বরুনা প্রবালের গল্প – ০১

রাত বাজে তিনটা, বুঝলাম না ঘুম ভেঙ্গে গেলো কেন? নাহ, এলার্ম বাজে নি, চারিদিকে সুনসান নীরবতা, তারপরে ও কি হল? গত তিন মাস যাবত এ রকম হচ্ছে। কোন শব্দ বা বড়সড় আওয়াজ হলে মিমির ঘুম ও তো ভাংতো। মিমি কিন্তু শান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। মুহুর্তে মনে হলো প্রবালের কথা, পড়ার রুমে এসে ল্যাপটপ খুলে সবগুলো মেসেঞ্জার চেক করলাম, নাহ, প্রবালের কাছ থেকে কোন নোট আসে নি। প্রতিদিন কাজে, বাসায় আসার সময়, বন্ধুদের আড্ডায় ফোন বের করে মেসেঞ্জার গুলো বারবার দেখি। কোন মেসেজ আসে না। কখনো কখনো তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ভিজে যায়, হাতের তালুতে আড়াল করে চোখ মুছি। স্পেনের পুলিশ বলেছে ওদেরকে খুজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না। যখন কাজের জন্য অন্য প্রভিন্সে যাই, ব্যস্ততা থাকে বিস্তর, মিমিকে বলে যাই মেসেঞ্জার চেক করতে। মিমি খেপে যায় প্রথমে, ওর ধারনা আমি বাস্তবতার চেয়ে বন্ধুত্ব কে বড় করে দেখছি। প্রবাল, মুক্তা আর টুকটুকের যে ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই তা আর আমি মানতে চাই না, এটাই মিমির যত কষ্ট।

মাঝে মাঝেই ইদানিং এ রকম হয়, এই মনে হয় প্রবালের কাছ থেকে একটা কথা আসবে “বেবুন তুই কই”। কলেজে আমার লাফালাফি দেখে প্রবাল আমার নাম দিয়েছিলো বেবুন। কাউকে জানায় নি, এখন শুধু জানে মিমি। মুক্তা আর প্রবাল, যারা জানতো, তারা আবার একদিন বেবুন ডাকবে এই আশা তে বোধহয় মনটা এরকম অশান্ত। আজ থেকে তিন মাস এক সপ্তাহ আগে কাজের উপলক্ষে স্পেনে গেলাম, সারপ্রাইজ দেবো বলে প্রবাল বা মুক্তা কাউকে জানাই নি। চারদিনের কাজ দেড় দিনে শেষ করে চলে গেলাম সালামানকা, লম্বা রাস্তা আলমেরিয়া থেকে। প্রবালের এপার্টমেণ্ট টা খুব ভালো লাগতো। রিও টরমেস নদীর পাড়ে তিনতলা এপার্টমেন্ট, বিকালে পুয়েন্তে রোমানো ব্রীজে গাড়ীর লম্বা সারি যেন চলতে ই চাইতো না। আমরা দুজনে মিলে বারান্দায় বসে সামনে থেকে দ্বিতীয়, তৃতীয় গাড়ীর নাম্বার প্লেট আন্দাজ করার খেলায় ব্যস্ত থাকতাম, দুজনের কেউ কখনো জিততে পারতাম না। যাক, সেদিন ওর এপার্টমেন্টে পৌছুতে পৌছুতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, তখন গাড়ির ভীড় কিছুটা কম। এ সময়ে এ এলাকায় ছাত্র ছাত্রীদের ভীড় বেশী, পাশে ই সালামানকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রবালের ও পি এইচ ডি’র জন্যই এই এলাকাতে থাকা। এর আগে যতোবার এসেছি, ততোবারই কেমন যেন আপন আপন মনে হয়েছে জায়গাটা, এবারে একটু খটকা লাগলো প্রথমেই। তিনতলার অডিও বেল এ প্রবালের নামের ট্যাগটা দেখি না কেন?

