নীল অপরাজিতা

“ভালোবাসি”…
-আমাকে বলছেন?
-ইয়ে মানে,জ্বী,তোমাকেই।আসলে অনেকদিন ধরেই আমি বলবো বলবো করে বলতে পারছিলামনা।
-বলা নেই কওয়া নেই একটা অপিরিচিত মেয়েকে তুমি বলে বসলেন।ভাবেন কি আপনারা বলেন তো?একটা মেয়ে কে এসে ভালোবাসি বলে দিবেন আর অমনি সে খুশিতে গদগদ হয়ে আপনার প্রেমে পড়ে যাবে?
-না না কি বলছো!আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি।
-কি করেন আপনি?
-ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করেছি,নেভাল আরকিটেকচার থেকে,আপাতোতো বেকার।
-দেখুন এরপর আমাকে বিরক্ত না করলেই আমি খুশি হবো।
খানিকটা অপমানিত বোধ করলাম।এরকম প্রত্যাখ্যান এর জন্য বোধহয় প্রস্তুত ছিলামনা তাই।ঠিক কি কারণে অপরাজিতা এত হার্ড লাইনে গেলো আমি বুঝিনি।ওকে ভালোবাসি আজ নয়,২ বছর ধরেই।প্রথম দেখায় ভালোলাগা,কয়েক দেখায় ভালোবাসা।অপেক্ষাটা অনুমিতই ছিলো।নিজের পায়ে দাঁড়াতে তো হবে।মাটি খুঁজে পেলাম গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে,তবে চাকরি নেই এখনো,তাই ভিটাহীন ই বলা চলে।নিজেকে বোঝালাম,ও যা করেছে তাতে ভুল কিছু নেই।

১ মাস পর…
ক্লাসে ঢোকার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়ালো।নতুন টিচার ক্লাসে আসলে স্টুডেন্টরা স্বভাবতই তার পালস চেক করার চেস্টা করে।হলোও তাই।আমি বুঝতে পারছিলাম।ওরাও করছিলো।শুধু অপরাজিতা বাদে!ও আসলে এতটাই হতচকিয়ে গিয়েছিলো যে কি করবে বুঝতে পারছিলো না।সাধারণত ভারসিটির নতুন লেকচারার দের প্রতি স্টুডেন্টদের আলাদা আগ্রহ কাজ করে।আর তারাও বেশ ফ্রেন্ডলি হয়।আমার বেলাতেও ব্যতিক্রম হলোনা।আসলে ইচ্ছে করেই বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম ইউনিভারসিটির এপয়েনমেন্ট লেটার টাকে গ্রহণ করেছি।অন্তত ভিটা পাওয়া গেলো তো।
ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে অপরাজিতাকে লক্ষ্য করছিলাম,কেমন একটা নিষ্পাপ আর অপরাধী অপরাধী চেহারা করে বসে ছিলো।মন্দ লাগছিলো না ।ভালোবাসার মানুষ যখন স্টুডেন্ট!!!
ক্লাস শেষ করে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।হন্তদন্ত করে ছুটে এলো অপরাজিতা।
-স্যার আমাকে মাফ করে দিবেন।আমি আসলে…
-বুঝতে পারোনি যে আমি তোমাদের স্যার।আসলে কি জানো তখন আমি তোমাদের স্যার ছিলাম ও না।তো ছাত্রীকে তো তুমি ডাকাই যায় তাইনা?
খানিকটা লজ্জিত হলো ও
-ছি ছি স্যার আর লজ্জা দেবেননা। আপনার যা খুশি তাই ডাকতে পারেন।
কথা বাড়ালামনা।
-ধন্যবাদ।।
এরপর থেকে দেখতাম ক্লাসে সবচেয়ে মনোযোগী থাকতো অপরাজিতাই।এবং সব সময়ই আমাকে দেখলে সে একটা অপরাধী টাইপ হাসি দিয়ে যেতো।কিন্তু আমাকে এখন একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হতো।
অপরাজিতা দূরত্ব কমিয়ে আনার চেস্টা করতো।শিপ স্ট্রাকচার মোটামুটি সোজা সাবজেক্ট হবার পরেও মাঝে মাঝেই পড়া বুঝার জন্য আসতো ও।আমি আমার জায়গা থেকে মেইন্টেইন করতে লাগলাম।আমার খুব ইচ্ছা ছিলো এম এস টা বাইরে থেকে করার।সেটারও চেস্টা চালাতে লাগলাম।সত্যি বলতে কি অপরাজিতার জন্য আমার যে ফিলিংস কাজ করতো না তা নয়।তবে আমি খানিকটা অপমানিত বোধ করেছিলাম।কখনো কোনো মেয়েকে এভাবে সরাসরি প্রপোজ করিনি তো।তাই আঁতে ঘা লেগেছিলো।
ভালোবাসার জায়গাটা আলাদা,আর আত্মমর্যাদা অন্য জিনিস।দুটো মেশানো ঠিক নয়।

