স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ

সবাই একটি গল্প লিখে প্রথমে ডিস্ক্লেইমার দিয়ে দেন যে, এই গল্প সম্পূর্ণ কাল্পনিক। আমি দিচ্ছি না। কারণ, এটা সম্পূর্ণই বাস্তব।

আমার খুবই কাছের এক বন্ধুর কথাই বলতে এসেছি। তার জন্যে কোনদিন কিছু করতে পারি নি। সে আমাকে করতে দেয় নি। তার নামটা উল্লেখ করছি না। লেখাটা তারই জন্যে।

আমরা একই সাথে স্কুল জীবন পার করেছি। স্কুল বলতে ক্যাডেট কলেজে আসার আগ পর্যন্ত সময়টা বোঝাচ্ছি। আমি যখন ক্যাডেট কলেজে এলাম, সেও তখন আরেকটা ক্যাডেট কলেজে চলে গেল। আমাদের মধ্যে দেখা হতে লাগল শুধু ছুটির সময়টুকু। কত স্বপ্নই না সে দেখতো।

সময় পেরিয়ে যায়, অনেকেই অনেকভাবে পরিবর্তিত হয়। অনেকের স্বপ্নও পরিবর্তিত হয়। যারা যারা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার অথবা বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিল তাদের অনেকেই সামরিক বাহিনীতে যেতে চায়, কারণ অত পড়ালেখা মাথায় ঢুকছে না। কিন্তু তার ইচ্ছা বা স্বপ্ন কোনটাই পরিবর্তিত হয় না। তার স্বপ্ন একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়া, দেশের জন্যে কিছু করা, দেশের মানুষদেরকে দেশি জিনিস ব্যবহার করতে শেখানোই ছিল তার স্বপ্ন। আমি তার মাঝে সম্ভাবনা দেখেছিলাম, তার চোখের মাঝে এক অদ্ভুত আলো দেখতে পেয়েছিলাম, বুঝেছিলাম সে মন থেকেই চায় দেশের জন্যে কিছু করতে। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল,

-মাজহার, বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি সবথেকে ভালো কোনটা রে? বুয়েট?

-হ্যাঁ। সন্দেহ আছে?

-না, আমি বলছিলাম যে, বুয়েট ছাড়া কোথাও পড়ে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায় না?

-যাবে না কেন?

-আসলে জানিস, বুয়েটে ৯৮% লোকজন যায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আর মাস্তি করতে, বুয়েটে পড়ি এই ভাবটা মারতে। আর অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, মাত্র ২% লোকজন ইঞ্জিনিয়ার হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া আর ইঞ্জিনিয়ার হওয়া দুইটা আলাদা ব্যাপার। আমার পরিচিত এক লোক এখন পুলিশে আছে, এএসপি। উনি বুয়েট থেকে EEE পড়েছেন। কি দরকার ছিল অত কষ্ট করে EEE পড়ার?