হঠাৎ করেই যেন সন্ধ্যা জেঁকে বসেছে, আধো আলোতে চেনা বেল এর বাটনে চেপে ধরে রাখলাম কয়েকবার, উল্টোপ্রান্তে বেজেই চলেছে বেল, কোন উত্তর নেই। গোটা দশেক চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে ম্যানেজমেন্ট অফিসের বেল চেপে ধরতেই দিয়েগো’র পরিচিত গলা, “আমাদের অফিস সকাল ৭.৩০ থেকে বিকেল ৫.৩০ পর্যন্ত খোলা, আপনি আগামিকাল যোগাযোগ করুন”। কেটে দেবার আগেই বললাম, দিয়েগো, আমি হাসান। যাদুর মতো কাজ হলো, ক্রিং করে বেল বেজে ফটক আনলক হবার শব্দে দ্রুত ঢুকে ম্যানেজমেন্ট অফিসের দিকে পা বাড়ালাম। এক নকের পর দিয়েগো র হাসি মুখে অভিবাদন, এসো, অনেকদিন পর দেখা, বসো, কেমন আছো? মুহুর্তের জন্য মনে হলো হাসিতে কি কৃত্রিম কিছু, নাকি সংকোচ ঢাকার চেষ্টা? প্রবালের নাম ট্যাগ দেখলাম না, বাসায় ও কেউ বেল ধরছে না, ওরা কোথায় জানো নাকি? এ প্রশ্নে কিছুটা চমকে উঠতে দেখলাম দিয়েগোকে। আমার আর প্রবালের এই কমন বন্ধু থাকতো লাস পামাস – দি গ্রান্ড কানারিয়া তে। ওরা নিজেদের কে কানারিয়ান বলে পরিচয় দেয়, স্প্যানিশ বলতে নারাজ, এই পরিচয় বিভ্রম নিয়ে ই দিয়েগোর সাথে আমার পরিচয়। সেও প্রায় বছর তিনেক আগে। এর মধ্যে যতবার এসেছি এখানে, ওর ব্যাচেলর এপার্টমেন্টে একবেলা না খাইয়ে ছাড়ে নি সে। বন্ধুদের কাছে খোলামেলা দিলদরিয়া এক মানুষ কিভাবে আবাসিক ম্যানেজমেন্টের কাজে সবাইকে খুশি রাখে সেটা দেখতে হলে দিয়েগোকে একদিন ধরে ওর অফিসে বসে দেখতে হবে। বয়সে আমাদের চেয়ে পনের বছরের বড় দিয়েগোর সাথে আমার আড্ডাটা বেশী জমতো, যখন আমি আমার বিশ্বব্যাপী ঘুরে বেড়ানো আর অডিট এর বিপত্তি নিয়ে গল্প করতাম।

আমাকে চিন্তিত দেখেই বোধহয় দিয়েগো সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলো। “জানো না কিছু? তোমার নাম্বার তো দিয়ে যাও নি যাযাবর, নইলে তোমাকেই আগে জানাতাম”। এক মুহুর্তের জন্য হলেও মনে হলো টলে উঠলাম। “কি হয়েছে প্রবালের? চারদিন আগে ও তো আমার সাথে কথা হলো, এর পরে ব্যস্ত হয়ে ওঠায় আর যোগাযোগ করা হয় নি”। এর পরে যা ঘটলো, তা আমি দিয়েগোর সাথে মেলাতে পারলাম না, ওকে কখনো দুঃখ করতে দেখি নি কোন কিছু নিয়ে, সে ই ফুপিয়ে কান্না শুরু করলো। “কি হয়েছে খুলে বলো” বলতেই কান্না থামিয়ে দিয়েগো যা বললো তা আমি আবার প্রবালের সাথে মেলাতে পারি নি এখনো। এক সপ্তাহ আগে প্রবালের বাসার রেন্টাল চুক্তি শেষ হওয়ায় ও নুতন বাসায় উঠে গেছে। যাবার সময় তাড়াহুড়োয় দিয়েগো ও নুতন বাসার ঠিকানা রাখতে ভুলে গিয়েছিলো। সস্তায় কিছু মুভার পাওয়া যায়, যাদের কোন অফিস নেই, এরকম এক মুভার ভ্যান নিয়ে বাসার সব জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। মুক্তা যাবার সময় দিয়েগোকে সোয়াচ এর একটা রিষ্টওয়াচ গিফট দিয়ে গেছে, আর টুকটুক দিয়ে গেছে আধো কান্নায় জড়ানো “বায় বায়”। জীবনের লম্বা সময় পার করে দেয়া দিয়েগো ও জানে বাস্তবতা, আর্থিক ইত্যাদী কারনে মানুষ বাসা বদল করে। কিন্তু এমন কোন যথেষ্ট কারন ছিলো বলে ওর ও মনে হয় নি এই বদলানোর সময়। “আমি বলেছিলাম, বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট কে বলে তোমার পার্কিং রেন্ট টা বাদ দেবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি”। প্রবাল নাকি বলেছিলো ফিল্ড ডাটা সংগ্রহ করার জন্য ওর পর্তুগালের কাছাকাছি গ্রামে থাকা দরকার লম্বা সময়ের জন্য। দিয়েগোর পরের কথা তে চমকে ওঠা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিলো না। পুলিশ এসে নাকি দিয়েগোকে অনেক প্রশ্ন করেছে প্রবালের মিসিং হওয়া প্রসঙ্গে, যার অনেক কিছুই প্রবালের দৈনন্দিন কাজের সাথে, চলার সাথে খাপ খায় না।

চলবে …………… বরুনা প্রবালের গল্প – ০২ তে

১,৩৬৭ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “বরুনা প্রবালের গল্প – ০১”

মওন্তব্য করুন : কাজী রফিক (৮১-৮৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।