কিছুদিনের মাঝেই সুখবর পেয়ে গেলাম।নরওয়েতে আমার স্কলারশীপ হয়ে গেলো আল্লাহর রহমতে।তাই শিক্ষকতার সময়কাল ৬ মাস পেরোতেই শেষ হতে চললো।ক্লাসের কাউকে সেভাবে জানতেও দিইনি যে চলে যাচ্ছি।

অপ্রত্যাশিতভাবেই সেদিন অপরাজিতার ফোন এলো-
-স্যার আসসালামু আলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম সালাম,কেমন আছো অপরাজিতা।
-ইয়ে মানে ভালো স্যার।স্যার আপনি চলে যাচ্ছেন?
-ওহ হ্যা,সব ঠিক থাকলে হয়তো নেক্সট উইকেই তোমাদের সাথে শেষ ক্লাস হবে।
-স্যার,একটা কথা বলতাম।
-হ্যাঁ বলো অপরাজিতা।
-আপনাকে অনেক মিস করবো চলে গেলে।
-হা হা,তাই নাকি।তো হঠাত আমাকে মিস করবে কেন?
-আসলে স্যার হঠাত নয়।অনেকদিন থেকেই……
-অনেকদিন থেকেই??
-না মানে স্যার,আমিও আপনাকে অনেক পছন্দ করি।
–আমি জানি।
-জানেন স্যার,কিন্তু চলেই তো যাচ্ছেন।
-অপরাজিতা,শোনো একটা কথা।তোমরা আজকালকার মেয়েরা বড্ড আবেগী।আর তোমরা সেই আবেগ দিয়েও সব সময় সঠিক দিকে পরিচালিত হও না।
-স্যার আমি অনেক সরি যদি কষ্ট পেয়ে থাকেন।
-হা হা,একটা উত্তর দেবে?
-জ্বী স্যার বলেন।
-প্রথম দিনের কথা মনে আছে?
-স্যার আর কতো লজ্জা দিবেন?
-লজ্জা দিচ্ছি না।মনে আছে?
-জ্বী স্যার আছে।
-তুমিই ঠিক ছিলে।তুমি একটা বেকার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে।হয়তো জানোনা সেই জিদই আজ তাকে আল্লাহ মোটামুটি একটা ভালো জায়গায় যাবার পথ করে দিয়েছেন।তো তুমিও তো ভালো কিছু করতে চাও তাইনা?
-জ্বী স্যার অবশ্যই।
-আগামী মাসের ৫ তারিখ আমার ফ্লাইট।তোমার জন্মদিন।
-স্যার আপনি আমার জন্মদিনও জানেন!!
-হা হা।আরও অনেক কিছুই…সো …
-স্যার আমি আপনাকে ভালোবাসি…
-হা হা,আমি জানি…
-৫ তারিখ এয়ারপোর্টে এসো।দেখা হবে ইনশা আল্লাহ।
-ওকে স্যার ঠিক আছে।

বিদায়ের দিন ঘনিয়ে আসলো।অপরাজিতা এসেছে,নীল শাড়ি পড়ে।তার মানে আমার ফেইসবুক ঘেঁটে এটা ও জেনেছে যে নীল রঙ আমার প্রিয়।চলে যাবার আগে ওকে দেখছিলাম।খানিকটা বিমর্ষ লাগছিলো।আর অনেক মায়াবি,যাকে দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।কিন্তু মনকে না শুনে শোনাতে চাইলাম,”ও যদি আমার হয় তবে ২ বছর পর হলেও হবে”

একি অপরাজিতা কাঁদছে !!!
-এই মেয়ে শোনো ভালোমতো পড়ালেখা করবে।ফেইসবুকে এড দিয়েছি।মাঝেমাঝে কথা হবে।কিন্তু রেজাল্ট ভালো করতে হবে কিন্তু।
-জ্বী স্যার,বলতে বলতে কন্ঠ ধরে এলো ওর…
কাছে গিয়ে অশ্রু মুছে দিলাম।।
-২ বছর অপেক্ষা করতে পারবেনা?
-জ্বী স্যার।
-এবার জ্বী স্যার বলা বন্ধ করবে?
-জ্বী।
-ভালো থেকো।
-আপনিও…
বিদায় নিলাম,আর শুরু হলো অপেক্ষা,নীল অপরাজিতার জন্য

৫,৭৮৪ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “নীল অপরাজিতা”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।