্তু মনটাকে সেই বয়সে ফেরাতে চেষ্টা করলাম।

৩) তখন আমার বয়স ১২ কি ১৩ – এমন এক জায়গায় পড়াশোনা করতাম যেখানে সব যেন নিয়মকেন্দ্রিক। ক্যাডেট কলেজে আমি যেন অনেক বেশী দুষ্টু ছিলাম। আর দুষ্টু বন্ধুরাতো ছিলই। শবে বরাতের রাত – সন্ধ্যায় মসজিদে কোরান তেলাওয়াত প্রতিযোগিতা হবে। হামদ ও নাথ ও ছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমাদের বন্ধু আসাদ ফার্স্ট হয়েছিল। আমরা খুশীতে হাততালি দিয়ে ফেলেছিলাম। পড়ে আমাদের সিনিয়র রেজা ভাই ক্যাচ ক্যাচিয়ে জানিয়ে দিলেন যে – হাত তালি হবে না – বলতে হবে “মারহাবা! মারহাবা!” আগেই বলেছি দুষ্টু বন্ধুছিল। ব্যাস এবার মারহাবাটা আমাদের দুষ্টামির বিষয় হয়ে গেল। দুষ্টু রায়হান – দুষ্টু আমি আর আমাদের দুষ্টামীর সর্দার ছিল ওয়াদুদ। যখন মিলাদ চলছিল তখন আমরা মনে হয় ফকির সেজে ফাজলামো করছিলাম আর খুব হাসছিলাম। ওয়াদুদের ক্রিমিনাল বুদ্ধির ফাঁদে আমরা দুইজন লুটোপুটি খাচ্ছিলাম। পড়ে রেজা ভাই যখন বললেন, “ক্লাস সেভেন গেট আপ এক্সেপ্ট ওয়াদুদ – রায়হান – শামীম” – তখন বুঝলাম আমাদের বরাতে আর মাইর আছে। তাই ছিল। মসজিদ থেকে ডাইনিং হল পর্যন্ত ফ্রন্টরোল। আহা খুব মজা। ডিগবাজি দিতে হবে। আমি খুব মজা পেতাম। পানিশমেন্ট খাচ্ছিলাম সত্যি কিন্তু সর্দার ওয়াদুদ যখন ডিগবাজি দিতে দিতে ইয়া নাবী সালা-মালাইকা বলা শুরু করল, আমি আর রায়হান মনে হয় হাসি থামাতে পারি নাই। পানিশমেন্ট মাত্রা বেড়ে গেছে ঠিক – হাসি থামে নাই। হায় সেই সময়টা।

৪) তখন আমার বয়স ১৪ কি ১৫ – পাড়ার মসজিদে যাবো শবে বরাতের নামায পড়তে। সাথে বন্ধু ছিল মুন্না আর শিবলী। নামায শেষে আমি খুব খুব কান্না করেছিলাম। প্রতি শবে বরাতে আমার কেমন যেন বুক ফাটা কান্না পায়। বোঝাতে পারবো না কেন কান্নাটা পায়। কাঁদতে খুব ভাল লাগে। অনেক হালকা হওয়া যায়। মুন্না শিবলী একটু নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল। পড়ে আমরা ফারুকের বাসায় গিয়েছিলাম। সেখান থেকে বিভিন্ন মাজারে যাবার প্ল্যান ছিল। প্ল্যান ছিল সারারাত ঘুরবো তারপর ফিরবো বাসায়। সেটা আর হয় নি। আমার কখনই শবে বরাতের রাতে মাজারে মাজারে ঘোরা হয়নি। কিন্তু খুব ইচ্ছা হয়। এত সুন্দর করে সাজায় – যেন মনে হয় আজকে আমার দোয়া নেবার জন্য কবর বাসীরা সেজে দাঁড়িয়ে আছে। আস সালামু আলাইকুল ইয়া আহলাল কাবুরুল বলা মাত্রই যেন আমি জবাব শুনতাম – ওয়ালাইকুম আস-সালাম। আওয়াজটা আমার ইলুশান কিনা জানি না। কোরাস ভয়েসের মতন – মিলাদের সম্মিলিত আওয়াজের মতন। আমার খুব ভাল লাগত, আমি তাদের জন্য কাঁদতে চাইতাম। কিন্তু চাওয়াটা এমন হবে ভাবিনি – ঠিক আজকে আমি কেঁদেছি ২০১৩ সালে – আমার আব্বুর কবরের সামনে। জিয়ারাত করতে গিয়ে দেখি আব্বু আমার দোয়া নিতে সেজে আছে অপেক্ষায়, কি সুন্দর মরিচ বাতি দিয়ে – পিট পিট করে জ্বলছে কবরস্থান। আমি সালাম দিতে আব্বুও সালাম দিলো। বললোঃ “আমার জন্য কি এনেছিস বাবা?” কি নিয়ে যাবো আব্বুর জন্য? আমার বুকফাটা কান্না ছাড়া আর কাঁপা কাঁপা হাতে দোয়া ছাড়া। অনেক কষ্টে আমতা আমতা করে দোয়া করেছি। এইটুকুতে আব্বু যে কি খুশী হয় আমি কাউকে বোঝাতে পারবো না। সত্যি আমি দেখেছি কিন্তু বোঝাতে পারবো না। আল্লাহর কাছে আব্বু ভালই আছেন এটা আমি সব সময় ভাবি।

৫) আমার জীবনে এ বয়স পর্যন্ত শবে বরাত অনেক ঘটণাময় – অনেক অনেক শিশু-পবিত্র – অনেক অনেক ভালবাসার। আমি আমার বাকী জীবনে অনেক সুন্দর ও পবিত্রময় শবে-বরাত চাই। আমার জন্য দোয়া করবেন।

১,২৩৭ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “শবে বরাত আর নস্টালজিক আমি”

  1. মুশফিকুর রহমান তুষার (২০০২-২০০৮)

    :clap: :clap:

    ধর্মীয় গুরুত্ব কিরকম আছে জানিনা! তবে শবে বরাত আমাদের দেশে বেশ আনন্দের একটা উপলক্ষ্য! আতশবাজি-তারাবাতি'র কথা মনে পড়ে গেলো!


    ছোট হাতি

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    শবে বরাত নিয়ে আমার শিশু-পবিত্র স্মৃতির ঝুলি খুব বেশি নাই, একদম ছোটবেলায় সব বাচ্চারা এক সাথে মিলে কম্পিটিশন দিয়ে নামাজ পড়তাম তবে একটু বড় হতেই শবে বরাত মানে তারাবাতি, মুররা (মরিচা) আর চকলেট বোমে বদলে গিয়েছিল। দুই তিন সপ্তাহ আগে থেকেই মুররা গরুর ঝিল্লি রোদে শুকানোর মাধ্যমে শুরু হতো প্রস্তুতি, তারপর হরেক পদের মুররা আর চকলেট বানানো শুরু আর বড় ভাইদের ম্যানেজ করে চকবাজার থেকে কিছু রেডিমেট পটকা আনা। এসব নিয়ে শবে বরাতের সন্ধ্যার পর থেকেই বিভিন্ন ধরনের বাদঁরামির শুরু, মাঝে মাঝে বাসায় বাসায় গিয়ে হালুয়া রুটি।। আহা, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    গঞ্জে আরশ বা গাঞ্জুল আরশ?

    শবে বরাতের রাত আসলেই আনন্দের রাত বাংলাদেশের পাবলিকের জন্য।
    যদিও এখন পাবলিক একে বেদাত বলে।

    বেদাত হোক বা না হোক মজার ছিলো নিঃসন্দেহে।

    একে বরং বেদাতুল হাসানা বলে চাইয়ে দেয়া যেতে পারে।

    এরকম শবে বরাতের রাতেই তো ডাকাত সন্দেহে বেশ কয়েকজন কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিলো।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  4. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আর রাহমান সূরা আমারো ভালো লাগে।
    তুকাযযিবানের পৌনঃপৌনিকতা বেশ লাগে।
    ক্যামন সুরের খেলা মনে হয়।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।