স্বয়ম্বর সভা ও কয়েকটি প্রেমের একটি গল্প

হাতের ক্যাপটা ডলে ডলে সমান করতে করতে চতুর্থবারের মতো ঘোষণা করে পারিসা,” আমার ভাল লাগছেনা।“ পাশে বসা তামান্না ওকে ফিসফিস করে বলে,” সারাক্ষন ভালো লাগে ভালো লাগেনা বলতে থাকলে ভালো লাগবেটা কি করে শুনি? আমার তো মজাই লাগছে।“ পারিসা হতাশ হয়ে কাধ ঝাঁকায় একবার, আড়চোখে চারপাশটা আরেকবার দেখে নেয়। অডিটোরিয়ামটা ভালোই লাগে ওর কাছে, এখনো মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়নি বলে চারপাশে একটা মৃদু গুঞ্জন। ICCLMM  এ আসার অভিজ্ঞতাটা পারিসার জন্য নতুন, আসার উৎসাহটা তাই তামান্নার চেয়ে বেশি ওরই ছিলো। গতকাল যখন ওদের কলেজবাসটা ধীরে ধীরে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকছে, রীতিমতো হা করে চারপাশটা দেখছিল ও। বাস থেকে নামার আগে আগে অ্যাডজুটেন্ট স্যার তখন ওদের উদ্দেশ্যে ডিসিপ্লিন সংক্রান্ত একটি ছোটোখাটো ভাষণ প্রদান করছেন। হঠাৎ করেই পারিসার উত্তেজিত চিৎকার,” স্যার, এই ক্যাডেট কলেজের স্যারেরাও কি ডিসিপ্লিন্ড, উনারাও ফলইন করে হাঁটেন!!” পারিসার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই বাসের মধ্যে একটা হাসির রোল পড়ে যায়। স্যার পর্যন্ত হাসতেই হাসতেই বলেন,” মাই ডিয়ার, উনারা স্যার নন, আপনার মতোই ক্যাডেট!” ডিনারে যাওয়ার আগপর্যন্ত এ নিয়েই হাসাহাসি চলে ওদের মধ্যে, লজ্জায় রীতিমতো লাল হয়ে যায় পারিসা। ও কেমন করে জানবে যে ক্যাডেট আর স্যারদের ড্রেস একিরকম হবে? আর মাত্র কয়েকদিন আগে ক্লাস নাইনের অ্যাপুলেট পাওয়া পারিসার হঠাৎ করে এতো সিনিয়র ভাইয়া/আপুদের দেখলে চমকে যাওয়াটা অন্যায় নাকি? “ওই দেখ পারিসা, স্যারেরা লাইন করে ডিনারে এসেছেন।“, “আরে আরে কতো স্যার দেখেছিস?”- এই জাতীয় কথাবার্তা হজম করতে করতে পেট ভরে গেলেও ওকে ডাইনিং এ ঢুকতেই হয়। পারিসাদের বসতে হবে ফার্স্ট হাইটেবিলের একদম বরাবর। কারো অ্যাপুলেটে চারদাগ দেখলেই ওর ভয় ভয় লাগে, সেখানে এত্তজন ক্রসবেল্টওয়ালা ভাইয়া-আপুদের সামনে বসে খাওয়ার কথা ভেবে ওর পেটের ভাত চাউল হয়ে যাবার অবস্থা। কিছুক্ষণ পর একে একে সবাই ঢুকে গেলে আওয়াজ এলো, “ক্যাডেটস, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।“ একটু অন্যমনস্ক থাকার কারণেই হোক, আর কলেজ প্রিফেক্টের বজ্রকন্ঠের দাপটেই হোক, পারিসার হাত থেকে ক্লিপ খসে পড়ে গেলো। “ ইহা যদি কমান্ড হয়, তাহলে এতকাল কলেজে যাহা শুনিয়াছি উহা কি ছিল?”- ব্যপারটা নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই দুশ্চিন্তায় পড়ে ও। আরেকবিপদ হল খাবার মুখে তুলতে গিয়ে। চামচগুলোর সাইজ এত্ত বিশাল যে ওইগুলোতে করে খাবার বাক্কাল ক্যাভিটিতে পৌঁছানো ওর কাছে রীতিমতো অসম্ভব মনে হতে থাকলো। চোখে চোখ পরতেই তামান্না ওকে আশ্বস্ত করলো, “বালক ক্যাডেট”দের চামচ দিয়ে খেতে গেলে এইরকমটা নাকি হতেই পারে। ওদের করুণ অবস্থা দেখে মেস ওআইসি স্যার বুঝতে পেরে টেবিল চামচের পরিবর্তে চা চামচের ব্যবস্থা করে দিলেন।

সেসব কথা মনে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে পারিসা। কলেজ প্রিফেক্ট ভাইয়া সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কমান্ড দেওয়ার লক্ষণ বুঝতে পেরে হাতের ক্যাপটা শক্ত করে চেপে ধরে। আবার হাত থেকে খসে পড়লে কেলেঙ্কারি হবে। নিজের অজান্তেই ভাইয়াকে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে ও। নিখুঁত টার্নআউট, হাতে চমৎকার একটা ঘড়ি, মুখে কলেজ প্রিফেক্টসুলভ মানানসই গাম্ভীর্য। কিছুদিন আগে মাত্র “কলেজ ক্যাপ্টেন” বইটা পড়ে শেষ করায় পারিসার মনে হলো বইয়ের কলেজ ক্যাপ্টেনকেই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে।

