আপনার সন্তানের শৈশব কেড়ে নিবেন না।

আমার ছোটবেলার সবচেয়ে আনন্দের সময় ছিল ক্লাস ফোর আর ফাইভের বছর দুইটা। সে সময় আমি শাহজাদপুরের “কিরন-বালা প্রাথমিক বিদ্যালয়” নামের একটা সরকারী স্কুলে পড়তাম। বই ছিল মোট ৮টা। বোর্ডের ৬টা সাথে ইংরেজী আর বাংলার দুইটা ব্যকরণ বই। আমাকে খুব বেশী পড়তে হত না। স্কুলের হোমওয়ার্ক আমি স্কুলে বসেই সেরে ফেলতাম। বাসায় সন্ধা বেলা বই নিয়ে বসাটা ছিল বাধ্যতা মুলক। কিন্তু পড়ার চাপ ছিল কম। বছরে তিনটা পরীক্ষা। আমি আমার ছোট বেলার কল্পনা,চিন্তা-ভাবনা গুলোকে দেয়ার মত অনেক সময় পেতাম। আমি সময় পেতাম খেলার,কার্টুন দেখার,কমিক পড়ার। চারপাশের দুনিয়াটাকে দেখার। আমার মত করে, আমার সেই শিশু মস্তিস্কের, শিশুতোশ দৃষ্টিভংগীতে দুনিয়াটাকে কল্পনা কল্পনা করার। মেঘের দিকে তাকিয়ে একএকটা মেঘের আকৃতি দেখে সেটাকে বিভিন্ন জিনিস ভাবতাম। চুড়ুই পাখি ধরতাম। মোটকথা আমার নিজের জগত তৈরী করার পর্যাপ্ত সময় ছিল আমার। কারন আমার প্রধান যে কাজ পড়া-লেখা সেটার পরও আমার পর্যাপ্ত, অফুরন্ত সময় ছিল হাতে। সারাক্ষন আমাকে বই, স্কুল আর পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় নাই। কই আমি তো শেষ হয়ে যাইনি। আমার জীবনও ধংস হয়ে যায়নি। আমি সেটুকু নিয়েই ক্যাডেট কলেজের, রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে, বগুড়া ক্যান্টপাবলিকে ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করেছিলাম।

আবার ক্যাডেট কলেজগুলোর শিক্ষার মান বা শিক্ষাব্যাবস্থা কি খুবই খারাপ? এখান থেকে বের হয়ে ছেলেমেয়েগুলোর জীবন কি শেষ হয়ে যাচ্ছে? ক্যাডেটে তো আমাকে বোর্ডের টেক্সট বই ছাড়া অন্য কোনো বই পাঠ্য হিসেবে বাধ্যতামুলক করা হয় নাই। আমরা কি কিছু না শিখে এসেছি সেখান থেকে? আমরা কি অন্যদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছি? আমি সেটা বিশ্বাস করি না। ক্যাডেট ছাড়াও অনেকেই আমার এই কথাটার সাথে একমত হবেন যে ক্যাডেটরা পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী না।

আমাদের জাতীয় কারিকুলাম বা শিক্ষাব্যবস্থা কিন্তু খারাপ না। যারা এটা মনে করেন যে সরকারী স্কুল,কলেজ গুলো নিম্নমানের তারা সেটা ভুল মনে করেন। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাক্রম খুব সুন্দর ভাবে তৈরী করা। যেটাতে একজন শিশু তার মত করে শিখতে পারে। শিশুদের বয়স উপযোগী শিক্ষা, তাদের বয়স উপযোগী পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে। এই দেশের সম্পর্কে, যেখানটায় সে বড় হচ্ছে চারপাশের যা দেখছে সেগুলোর মাধ্যমে তাকে শেখানোর ব্যাবস্থা। যাতে শিশুদের কাছে কখনই পড়াটাকে, শেখাটাকে পবিত্র কোর-আন শরীফের মত মনে না হয়। ছোটবেলায় শুধু কোর-আন পড়া শিখেছিলাম, বর্ণগুলোকে চিনতাম উচ্চারন করতে পারতাম। কিন্তু শুধু দুটো শব্দের অর্থই বুঝতাম এক) আল্লাহ, দুই) মোহাম্মদ। অন্যকিছু আমার ছোট মাথায় ঢুকতো না। এখন মনে হয় যে হুজুর আমাকে শেখাতো সেও যে খুববেশী কিছু বুঝতো তাও বোধহয় না। প্রাথমিক পর্যায়ে শিশুদের তার দেশ, সমাজ, পরিবার, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, তার চারপাশের পরিবেশ এসবের ভিতর দিয়ে শেখানোর চেয়ে ভাল আর কিছু নাই। এতে করে সে তার জীবনের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে না। শিশু অবস্থার হাজারো কৌতুহলের জবাব তখন সে তার পাঠ্যপুস্তকে খুঁজে পায়। পাঠ্য বিষয়ের প্রতি তার আগ্রহ তৈরী হয়।