বুঝতে পারলাম তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কত ইচ্ছা।

সময় যায়, আসে। আমরাও কলেজ থেকে বের হয়ে আসি। কোচিং নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। সেও ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সপ্তাহে হয়ত ২-৩ বারের বেশি কথা হত না। কিন্তু আমরা শুনতাম একে অপরের স্বপ্ন। সামরিক বাহিনীতে যাবার কোন ইচ্ছা তার কোনকালেই ছিল না। আইএসএসবি থেকে বাদ হয়ে চলে এল। যদিও তার বাবা-মার ইচ্ছা ছিল তাদেরে ছেলে আর্মি অফিসার হবে, কিন্তু তার কোন ইচ্ছা ছিল না। তার একটাই ইচ্ছা। একে একে পরীক্ষায় বসে আমার বন্ধুটি, কিন্তু কোথাও সে তার মনের মত সাবজেক্ট পাচ্ছে না। একের পর এক ধাক্কা সে সামলে নিচ্ছে, মনকে বোঝায় সমস্যা নাই, পরেরটা হবে। কিন্তু তারপরেও না বোধক ফলাফল। সে যে ছাত্র খারাপ তা না। আমার দেখামতে প্রথম সারির মেধাবী সে। নিজের বন্ধু বলে বাড়িয়ে বলছি না একটুও। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার সিস্টেমের সাথে সে কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারছিল না। আমার নিজের কিছু সমস্যা হওয়াতে আমি মেস চেঞ্জ করে আমার বন্ধুটির মেসে উঠি। এখন থেকে একই সাথে থাকা যাবে। কিন্তু তার অবস্থা দেখে আমার মন হু হু করে কেঁদে উঠল। চোখের নিচে কালি, শুকিয়ে কাঠি, কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছে। আমাকে দেখেও তার কোন ভাবান্তর নেই। তার বেডের নিচে দেখি এক স্তুপ গোল্ড লিফের প্যাকেট। সিগারেট সে আগে থেকেই খেত, কিন্তু এখন মনে হয় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তার প্রমান পেলাম। আমি আধা ঘন্টাও হয়নি রুমে এসেছি, এরি মধ্যে সে দুইটা খেয়ে ফেলেছে। জিজ্ঞেস করলাম,

-কয়টা খাস দিনে?

-হিসাব নাই। ৯-১০ টা, কোনদিন ১৩-১৪ টা।

-কি লাভ খেয়ে?

-তুই ও তো খাস।

-আমার তো একটা লিমিট আছে। তোর মত অমানুষের মত তো দিনে ১৪-১৫ টা খাই না।

-আব্বুর হাই ব্লাড প্রেশারের সমস্যা হচ্ছে ইদানীং।

আমি আর কোন কথা বললাম না। আমার বন্ধুটির চোখের মধ্যে যে স্বপ্ন খেলা করত তারা এখনও জীবিত আছে, কিন্তু তারপরেও আমার বন্ধুটি কেমন জানি বদলে গেছে।

সময় এলো। বুয়েট পরীক্ষার দিন। একে অপরের সাথে দেখা করে হলে ঢুকলাম পরীক্ষা দিতে। পরীক্ষা দিয়ে বের হলাম। তার চোখে আবার সেই হতাশা। দুইজনই হতাশ হয়ে রাস্তায় ঘুরছি আর আকাশে ধোঁয়া ছাড়ছি। পলাশীর মোড়ে বুয়েটের কিছু ভাই চা-সিগারেট নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠেছে। ও তাদের দিকে তাকিয়ে বলছে, এদের মধ্যে থেকেই অনেকে EEE পড়ে ASP হবে। আর আমি?

আমার বুকটা গুঁড়িয়ে যেতে লাগল। আমার মুখ দিয়েও কিছু বের হলনা। কিছুই না। রেজাল্টের পরেরদিনে ওর সাথে আমার মুঠোফোনে কথা হচ্ছে,

-কেমন আছিস?

-ভাল না।

-কোথায় ভর্তি হবি?

-জানি না। আজকে আম্মু বলছিল, তোকে নিয়ে আমার আর কোন ইন্টারেস্ট নাই। কোন আশা নাই।

-এক কাজ কর। আর্মিতেই যা। পরের বার আইএসএসবি দে। তুই সিরিয়াসলি দিলেই চান্স পাবি।

-পালাইতে বলতেছিস? ভাবসিলাম তুই ভাল কোন কথা বলবি। তুইও দেখি একই গীত গাওয়া শুরু করছিস। আমি আর্মিতে যাব না। তোকে আমি ভাল বন্ধু ভাবসিলাম, তুই ও যা, আর বাকি সবাই ও তা। রাখি।

এই বলে আবার তার ফোন অফ। আর পারলাম না। দেখা করতে গেলাম তার সাথে। দেখা হল। তার চোখে এখনও স্বপ্নেরা খেলা করছে। সে এখনও হাল ছেড়ে দেয় নি।

-বুঝলি মাজহার। অনেক চিন্তা করে দেখলাম। আল্লাহ বলে কিছু নাই।

-মানে? কি বলতে চাচ্ছিস?

