কৈফিয়তনামা – ১

মানুষ হিসেবে আমি খুবই বৈশিষ্ট্যহীন একজন মানুষ। একদমই সাদামাটা। আমার বয়সে আসতে আসতে একটা ছেলের অনেকরকম অভিজ্ঞতা হয়ে যায়, সেই তুলনায় আমার ঝুলি নিতান্তই খালি বলা যায়, এতোদিনে সিগারেটা পর্যন্ত খাওয়া শেখা হয়ে উঠেনাই… কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হল পুরাই honesty is lack of opportunity! আমার সাধ আছে অনেক কিছু করার, কিন্তু সাধ্য নাই। আরো ঠিক করে বললে সাহস নাই। আবার অন্যদিকে, আমার মধ্যে আত্মহত্যার ভাব প্রবল। মানে ঝুকির প্রতি আমার দারুন ঝোঁক। অনেক উঁচুতে উঠলে আমার শুধু লাফ দিতে ইচ্ছা করে, অন্ধকার দেখলে তার ভেতর সেঁধিয়ে যেতে মঞ্চায়! আর পাহাড়-জঙ্গল? ভাষায় বলে প্রকাশ করতে পারবোনা তারা আমাকে কতটা টানে.. ভাগ্যিস সাঁতারটা পারিনা, পারলে আমি নিশ্চিত পানি দেখলেও লাফিয়ে পড়তে মঞ্চাইত! যেকোন বিপদে পড়লেই ব্যাপারটা আরো ভাল বুঝতে পারি। নিজের বিপদ হলে তো কথাই নাই, পরিচিত জন এমনকি কোন সিনেমাতে পর্যন্ত বিপদের চিহ্ন দেখলেই আমার সবকিছু দাড়ায়ে যায়, মেরুদন্ড বেয়ে শিরশিরানি নামতে থাকে, পেটের ভেতরটা পাক দিতে থাকে। নাগরদোলায় চড়ার সাথে এর একটা মিল আছে, তবে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী তীব্র! আর ভয়ের কথা হল অনুভূতিগুলো আমি এতো উপভোগ করি যে সেগুলো আমি বারবার পেতে চাই। কারন বিপদ মানেই আমার কাছে নতুন মুহূর্ত, নতুন উত্তেজনা।

আমি জানি জীবনের বিশেষ এক পর্যায়ে আমাদের সবারই এরকম হয়, হরমোন চেঞ্চ বলি আমরা একে। আবার বয়স হলে এসব কেটেও যায়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বোধয় কাজ করছেনা। করছেনা বললেও ভুল বলা হবে, সম্পূর্ণ উল্টাভাবে কাজ করছে! যত বয়স বাড়ছে আমার, এসব পাগলামির ঝোঁক দিনকেদিন বাড়ছেই। আর বড় হয়ে যাওয়ায় একদিকে এসবের অভিজ্ঞতা যেমন বাড়ছে, অন্যদিকে আমাকে শাসন করার মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে, আমি আরো আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছি। আমার বয়সের, এমনকি আমার জুনিয়ররাও যেখানে বাউন্ডুলেপনা বাদ দিয়ে ধরাবাঁধা জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছে বা হওয়ার চেষ্টা করছে, আমি সেখানে জীবনে কিভাবে আরো উত্তেজনা যোগ করা যায় সেই চেষ্টায় ব্যাস্ত। আমার চারপাশে সবাই যখন ক্যারিয়ার, বিয়ে_বাচ্চা, বাড়ি_গাড়ি, দায়_দায়িত্ব এসবের জন্য নিজেকে তৈরী করছে, তখন আমি চেষ্টা করছি এসব থেকে দুর থাকতে। আমার চারপাশে যারাই আমার ভাল চায় তারা বেশীরভাগই আমাকে নিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে, যারা দেয়নি তারাও খুব বেশী কিছু যে আশা করে আমার থেকে এমন নয়। বাস্তব জীবনে আমি একজন ব্যর্থ মানুষ এবং ভয়ের কথা হল সেটা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন অনুশোচনা নেই আমার মাঝে।

আমার মনে হয় যে মানুষটা বন্ধনহীনতার স্বাদ একবার পায় তার অন্যদিকে ফেরাটা খুব কঠিন, যতক্ষণ পর্যন্ত অনেক দেরী হয়ে যায়। এটা আসলে একটা একমুখী যাত্রা। তবে কষ্টের কথা হল যে “সব ছেড়েছুড়ে দেয়ার” অনুভূতিটা অনেকবার পায়নি(একবার না, অনেকবার। একবার দুবার হলে সেটা সাময়িক উত্তেজনার মধ্যেই পড়ে, মাতলামি যেমন), তার পক্ষে এর স্বাদ নেয়া সম্ভব না। জানি, সভ্য সমাজের সভ্য মানুষেরা এর স্বাদ নিতে চাইবেওনা কিন্তু সাফাইয়ের মত শোনালেও সত্যিটা হল এর স্বাদ পেতে হলে আপনাকে নিয়ন্ত্রনের সেই লাইনটা পার হতেই হবে। আবার এমনভাবে যে সেটা কখনোই লাগামছাড়া হবেনা। আর সেটা করতে হবে বারবার। তবেই আপনি “ভোগ” আর “উপভোগের” মাঝে পার্থক্য করতে পারবেন, নচেৎ নয়। সে অনুভূতির যে তীব্রতা আর ঘনত্ব, আর কোন কিছুর সাথেই তার তুলনা চলেনা। এ শুধু আরেকজন ভুক্তভোগীর সাথেই ভাগ করে নেয়া যায়। তাই এ জীবনটা কিছুটা একাকী কিন্তু এই একাকীত্ব আনন্দের। সেই আনন্দ আবার শতগুন বেড়ে যায় একইরকম কাউকে খুঁজে পেলে। কি ভাই, আসবেন নাকি আমাদের দলে? ভয়? একটাই তো জীবন, এতো ভয় করলে চলে?

তা সব মিলিয়ে বেঁচে থাকা ব্যাপারটা নেহায়েত মন্দ না, কি বলেন?

৯৭২ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “কৈফিয়তনামা – ১”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)
    তা সব মিলিয়ে বেঁচে থাকা ব্যাপারটা নেহায়েত মন্দ না, কি বলেন?

    :thumbup: :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।