আমাদের যখন ১২ বছর বয়স, বাবা-মাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূর। ক্যাডেট কলেজে পড়তে গিয়েছিলাম। আমাদের সেই অভিভাবকহীন দিনগুলোতে কলেজের শিক্ষকরাই ছিলেন বাবা-মা। তাঁরা আমাদের যতই ভালোবাসুন না কেন, বাবার-মায়ের অভাব পূরণ করতে কখনোই পারতেন না। ক্যাডেট কলেজের কঠোর জীবনের মাঝে, প্রায় সব ক্যাডেটই তাদের পিতা-মাতাকে চিঠি লিখতো, সারা সপ্তাহ সবাই অপেক্ষা করতো বাবা কিংবা মায়ের কাছ থেকে চিঠি পাবে বলে।
আমার জন্য অবশ্য ব্যাপারটি অন্যরকম ছিল। বাবা ঝিনাইদাহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক ছিলেন। বাবা পদার্থবিদ্যা পড়াতেন। সে সুবাদে আমার পিতা-মাতা কলেজ ক্যাম্পাসেই থাকতেন। ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে আমি তাদের সঙ্গেই ক্যাম্পাসে থাকতাম।
বাবার সঙ্গে আমার প্রতিদিন কথা হয়তো হতো না, তবে দেখা হতো। মা থাকতেন এক মাইল দূরে, কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হতো না। সপ্তাহের শেষে সিনেমা দেখতাম কলেজের মিলনায়তনে। হাউস থেকে মার্চ করে এসে হলে ঢোকার পথে মাকে দেখতাম দাঁড়িয়ে আছে দূরে; সেও আমায় এক ঝলক দেখতে চাইতো। বাবা-মা এতো কাছে থাকার পরও মনে হতো তাঁরা আলোকবর্ষ দূরে। আমার খুব ইচ্ছে করতো মায়ের কাছে চিঠি লেখি। মা আমার চিঠি পড়বে; তারপর উত্তর দেবে। একবার লিখেও ফেললাম।
ক্যাডেটদের চিঠিগুলো লেখার পর আগে হাউস-মাস্টার অথবা হাউস টিউটর পড়তেন তারপর সেগুলো পোস্ট করা হতো। ক্যাডেটদের নামে আসা চিঠিগুলোও একইভাবে আগে আমাদের শিক্ষকরা পড়তেন তারপর আমাদের দিতেন।
ভর্তি হয়েই কলেজের লাইব্রেরি আমার খুব প্রিয় একটি স্থান হয়ে গিয়েছিল। লাইব্রেরিতে সময় কাটিয়ে আমি জেনে গেছি যে চিঠি লেখা একটি শিল্প। অনেক বড়-বড় সাহিত্যিক চিঠি-রূপে তাদের গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। তাদের লেখা চিঠিগুলো বিশ্বজুড়ে সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। চিঠি লেখা আমার মনে একটি বড় স্থান দখল করে ফেলেছিল। মা এক মাইল দূরে থাকলেও একদিন তাকে চিঠি লিখে হাউস-মাস্টারের দফতরে জমা দিলাম। রাতের খাবারের পর তিনি ক্যাডেটদের চিঠিগুলো দেখতেন। মায়ের কাছে লেখা আমার চিঠি দেখে তিনি আমায় ডেকে পাঠিয়ে হেসে জানতে চাইলেন, ‘এই বোকা, তোমার মা’তো কাছেই থাকেন! তুমি তাকে চিঠি লিখেছো কেন!’ আমি তাকে বুঝিয়ে বলায় তিনি বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, তোমার চিঠি পোস্ট করতে হবে না। আমিই তোমার চিঠি নিয়ে যাচ্ছি, আজ রাতেই তোমার মাকে দিয়ে দেবো’।
