আমার রাংগামাটি

আমার রাঙ্গামাটি।

আমার প্রথম রাঙ্গামাটি দর্শন নব্বই দশকের শুরুতে তরুণ বয়সে। সেটা ইয়ার বন্ধুদের সাথে কোন আনন্দ ভ্রমণ বা পর্যটন উপলক্ষ্যে নয়। আর সে বয়সে পরিবার নিয়ে নিরিবিলি ছুটি কাটানোর মত পরিবারও হয়ে ওঠেনি।

আমি রাঙ্গামাটি গিয়েছিলাম একান্তই চাকরির সুবাদে, অর্থাৎ পেটের দায়ে।

সেনাবাহিনীর পদাতিক কোরের কর্মকর্তা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি অনিবার্য জেনেও প্রথম বদলিতে আপ্লুত হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাইনি। দেশ রক্ষার কঠিন সংকল্পে উদ্বুদ্ধ হয়ে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম বললেও মিথ্যা বলা হবে। আমার ব্যাটেলিয়ানের বদলির সাথে সাথে আমার যাওয়া অবধারিত মেনে নিয়েই আমি গিয়েছিলাম।

ততদিনে শান্তি বাহিনী এক তরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও তখনো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি।
শান্তি বাহিনীর চোরা গোপ্তা হামলা, বিষাক্ত সাপ, বন্য হাতি, শূকর আর ম্যালেরিয়ার প্রকোপে পার্বত্য চট্টগ্রাম তখনো বিপদ সংকুল এলাকা।

প্রথমবার রাঙ্গামাটি থেকে কাপ্তাই লেকে কান্ট্রি‌ বোট যোগে ভীতি ও ক্লান্তিকর দীর্ঘ ‌নৌ যাত্রা শেষে গভীর রাতে লঙ্গদু উপজেলার মাইনি মুখ ক্যাম্পে পৌঁছেছিলাম। কাজেই রাঙামাটির সাথে আমার ঠিক প্রথম দর্শনেই প্রেম ধরনের কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি।

এরপর বিভিন্ন মেয়াদে আমার চাকরি জীবনের প্রায় অর্ধযুগ আমি পার্বত্য চট্টগ্রামে কাটিয়েছি। কাকতালীয়ভাবে প্রতিবারই আমার রাঙ্গামাটি জেলায় বিভিন্ন ক্যাম্পে বদলি হয়েছে। বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় আমার কখনো চাকরি করা হয়নি। কাজেই আমার কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম মানেই রাঙ্গামাটি।

বিভিন্ন মেয়াদে রাঙ্গামাটির দশটা উপজেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় রোদে পুড়ে, খরস্রোতা ছড়া আর বৃষ্টিতে ভিজে নদী, পাহাড়, জঙ্গল আর বাঙালি-পাহাড়ি জনপদে ঘুরে বেড়িয়েছি। রেংখিয়াং আর পাবলাখালি রেঞ্জের পাহাড়ে জঙ্গলে অগণিত রাত কাটিয়েছি।

ক্যাম্পে ‌রাতভর মশাল জ্বালিয়ে আর টিন পিটিয়ে বন্য হাতির দলের হামলা প্রতিহত করেছি। সন্ধ্যার মুখে পাহাড়ের ঢালে হরিণের পালকে ঘাস খেতে দেখেছি।‌ মানুষের চেয়ে উঁচু ঘাসে ছাওয়া পাহাড়ি পথে‌ বিশালকায় অজগরকে অলস শুয়ে থাকতে দেখেছি।‌‌ কখনো অসাবধানে সামনে পড়ে যাওয়া বানরের দলকে মুখ ভেংচে পালিয়ে যেতে দেখেছি।

জোনাকি জ্বলা,‌ ঝিঁঝিঁ ডাকা অন্ধকার রাতে‌ অবারিত আকাশে অগণিত তারার ঝিকিমিকি দেখেছি। দুর্গম ক্যাম্পে মাছ-মাংসের অভাবে শাকপাতা, শুকনো আলু, শুটকি আর খিচুড়ি খেয়ে কাটিয়েছি। উঁচু পাহাড়ের ক্যাম্পে জানলা খোলা রেখে ঘুমিয়ে সকালে অনাহুত মেঘের আগ্রাসনে বিছানাবালিশ ভিজে একসা হয়ে গেছে। জোঁক আর ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র হাতি পোকার আক্রমণে নাকাল হয়েছি অনেকবার। বিস্তীর্ণ সেগুনবাগানে নাম না জানা পাখির ডাকে চমকে তাকিয়েছি।

মাল্টি ব্যান্ড রেডিও, ব্যাটারি চালিত টেপ রেকর্ডার, পুরনো খবরের কাগজ আর বই, ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যারাম বোর্ড আর তাস খেলা ছিল বিনোদনের মাধ্যম। পরবর্তীতে সীমিত মোবাইল নেটওয়ার্ক আসার আগ পর্যন্ত একমাত্র যোগাযোগের ভরসা ছিল চিঠি, যা পৌঁছাতে অনেক সময় মাসখানেক লেগে যেত।

