স্বপ্নহন্তা

ক্লাস নাইনে উঠেছি কেবল। জানুয়ারি মাস হবে। বুঝলাম আমাকে কেউ ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এক অল্টারনেট সিনিয়রের কাছে। বুঝতে হল কারণ, কোন প্রমাণ ছিল না। কেউ জানে না কে বলেছে, কিন্তু আমাদের হাউজের জনৈক অল্টারনেট সিনিয়র জেনেছেন, আমার হাতের লেখা নাকি ভাল। অল্টারনেট সিনিয়ররা তখন এসএসসি ক্যান্ডিডেট। পরীক্ষার চাপ আর রচনা নোট করার কাল। নোটের কাজটা আমাকে দিয়ে সারিয়ে নিতে মনস্থ করলেন তিনি। একটা বড় সাইজের কলেজ খাতা ধরিয়ে দিলেন, আর সাথে দিলেন উনার আরেক ক্লাসমেটের খাতা। এ খাতা থেকে ও খাতায় তুলতে হবে। কম করে হলেও ১৫টা রচনা।

তখন থেকেই আমার বাতিক ছিল, দায়িত্ব পেলে আর করতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু, সেটা তো না করে উপায় নেই। সিনিয়রের কাজ, তার উপর অল্টারনেট সিনিয়র। উল্লেখ্য, আমাদের কলেজে অল্টারনেট ব্যাচগুলোতে সম্পর্ক থাকতো সবচেয়ে খারাপ। কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার তিন মাস আগে তা ঠিক হতো। যাহোক, নাক মুখ চেপে লেখা শুরু করলাম। ইচ্ছামতো লিখেছি, খুব খারাপ মনে না হলেই হলো। তা-ও মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড তো মনে চলতেই হয়েছে। আমার জীবনে সবচেয়ে দুঃসহ স্মৃতি সেটা নয়। কিন্তু এই স্মৃতিই জন্ম দিল সবচেয়ে দুঃসহ স্বপ্নের।সেই সিনিয়রের খাতা বুঝিয়ে দিয়েছি এক মাসের মধ্যেই। তারা পরীক্ষা দিয়ে তিন মাসের ছুটিতে চলে গেছেন। ছুটি শেষে আবার ফিরে এসেছেন। টার্ম গিয়েছে একের পর এক। এভাবেই একটি বছর কেটে গেছে। আমরা তখন ক্লাস টেনে, আর অল্টারনেটরা ইলেভেনের শেষ দিকে। এমন একটা সময়েই স্বপ্নটা দেখেছিলাম। আমার লাইফে দেখা সবচেয়ে দুঃসহ স্বপ্ন। সরাসরি স্বপ্নের বর্ণনায় চলে যাচ্ছি, সাবধান!!!!!!!!! —-আমাদের হাউজের (নজরুল হাউজ) ছাদের রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছি আমি, সাথে আরেক ক্লাসমেট। ঠিক সামনে দণ্ডায়মান সেই অল্টারনেট সিনিয়র, আমাকে দিয়ে যিনি রচনা লিখিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হল, পুরো ছাদেই রেলিং আছে অথচ উনার সামনে কোন রেলিং নেই। স্বপ্ন যেমন হয় আর কি। কি কথা বলেছিলাম বা আমার সাথের সেই ক্লাসমেটটি কে তার কিছুই মনে নেই। থাকার কথাও নয়, যা দেখেছি তার পর অন্য কিছু মনে থাকবে কিভাবে? হঠাৎ কি মনে করে জানি সিনিয়রটিকে ধাক্কা মারলাম আমি। কেন ধাক্কা মেরেছিলাম সে কারণ মনে নেই, ধাক্কা মারার সময় কোন ক্ষোভও কাজ করেনি।আমি ছাদের উপর থেকে সভয়ে উনার পতন দেখছি, স্লো মোশন হয়ে গেছে, পাশের ক্লাসমেটটি আছে না নেই খেয়াল নেই। দোতলার ছাদ হলেও তখন মনে হচ্ছিল পাঁচ-ছয় তলার ছাদ। কিন্তু তিনি যখন কনক্রিটের রাস্তায় পড়লেন তখন মনে হচ্ছিল আমি যেন উনার পাশে দাড়িয়ে দেখছি। এই পতনের দৃশ্যটা প্রথম মর্মান্তিক ঘটনা। স্লো মোশনে কাঁচের গ্লাস পড়তে দেখেছেন প্রায় সবাই, পড়ে গিয়ে যেভাবে ভেঙে যায় ঠিক সেভাবেই উনার মস্তিষ্ক এবং পুরো দেহ ভেঙে গেল। একেবারে লাইভ মৃত্য দর্শন তার উপরে আবার স্লো মোশনে। বাস্তবে এমনটি দেখা কখনই সম্ভব নয়, যদি না বাস্তব ঘটনা স্লো মোশন করে দেয়ার যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। বলে বোঝানো যাবে না ভেঙে যাওয়ার সে দৃশ্য।

এ পর্যন্ত আমার মন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, মরণ দৃশ্যটি। পুরো ভেঙে যাবার পর ধাতস্থ হতে হল বাধ্য হয়েই। আর তখনই মনে এল খুন করার দুঃসহ অভিজ্ঞতা। ধাতস্থ হয়েই বুঝতে পারলাম এই কুচ্ছিত মৃত্যুর জন্য দায়ী আমি। আমি খুনি। কিভাবে বিচার হবে বা কিভাবে কি হবে তা মাথায় ঢোকার প্রশ্নই ওঠে না। আমার মধ্যে কেবল, খুনির প্রতিচ্ছবি যা আমি নিজেই দেখছি। খুন করলে আসলেই তেমন লাগে কি-না জানিনা। তবে যেমনটি লেগেছিল তার চেয়ে দুঃসহ জীবনে আর কখনও লেগেছে বলে মনে পড়ে না। এই অদ্ভুত ভয়ংকর অভিজ্ঞতা সামলে জীবন বাঁচানোর পরিকল্পনা শুরু করাটাই হয়তো স্বপ্নের পরবর্তী শট হতো। কিন্তু তার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। পুরো স্বপ্নটা সামলে উঠতেই কেটে গেল বাকিটা রাত।

ডিসক্লেইমারঃ এই অল্টারনেট সিনিয়রের উপর আমার এতোটা ক্ষোভের কোন কারণ নেই। সিনিয়রের লেখা তো এমন অনেকই লিখে দিতে হয়। কিন্তু স্বপ্নটা কেন জানি দেখলাম। বিষয়টা আসলে আমার হাতে নাই।

১,৬৩৬ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “স্বপ্নহন্তা”

  1. মাহফুজ (৯২-৯৮)

    ক্যাডেট লাইফ এর প্রথম তিন বছর সিনিয়রদের নোট লিখে গেছি, প্রাক্টিক্যাল খাতা লিখে দিয়েছি। আমি জানি এইটার কষ্ট কি, তাই কখনো কোন জুনিয়রকে দিয়ে করাইতে পারি নাই।

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    হাতের লেখা খারাপ হওয়া যে কত্তোবড় প্লাস পয়েন্ট তা কলেজে বহুবার উপলব্ধি করেছি 😀 😀 😀


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. রকিব (০১-০৭)

    হাতের লেখাও সুবিধার ছিলো না, ছবিও আঁকতাম ভয়াবহ রকমের। ফলে নোট কিংবা ছবি কোনটাই কোন সিনিয়র দিতেন না। :grr:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।