স্যারকে অনুরোধ করেছিলাম তিনি যেন হাতে করে নিয়ে না যান; বরং সবার চিঠির মতো আমারটিও পোস্ট করেন দেন। তিনি তাই করেছিলেন। চিঠি পেয়ে মা অবাক হয়েছিলেন, তবে খুব খুশিও হয়েছিলেন। তবে মা জানতে চায়নি এতো কাছে থাকার পরও আমি কেন তাকে চিঠি লিখেছিলাম। আমি অবশ্য মাকে চিঠি লেখার কারণ খুলে বলেছিলাম।
চিঠি লেখা আমি এতোই পছন্দ করতাম যে একবার কুষ্টিয়ায় আমার মামাতো বোনকে চিঠি লিখলাম। আমরা এক বয়সের ছিলাম। সে ছিল নানার পুরো পরিবারের মধ্যে আমার একমাত্র বন্ধু। দুর্ভাগ্যবশত আমার চিঠি যখন কুষ্টিয়ায় তার নামে আমার নানা-বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছায়, সে বাড়ির সবাই ভেবে নিল আমি তার প্রেমে পড়েছি। অথচ প্রেমের ছিটে-ফোঁটাও সে চিঠিতে ছিল না। অনেক কথা হলো, শাসন হলো, আমায় অনেক বকাঝকা করা হলো। আমার বাবা-মা ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করলো না যে আমি তার প্রেমে পড়িনি।
ক্যাডেট কলেজের জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, বন্ধুদের ছাড়া থাকা মুশকিল হতো। কলেজে টার্ম শেষে ছুটিতে বাড়ি গিয়ে বন্ধু-বিহীন সময় কাটাতে আমাদের ভালো লাগতো না। আমরা তখন আমাদের বাবা-মার অনুপস্থিতিতে আর ব্যথিত হতাম না; বরং বন্ধুর অনুপস্থিতিই আমাদের কষ্ট দিত। একমাস ছুটির এক-একটি দিন এক-একটি বছরের মতো মনে হতো। সে যাতনা কাটাতে আমরা একে-অপরকে চিঠি লিখতাম।
আমাদের অনেকেরই প্রেমিকা ছিল। ক্লাস নাইনে ওঠার পর আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভালোবাসা-ভালোবাসা ভাব চলে আসলো। বাড়ি যেখানেই হোক, গ্রামে বা শহরে, প্রায় সবাই চেষ্টা করতো প্রেমের মানুষ খুঁজে পেতে। কারো প্রেম হতো, কারো কিছুটা হতো, বেশির ভাগেরই একেবারেই হতো না। তবে যাদের হতো, তাদের কাছে ভালোবাসার মানুষটির চিঠি আসত। কিন্তু আসবে কী করে? চিঠিতো যাবে একেবারে হাউস-মাস্টারের হাতে। প্রেমপত্র পেলে নির্ঘাত কলেজ থেকে বের করে দেবেন! তবে চিঠি না লিখতে পারলে কি মনে শান্তি আসবে? চিঠি লেখা চলতো।
চিঠি প্রেমিকের ঠিকানায় আসতে দেওয়া যাবে না। অন্য ঠিকানায় আসতে হবে। সে ব্যবস্থাও ছিল। আমাদের প্রতিটি হাউসে একজন হাউস বেয়ারা ছিলেন। বেশিরভাগ প্রেমিকের চিঠি আসতো তাদের বাড়ির ঠিকানায়। চিঠি যেতো তাদেরই মাধ্যমে। আমার ব্যাচের প্রেমিক-বন্ধুরা আবার হাউস বেয়ারার মাধ্যমে চিঠি পাঠানোর ঝুঁকি নিতো না। ক্যাডেট নয় আমার এমন একজন বন্ধু ছিল ক্যাম্পাসেই। তার ঠিকানাই ব্যবহার করতো আমার ক্লাসের প্রেমিকরা। সে প্রতিদিন মসজিদে আসতো মাগরিবের নামাজ পড়তে। নামাজ পড়া আসল উদ্দেশ্য ছিল না। সঠিক প্রেমিকের হাতে সঠিক প্রেমিকার চিঠি পৌঁছে দেওয়াই ছিল তার লক্ষ্য। বিনিময়ে আমাদের প্রেমিকরা তাকে সিগারেট খাওয়াতো। সে তাতেই খুশি।