এখন আমাদের বাচ্চাগুলোকে আমরা এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাই যেখানে তার ওজনের চেয়ে তার স্কুলব্যাগের ওজন বেশী হয়। দেশের বেশীর ভাগ নামজাদা স্কুলেই আমাদের বোর্ডের পাঠ্য বইয়ের সাথে ভারতীয় বই(সেগুলো ওদেরও বোর্ডের টেক্সট নয়) টেক্সট হিসেবে দেয়া হয়। কিছু কিছু স্কুলে কানাডিয়ান বা অস্ট্রেলিয়ান কারিক্যুলাম ফলো করা হয়। ঐসব বিদেশী বইগুলো ঐ দেশের বাচ্চাদের জন্য করা, তাতে থাকে ঐ সব দেশের সমাজের প্রতিফলন। যার সাথে আমাদের বাচ্চারা পরিচিত নয়। আর সে বইগুলো ওরা বাচ্চাদের মুখস্থ করায় না। ওরা সেগুলো থেকে ওদের পদ্ধতিতে বাচ্চাদের শেখায়। কিছু স্কুল বাদে আমাদের সবখানেই শেখানো হয় প্রায় দেশী পদ্ধতিতে। আর আমাদের বাচ্চাদের সেগুলো মুখস্থ করা ছাড়া আর কোনো উপায়ই থাকে না। প্রতিদিনই কোনো একটা বিষয়ের পুরো এক বা দুই অধ্যায়ের ওপর ক্লাশটেস্ট থাকে। এগুলোকে কম গুরত্ব দেয়ারও উপায় নাই কারন এগুলোর নাম্বার ফাইনালে যোগ হয়। সাথে রেগুলার ৫টা বা ৬টা বিষয়ের যতগুলো ক্লাশ থাকে সবগুলোর হোমওয়ার্কতো আছেই। কি শেখানোর জন্য ঐ ছোট কল্পনার জগতে থাকা মাথাটায় আমরা এগুলা ঠেশে দেয়ার চেষ্টা করছি? আমাদের ৫বছরের বাচ্চাটা পার্টস অব স্পিচ জানলে আমরা গর্বীত হই। আসলেই কি ঐ বয়সটাতে এটা জানাটা কি জরুরী?

এমন নয়তো এই নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায় আমরা আমাদের পরিবার বা সন্তানকে সময় দিতে পারছিনা বলে ওকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি? বা সামাজিক মর্যাদার একটা সূচক হয়ে উঠেছে আমার বাচ্চা কোন স্কুলে, কত নামজাদা স্কুলে পড়ে, সেটা রক্ষার জন্য নিজের সন্তানের কাছ থেকে তার শৈশব কেড়ে নিচ্ছি?

যারা মনে করেন এই দুনিয়া এখন অনেক এগিয়ে গেছে, এই দুনিয়ায় কম্পিটিশনে আপনার বাচ্চা পিছিয়ে পরবে সরকারী স্কুলে বা দেশী শিক্ষা ব্যস্থায় পড়াশোনা করলে, তাদের জন্য বলি নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আপনার সন্তানকে এই দুনিয়ার প্রতিযোগিতায় টেকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ঠ। আপনি হয়তো জানেন না আমাদের অনেক শিক্ষাবিদ যারা আমাদের দেশের পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করেছেন তাদের অনেককেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারিক্যুলাম তৈরির জন্য ডাকা হয়।  তাদের করা কারিক্যুলামে যদি আপনি ভরসা না পান তাতে কিছু বলার নাই। এই পর্যায় থেকে আপনি আপনার পছন্দের স্কুল বা শিক্ষায় আপনার বাচ্চাকে শেখান। দয়া করে প্রাইমারী পর্যন্ত ওকে এত প্রেসার দিবেন না। ও যাতে ওর শিশুকালটা না হারায়। জীবনের একমাত্র টেনশন ফ্রি সময়টাকে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিবেন না। এখন পড়ালেখা করলে পরবর্তী জীবনে সুখি হবে, জীবন নিয়ে আর কোনো টেনশন থাকবে না এই কথাটা কত বড় ভুল তা নিজের জীবন দিয়ে চিন্তা করেন। পরবর্তী জীবনে সবসময়ই তাকে বিভিন্ন কারন নিয়ে বিভিন্ন চিন্তায় থাকতে হবেই। তাই দয়াকরে নিজের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে একবার ভাবুন।

১,৫০৪ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “আপনার সন্তানের শৈশব কেড়ে নিবেন না।”

  1. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আই ই আর থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নেয়া লেখককে খুবই সময়োপযোগী একটা লেখার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না। আমার শিক্ষাজীবনে আমি লক্ষ্য করেছি যে আমার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সিলেবাসে বহু বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত ছিল যা আমি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পেয়েছিলাম এবং সেগুলো নতুন করে অথবা অনেক সময় প্রথমবারের মতো শিখতে হয়েছে। আরও অনেক সমস্যা দেখেছি, যেমন, ভাষার ব্যবহারে অনেক সময় পঠিত বিষয় বিভিন্ন সময়/বিভিন্ন পণ্ডিতের মত বিভিন্ন রকম মনে হয়েছে। আবার শিক্ষকদের উদাসীনতা তো রয়েছেই। যা হোক, শিক্ষা ব্যাবস্থার স্বরূপ বিশ্লেষণ করে লেখকের কাছে আরেকটি লিখা আশা করছি। ধন্যবাদ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফজলে রাব্বি নোমান (৮৬-৯২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।