বিজ্ঞানীদের মতে, মোটামুটি চারশ কোটি বছর আগে এই পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের উৎপত্তি। আর সেই আদি প্রাণ থেকেই এসেছে আমাদের চারপাশের সমস্ত উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুল। সেই আদি প্রাণের উৎপত্তি কীভাবে ঘটল, সেটা নিয়ে এখনও পর্যন্ত তাঁরা কোন একটি নির্দিষ্ট ব্যাখ্যায় একমত হতে পারেননি। ব্যাপারটা এমনই গোলমেলে যে, উল্কাপাতের মাধ্যমে বহির্জগৎ থেকে আমাদের পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের আগমন ঘটেছিল, এটাও বিজ্ঞানের সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
আমার আজকের লেখাটা অবশ্য আদি প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে নয়, আদি প্রাণের বৈশিষ্ট্য নিয়ে। কেমন ছিল সেই জড় পৃথিবীর প্রথম জীবিত স্বত্ত্বাটি? খুব সহজেই একটা অনুমান করা যায়- এই আদি প্রাণটি খুব সরল প্রকৃতির ছিল, আজকের পৃথিবীর জীবকুলের মত জটিল ও বড় কাঠামোর কোন কিছু ছিল না। একদম যে বৈশিষ্ট্যগুলো নাহলেই না, কেবল সেগুলোই ছিল এর মধ্যে। কী সেই প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্তগুলো, যা দিয়ে আদি প্রাণকে চিহ্নিত করা যায়? বিজ্ঞানীরা জীব ও জড়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন। আসুন দেখা যাক, সেগুলোর মধ্যে একেবারে মৌলিক শর্তগুলো কী কী।
১) সীমানা: পড়তে খুবই আশ্চর্য লাগতে পারে, তবে জীবের (কিংবা এক্ষেত্রে আদি প্রাণের) প্রথম শর্ত হল একটা সীমানা, যেটা বাইরের জগৎ থেকে তাকে আলাদা করবে। সে একটা পৃথক স্বত্ত্বা। খুবই সাধারণ শর্ত। কারণ, অনেক জড় বস্তুরও সীমানা আছে।
২) ইঞ্জিন: দ্বিতীয় অত্যাবশ্যক শর্ত হল, একটা ইঞ্জিন- যেটা বাইরের শক্তিকে নিজের জন্য কাজে লাগাতে পারবে। যদি সেই কঠিন শব্দটা মনে করতে পারেন- সালোকসংশ্লেষণ, এটা হল সূর্যের আলো থেকে গাছের নিজের প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরির প্রক্রিয়া। একইভাবে আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, খাবার খাওয়া সবই এই বাইরের শক্তিকে নিজের কাজে লাগানোর ইঞ্জিনের অন্তর্ভুক্ত।
৩) জেনেটিক কোড: মাঝে মাঝেই খবরে দেখা যায়, পাটের কিংবা অন্য কোন কিছুর জীবন রহস্য আবিষ্কার। এর অর্থ কী? আসলে সহজ ভাষায়, পৃথিবীর সমস্ত জীবেরই একটা কোড আছে, যেই কোড অনুসারে তার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়। এই কোডটা থাকে DNA-এর ভিতর (কিছু কিছু ক্ষেত্রে RNA)। যেহেতু আদি প্রাণ থেকেই সকল প্রাণের উৎপত্তি, এজন্য খুব সরল প্রকৃতির হলেও এমন একটা কোড আদি প্রাণের মধ্যেও থাকতে হবে, যেই কোডের সাথে তার বাইরের বৈশিষ্ট্যের সরাসরি সম্পর্ক থাকবে। এই কোডকেই বলা হচ্ছে জেনেটিক কোড। আবার কোড বা সংকেত থাকার মানেই হল, তাকে ডিকোড করা বা অর্থ উদ্ধার ও প্রয়োগের একটা প্রক্রিয়া থাকা। সুতরাং, সেই আদি প্রাণের মধ্যে জেনেটিক কোডের পাশাপাশি সেটাকে ডিকোড করার একটা মেকানিজমও থাকবে, যেটা জেনেটিক কোডকে পড়ে তা অনুসারে জীবদেহের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করবে।
৪) বিবর্তন উপযোগী বংশবৃদ্ধি: বংশবৃদ্ধি জীবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য- যা একটি জীব থেকে একই ধরণের আরও এক বা একাধিক জীব তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া। সুতরাং, আদি প্রাণের ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য যে, জীবটির মধ্যে নিজের কপি তৈরি করার একটা মেকানিজম/প্রক্রিয়া থাকতে হবে। সুতরাং, এটাকেও একটা শর্ত ধরে নেয়া যায়। তবে কথা এখানেই শেষ না। এই বংশবৃদ্ধিটা হতে হবে বিবর্তন উপযোগী। এখন কথা হল, এই “বিবর্তন উপযোগী বংশবৃদ্ধি” বলতে কী বুঝানো হচ্ছে? বিজ্ঞানের প্রস্তাবনা অনুসারে, আদি প্রাণ থেকেই বিবর্তনের মাধ্যমে সমস্ত জীব-জগতের উৎপত্তি। আর এই বিবর্তন প্রক্রিয়াকে সম্ভব করতে হলে, বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় একটা ছোট্ট শর্ত যুক্ত হয়, যার সাথে জেনেটিক কোডের সবিশেষ সম্বন্ধ আছে। খুলে বলি। আমরা খুব সহজেই ধরে নিতে পারি- আদি প্রাণটি এককোষী। এককোষী জীবের বংশবৃদ্ধিটা আসলে ঐ কোষের বিভাজন। কোষ বিভাজনের সময় কোষটার জেনেটিক কোডেরও কপি তৈরি হবে। এই কপি হওয়ার সময় মিউটেশান(কপি এরর বলা যেতে পারে) ঘটার সম্ভাবনা থাকতে হবে। আবার সেই জেনেটিক কোডের মিউটেশানের ফলাফল কোষ/জীবের বাকী অংশের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রকাশ পেতে হবে। এটাই শর্ত। বায়োলজির ভাষায় বললে, মিউটেশানের ফলে জেনোটাইপে আসা পরিবর্তন ফেনোটাইপে প্রকাশ পেতে হবে। বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে প্রকাশ পেলে, তবেই বিবর্তনের বাকী প্রক্রিয়া চলতে পারবে। নয়ত না।
এই হল মোটামুটি, আদি প্রাণের অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য। এখানে আরেকটি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল- কৃত্রিম প্রাণ বা সিনথেটিক লাইফ তৈরির জন্যও এই একই শর্ত প্রযোজ্য। বিজ্ঞানীরা এনিয়ে কাজ করছেন এবং বেশ কিছু শর্ত পূরণ করেছেনও। তবে একেবারে জড় উপাদান থেকে প্রাণ তৈরি হওয়া (Abiogenesis), যেটাকে আদি প্রাণের আরেকটি শর্ত ধরে নেয়া যেতে পারে (কারণ এর আগে কোন প্রাণ ছিল না), সেই প্রক্রিয়া এখনও বিজ্ঞানের কাছে অধরাই বলতে হবে। চলুন দেখা যাক, ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে।
লেখাটার মূল ভাব নেয়া হয়েছে বিখ্যাত নোভা সায়েন্স সিরিজ থেকে-
http://www.pbs.org/wgbh/nova/sciencenow/3214/01-make-nf.html
কঠিন বিষয় খুব সহজ করে বলা। ভালো লাগলো
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
ধন্যবাদ ভাইয়া মন্তব্যের জন্য।
বিষয় কঠিন, তবে পড়ার সময় ততটা কঠিন মনে হলোনা।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
লেখাটা খুব ভাল লাগলো গুলশান।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
আবারো কঠিন একটা বিষয়কে বেশ সহজ করে বললে গুলশান :boss:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আমার মনে হয়, যেটা সহজ করে বলা যায়, সেটা আসলেই সহজ। আমরা নিজেরা কঠিন বানিয়ে নেই। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া।
এইরকমের সরল একটা বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করাটা আমাকে খুবই মর্মাহত করে।
এখানে কেউ তা করছে না দেখে সবিশেষ প্রীত হলাম। জানি না এই প্রীত হওয়াটা কতক্ষন ধরে রাখা যাবে...
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
আমি মনে করি, প্রশ্ন করা এবং বিতর্ক করা জ্ঞান চর্চার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় এবং স্বাস্থ্যকর একটি বিষয়। আমার এই পোস্টে যদি কোন বিতর্ক এসে উপস্থিত হয়, আমার কোন সমস্যা নাই। শুধু বলব, বিতর্কের স্কোপ যেন আমার এই লেখার স্কোপের মধ্যেই থাকে, বাইরে না যায়। আর দ্বিতীয়ত, "আরও জানা"-র উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক করা হলেই কেবল জ্ঞান বাড়বে। নয়ত প্রশ্ন আসবে, বিতর্ক হবে, সেথেকে ঝগড়া হবে। কিন্তু কারও কোন লাভ হবে না। সবাই নিজের জায়গাতেই অনড় থাকবে। প্রসঙ্গত বলি, এই লেখার মধ্যে ভুল থাকলে এবং সেটা ধরিয়ে দিলে, ভুলটা মেনে নিতে আমার কোন সমস্যা নাই।
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
প্রশ্ন করা, বিতর্ক করা আর বিতর্ক সৃষ্টি করাটা এক নয়। কারনঃ
"বিতর্কের স্কোপ যেন আমার এই লেখার স্কোপের মধ্যেই থাকে, বাইরে না যায়।"
বিতর্ককারী, প্রশ্নকারী স্কোপের মধ্যে থাকে, বিতর্ক সৃষ্টিকারী তা থাকে না। সে বরং তোমাকে টেনে নেবে তাঁর সংজ্ঞায়িত স্কোপের মধ্যে।
সেই ক্ষেত্রে করনীয় কি?
আমি যেটা করি: Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
যাহোক ভাল লাগলো কথা বলে... (সম্পাদিত)
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
"বিতর্ক করা আর বিতর্ক সৃষ্টি করাটা এক নয়।"- ঠিক বলেছেন ভাইয়া। আমি নিজে করণীয় পরিস্থিতি অনুসারে ঠিক করার চেষ্টা করি। আমাকে অবশ্য খুব বেশি বিতর্কে জড়াতে হয়নি।