-মানে বলতে চাচ্ছি যে, ওই যে তোরা যারে খুশি করার জন্যে নামাজ, রোজা করিস না? সে আসলে নাই।

-ও আচ্ছা। (উপরে স্বাভাবিক ভাব দেখালেও আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল, তার মত আল্লাহ ভক্ত ছেলে খুব বেশি নাই) তা হঠাৎ এইটা মাথায় ঢুকল ক্যান?

-পাশের বাড়ির হিমেল(নকল নাম) বুয়েটে চান্স পাইসে। সিভিল পড়বে। জিজ্ঞেস করলাম কেন সিভিল পড়বা? সে বলল, সিভিল পড়ে বিসিএস দিয়ে এলজিইডি তে চাকরি নেবে, তার নাকি আপন মামা আছে। এলজিইডি তে কেন চাকরি নেবে জানিস?

-কেন?

-কাজ করা লাগবে না তেমন।

-ও আচ্ছা।

-বুঝলি, আমি একটা ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার হইতে চাইসিলাম, আল্লাহ পূরণ করলো না। আমারই কেন এক্সামহল সিকনেস থাকা লাগবে?

-তুই না বললি, আল্লাহ নাই?

-ও আচ্ছা, তাইতো। ভুলেই গিয়েছিলাম।

এই আমার বন্ধু। স্বপ্ন বুকে নিয়ে এখনও বেঁচে আছে। সে এখনও বিশ্বাস করে যে, সে একদিন ইঞ্জিনিয়ার হবে। দেশের জন্যে কিছু করবে। অন্যান্যদের মত স্বার্থপরের মত বিদেশে থাকবে না। দেশেই থাকবে। দেশের মানুষকে দেশি পণ্য ব্যবহার করা শেখাবে। সে দিনটা অবশ্যই আসবে। শত ধিক্কার আর লজ্জার মধ্যেও সে যে এখনও বেঁচে আছে আর সুস্থ আছে এটাই একটা বিস্ময়। মনে হয় স্বপ্নময়ী মানুষরা বেশিদিন বাঁচে।

দোস্ত জানি তুই আমার এই লেখা পড়বি না কোনদিন। কিন্তু আমি এইটা সম্পূর্নই তো জন্যে লিখলাম। আমি জানি তুই একদিন একজন ইঞ্জিনিয়ার হবি, আমি মানুষকে বলব ওইটা আমার ন্যাংটাকালের দোস্ত। বল বলব না? অবশ্যই বলব। ভাল থাকিস রে। ভাল থাকিস।

১,৬৬৮ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ”

  1. ফেরদৌস জামান রিফাত (ঝকক/২০০৪-২০১০)

    এই ছেলেটার জন্য সত্যিই মন থেকে প্রার্থনা করছি।
    মাজহার, তোমার ফ্রেন্ড ভালো কোথাও ভর্তি হলে অবশ্যই আমাকে জানাবা।
    অবশ্যই।


    যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা

    জবাব দিন
  2. শেখ সাদী (০৬-১২)

    মাজহার, ভাল লিখসিস! চালায়া যা! তোর বন্ধুর মত অনেক সপ্নময়ের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়, আবার তারা উঠেও দাঁড়ায়। অপেক্ষা করব তার উঠে দাঁড়ানোর। তেমনি অপেক্ষা করব তারপর তোর এমন একটা লেখার জন্য যেখানে সংগ্রামী মানুষের জয়গান থাকবে। শুভকামনা!


    \"why does the weasel go pop? does it matter?
    if life is enjoyable, does it have to make sense?\"

    জবাব দিন
  3. মাজহার (০৬-১২)

    আমার বন্ধু এখন একজন উদ্যোক্তা। নিজের একটা সফটওয়্যার কোম্পানী আছে। নিজের দেশেই আছে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্বার্থপরের মত অন্যদেশে পাড়ি দেয় নি।


    MH

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।