রুমে ফিরে সবার কথা শুনে পারিসার চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম। একদিনের মধ্যেই বন্ধুদের হৃদয় হারানোর গল্প শুনে অবাক হওয়াটা স্বাভাবিক বৈকি। “অমুক কলেজের কলেজ প্রিফেক্ট ভাইয়াটা কি কুল”, “তমুক কলেজের কালচারাল প্রিফেক্ট ভাইয়াটাকে দেখেছিস? কি স্মার্ট!”- এইধরনের কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেলো প্রায়। কারো কারো অভিজ্ঞতা আরও সাংঘাতিক, প্রথম দিনেই চিরকুট পর্যন্ত পেয়ে গেছে! তামান্নার হাতেও তেমনি একটা চিরকুট, তাতে লেখা-“ বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর এখন আষাঢ় মাস, তোমার চোখে দেখলাম আমি আমার সর্বনাশ!” এটা নাকি ওকে সামনে বসা কোন ভাইয়া দিয়েছে। পারিসা চোখমুখ শক্ত করে জিজ্ঞাসা করলো,”সামনে বসে তোর চোখ দেখল কিভাবে? উনার কি পেছনেও দুইটা চোখ আছে?” তামান্না মুখ কালো করে বলল,”আমি কি জানি?” পারিসা মাথা নেড়ে হতাশ কণ্ঠে বলে, “এইটার নাম ICCLMM কে রাখছে? এর প্রকৃত নাম হওয়া উচিৎ স্বয়ম্বর সভা।“ তামান্না কি যেন একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লো পারিসা, কালকে সকালে ওর ইভেন্ট আছে।

(২য় পর্ব ২৯ তারিখ আপলোড করা হবে ইনশাল্লাহ। )

৩,১১০ বার দেখা হয়েছে

৭০ টি মন্তব্য : “স্বয়ম্বর সভা ও কয়েকটি প্রেমের একটি গল্প”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    পড়ে মজা পাচ্ছি, পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম 🙂

    এমজিসিসিতে লাঞ্চের শুরুতে আমরাও চমকে উঠেছিলাম, পুরো ডাইনিং হল জুড়ে সবার একসাথে বিসমিল্লাহ বলা শুনে 😛


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    কি যে দিনকাল আইলো!! আমরাই আসলে ভালো ছিলাম! আমাদের সেইকালে মেয়েদের কোনো ক্যাডেট কলেজ ছিল না, কোনো নারী শিক্ষক ছিল না................ 😡

    জিহাদ: আমারে পপকর্ণ, সরি বাদামের ঠোঙ্গাটা দাও............. 😀


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  3. শাওন (৯৫-০১)
    তামান্নার হাতেও তেমনি একটা চিরকুট, তাতে লেখা-“ বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর এখন আষাঢ় মাস, তোমার চোখে দেখলাম আমি আমার সর্বনাশ!” এটা নাকি ওকে সামনে বসা কোন ভাইয়া দিয়েছে।

    তা চিরকুট দেয়া সেই সাহসি ক্যাডেট টা কে? 😀 আমি দুই বার গেলাম ICCLMM এ। এতটা সাহস দেখাতে পারিনি আমরা । অবশ্য অনেকের ই চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিলোনা। 😀


    ধন্যবাদান্তে,
    মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শাওন
    প্রাক্তন ক্যাডেট , সিলেট ক্যাডেট কলেজ, ১৯৯৫-২০০১

    ["যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি"]

    জবাব দিন
  4. রিদওয়ান (২০০২-২০০৮)

    ২০০৭ এ কুমিল্লায় সিসিআর এর পেছনে বসত জয়পুরহাট। ঝিনাইদাহের এক ক্লাস সেভেনকে নিয়ে জয়পুরহাটের দুই ক্লাস সেভেনের আলাপ চলছিল আমার পেছনের সীটে।
    সেই সব কথা শুনে আমার কান পুরাই গরম x-(
    সাথে মাথাও গরম :gulli2: উলটা ঘুরে দিলাম ঝাড়ি। :gulli2:

    জবাব দিন
  5. ইমরান (১৯৯৯-২০০৫)
    “অমুক কলেজের কলেজ প্রিফেক্ট ভাইয়াটা কি কুল”, “তমুক কলেজের কালচারাল প্রিফেক্ট ভাইয়াটাকে দেখেছিস? কি স্মার্ট!”

    ইস, আমি হাউস প্রিফেক্ট হয়ে ICCLM গিয়েছিলাম। হাউস প্রিফেক্ট নিয়া আলোচনা না থাকায় সবার ব্যাঞ্ছাই।


    রঞ্জনা আমি আর আসবো না...

    জবাব দিন
  6. আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

    "স্বয়ম্বর সভা" হা হা হা। =)) =)) =)) :clap:
    চমতকার লিখছো ভাই। এর পরে কী?? সীতার বনবাস বা বেহুলার ইন্দ্রলোক ভ্রমন নাকি সমুদ্রের প্রতি রাবন?? হা হা হা
    ভাইরে, হাসি থামিতেই পারতেছি না। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে পারিসা আঁতেল ছিল। অন্ততঃ ক্যাডেট কলেজে যারা সত্য বলে বা ধরতে পারে তাদের বরাদ্দ এই উপাধি। কী ভাই, ছিল?? পারিসা কী আঁতেল ছিল??

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।