ঈদের চাঁদের হাসি

অণুগল্প লিখবো বলে অনেক আয়োজন করে বসেও থেমে যেতে হয় শুরুতেই। ট্রেনের হুইসেল শুনে কানপাতি আমি, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে আপনমনেই বলি,” মহানগর এক্সপ্রেস! ট্রেন এসে গেছে!” নৈঃশব্দের রাজ্য ক্যাডেট কলেজের নীরব-নিশ্চুপ বাতাস কেটে ট্রেনের হুইসেল থেকে থেকে কানে আসে অনেকক্ষণ। স্পষ্ট শুনতে পাই, হেলেদুলে যেতে যেতে ট্রেনটা আমাকে বলছে,” ভালো থেকো খেয়াসোনা!” শ’কিলোমিটার দূরে বসে এই ট্রেনের জন্যে যে আরেকজন অপেক্ষা করে থাকে। ট্রেনের আওয়াজ পেলেই দৌড়ে ছাদে ছুটে যায়, ট্রেনটাকে ফিসফিসিয়ে বলে,” আমার বাবুটাকে আদর দিও।“ জীবনের আঠারোটা বসন্ত পার করে ফেললাম, তবু তার কাছে আমি এখনো শুধুই ‘বাবু’। এ নিয়ে অনুযোগ করলে সে তার ভুবনভোলানো হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বলে,” আমি যে মা!” কথাটা বলার সময় কী এক অপূর্ব তৃপ্তিতে যে তার সুন্দর মুখটি ভরে উঠে, আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। এই হাসি মুখটা একবার দেখতেই তো ছটফট করি পুরো টার্ম। কখনো ক্যালেন্ডারে দাগ কেটে, কখনোবা আঙ্গুলে হিসাব করে দিন গুণি ঈদের ছুটির। সকালে পিটি শেষে ক্লান্ত হয়ে যখন ফুলস্পিডে ঘুরতে থাকা ফ্যানের নিচে এসে বসি, তখন শরীরের ঘাম আস্তে আস্তে শুকিয়ে আসলেও মনটা আঁকুপাঁকু করে মামনির আঁচলে মুখ লুকাবার জন্যে। ডাইনিংয়ে দুধের পেয়ালা হাতে নিতেই ভেতরটা কেমন যেন উলটপালট হয়ে      যায়। বহুদূর থেকে বাবার কষ্ট করে বয়ে আনা দুধ  ক্ষীরের মতো জ্বাল দিয়ে পরম মমতায় হাতে তুলে দিয়ে খাওয়ার জন্যে কতো অনুরোধই না করতো মা! তার সেই স্নেহের মিনতি প্রায়ই রক্ষা করিনি আমি। কলেজে দুধ খেতে পীড়াপীড়ি করার কেউ না থাকায় তাই খুশীই হবার কথা আমার। কিন্তু কেন যেন গলার কাছটায় দলা পাকিয়ে থাকে ভীষণ কষ্ট। টুপটাপ অশ্রুতে ক্রমশ নোনতা হয়ে আসা দুধ পরে থাকে পেয়ালায়। খুব দমবন্ধ হয়ে এলে আকাশ দেখি আমি, মা চিঠিতে আমায় আকাশ দেখার কথা লিখে। বারবার পড়ার ফলে মুখস্ত হয়ে যাওয়া মায়ের চিঠিগুলো আমার কাছে সঞ্জীবনী সুধার মতো লাগে। চিঠির উত্তর লিখতে গিয়ে মনের এলোমেলো ভাবনাগুলো সাজাতে পারিনা ভাশায়,কলম কেঁপে যায়। আমার অগোছালো চিঠির জন্যেই যে মা অপেক্ষা করে খুব, আমার ছেলেমানুষি চিঠি পরে হেসেকেঁদে আকুল হয়!

বাবার কাছে শুনতে পাই, আমি অসুস্থ থাকলে কেমন করে যেন টের পেয়ে যায় মা! দিনরাত ছটফট করে। ঠাট্টা করে মুখে “মহিলা পীর” বললেও মায়ের এই ক্ষমতাটায় বিস্মিত হতে হয় প্রতিবারই। মাকে জিজ্ঞাসা করলেই সে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে হেসে বলে,” নিজে মা হলে তখন বুঝবি।“আমার কাছে ঈদের চাঁদ মানে মায়ের মুখের এই হাসিটুকুই। সেমাই রান্না করতে গিয়ে অথবা ভুনা মাংস কষাতে গিয়ে মায়ের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠে,সেদিকে তাকিয়ে আমি আনমনেই মাথা নাড়ী আর বলি,” তোমার মতো মা আমি কখনোই হতে পারবোনা। এই জনমেও না, এর পরের জনমেও না। কারণ তুমি যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা!”কথাগুলো মুখফুটে মাকে কখনোই বলা হয়নি, জানিনা কখনো বলতে পারবো কিনা!

১,২৮৫ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “ঈদের চাঁদের হাসি”

মওন্তব্য করুন : খেয়া (০৬ - ১১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।