শীতে‌ নিস্তরঙ্গ আর বর্ষায় খরস্রোতা রেংখিয়াং নদী, চেংগি নদী, কাসালং নদী আর‌ কাপ্তাই লেকে দিনে রাতে কান্ট্রি বোট, স্পিডবোট বা লঞ্চে যাতায়াত করেছি। হেলিকপ্টার থেকে বিস্তীর্ণ জলরাশি আর‌ ঘন জঙ্গল আচ্ছাদিত পাহাড়ের ঢেউ খেলানো নীল-সবুজে একাকার হয়ে যাওয়া দেখেছি। কাপ্তাই লেকে বিশাল আকারের রুই, বোয়াল কাতল আর তেলাপিয়া মাছ সহ অসংখ্য প্রজাতির ছোট বড় মাছ ধরতে দেখেছি। তবে সময়ের পরিক্রমায় ইদানিং তেলাপিয়া মাছ আর সব মাছকে নির্বংশ করে ফেলেছে।

আমার বড় মেয়ের স্কুল শুরু হয়েছে কাপ্তাই স্কুলে, ছেলে মায়ের পেটে বড় হয়েছে আমি বিলাইছড়িতে থাকাকালীন, যখন আমার পরিবার থাকতো কাপ্তাই। ছোট মেয়ের জন্ম চট্টগ্রামে যখন আমার বদলি নানিয়ারচরে আর আমার পরিবার থাকতো চট্টগ্রামে। রাঙ্গামাটি আমার আর আমার পরিবারের সাথে মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে আছে।

১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যবর্তী দীর্ঘ সময়ে আমি চারবার রাঙ্গামাটিতে চাকরি করেছি, ক্রমশ যুবক থেকে মাঝ বয়সে পদার্পণ করেছি।

সেখানে বাঙালি এবং পাহাড়ি জনপদের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে। তাদের জীবন সংগ্রাম, কৃষ্টি, সংস্কৃতি খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।

পাহাড়ের ঢালে বিস্তীর্ণ আনারস বাগান, জুম খেত, চন্দ্রঘোনা কাগজের কলের জন্য মুলি বাঁশ সংগ্রহ আর তা নদীতে ভাসিয়ে পরিবহন, রাবার বাগানে রাবার আহরণ দেখেছি। সেই সাথে গহীন অভয়ারণ্যে দুষ্টচক্রের মূল্যবান সেগুন, গামারি গাছ কেটে সাবাড় করার আলামত দেখেছি।

পাহাড়ি বাঙালির আনন্দ, বেদনা আর সংঘাত নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছি।

রাঙ্গামাটির নদী, লেক, পাহাড়, জঙ্গল, উপত্যকা, আকাশ আর নির্মল বাতাস আমাকে সব সময় বিমোহিত করেছে।

আমি নিজ চোখে রাঙ্গামাটি শহরকে অনেক দূরের নিরিবিলি পাহাড়ি স্টেশন থেকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত হতে দেখেছি। সেই সাথে আধুনিক সভ্যতাকে নানান উপকরণে সজ্জিত হয়ে ক্রমান্বয়ে প্রকৃতির উপরে রাজত্ব কায়েম করতে দেখে হতাশ হয়েছি। পরবর্তীতে বেড়াতে গিয়ে রিসোর্ট, হোটেল বা রেস্ট হাউসের নামে চোখ ধাঁধানো কাঁচ ঘেরা, আধুনিক রং চংয়ে টাইলস মোড়ানো বেমানান স্থাপনা দেখে মর্মাহত হয়েছি। সেই সাথে কাপ্তাই লেকে মাইক বাজিয়ে উজ্জ্বল রঙিন নৌকায় নৌ ভ্রমণের আয়োজন দেখে বিরক্ত হয়েছি।

আমার কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি একটা বিশেষ স্থান। বাড়ি থেকে অনেক দূরে আরেকটা স্বপ্নের বাড়ি।

কখনো ভাবি, চাকরি তো শেষ। অবসর জীবনটা রাঙ্গামাটিতে নিরিবিলি কাটিয়ে দিলে কেমন হয়! যদিও জানি, জীবনের বাস্তবতায় সেটা হয়তো কোনদিন সম্ভব হবে না। তবুও স্বপ্ন দেখতে দোষ কি!

২৪ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “আমার রাংগামাটি”

  1. মেহেদী (০৭-১৩)

    সুন্দর লেখা। চট্টগ্রাম পোস্টিং থাকার কারণে প্রায় ই রাঙ্গামাটি ভ্রমণ হয়। সেখানে মোটরসাইকেল চালাতে যে পরিমাণ আনন্দ পাওয়া যায় তা বলে বুঝানোর মত না।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।