এক-এক জনের চিঠি যখন আসতো, আমাদের খুশি দেখে কে! ঈদের আনন্দ পেতাম। চিঠি আমাদের বন্ধুকে খুলতে দিতাম না। আমরাই খুলতাম। একজন সুর করে পড়তো এবং আমরা সবাই শুনতাম। কিছু-কিছু পত্র বিশেষ কাগজে লেখা এবং সুগন্ধি মাখানো থাকতো; আবার কিছু চিঠির ভেতর ফুলের আধা-শুকানো পাঁপড়ি থাকতো। প্রেমিকের কাছে এই ফুলের মূল্য ছিল আকাশ-ছোঁয়া। তারা ওগুলো বালিশের ভেতর রেখে দিয়ে আকাশ-কুসুম ভাবনায় ডুবে যেত।
চিঠি লেখার আরো আনন্দ ছিল। আমরা অন্য ক্যাডেট কলেজের সমবয়সীদের সঙ্গে ‘পত্রমিতালী’ করতাম। কী রকম কাগজ ব্যবহার করবো তা ছিল একটি বড় চিন্তা। প্রথমেই পত্রের কাগজ এবং তার ওপর নক্সা দেখে যাকে লিখছি তার ভালো লাগতে হবে। অনেকে পুরু ট্রেসিং পেপারে লিখতো; অনেকে আবার নানা রকমের রঙিন কাগজে; কেউ বায়োলজি ব্যবহারিক খাতায় ছবি আঁকার শক্ত কাগজ দু’ভাগ করে পাতলা করে নিত।
আমি পছন্দ করতাম টাইম বা নিউজউইক পত্রিকার বিজ্ঞাপনের পাতাগুলো। খুব গাড়ো রঙের বিজ্ঞাপন না থাকলে, সেগুলোই খুব চিঠি লেখার সুন্দর কাগজ। এরও অনেক বছর পর, আমার স্ত্রীকে [তখনও আমরা ঘর বাঁধিনি] যখন লিখতাম, তখন আমার সৃজনশীলতার কোনও সীমা ছিল না।
এখন আর কাউকেই চিঠি লিখতে দেখি না, প্রেমপত্র লিখতে দেখি না, মায়ের চিঠির জন্য অপেক্ষা করতে দেখি না। ইমেইল আবিষ্কারের সঙ্গে-সঙ্গেই চিঠি লেখার প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে ফুরিয়ে এসেছে। আমার যতদূর মনে পড়ে বাংলাদেশে ইন্টারনেট এসেছিল ১৯৯৪ সালে; আমি নিজে প্রথম ইমেইল অ্যাড্রেস খুলেছিলাম ১৯৯৫ সালে। সেই সময় থেকেই আমার জীবনে চিঠি লেখা ইতিহাস হয়ে গেছে। তারপর থেকে আমি অন্তত এক হাজার চিঠি লিখেছি কিন্তু সবই ছিল ইলেকট্রনিক চিঠি। যখনই পাঠিয়েছি মুহূর্তের মধ্যেই পৌঁছে গেছে প্রাপকের কাছে। সবাই খুব আনন্দ পেলো, কিন্তু চিরদিনের জন্য হাজার বছরের কাগজের চিঠি হারিয়ে গেলো কালের গর্ভে।
বিশ্বে অনেক বিখ্যাত গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে চিঠির আকারে। চিঠির আবেদন ছিল বলেই সাহিত্যিকরা এমন স্টাইলে তাদের লেখা লিখে গেছেন। ইমেইল আকারে কি সাহিত্য রচনা সম্ভব? হয়তো সম্ভব; এখনও দেখি লেখকরা চিঠি আকারেই তাদের গল্প-উপন্যাস লেখেন।
এমন করেই কেটে গেলো কয়েক বছর। তারপর এলো মোবাইল ফোনের এসএমএস বা ক্ষুদে-বার্তা সার্ভিস। মানুষে-মানুষে প্রতিদিনের যোগাযোগ সারা বিশ্বজুড়ে এই ক্ষুদে-বার্তার মাধ্যমেই শুরু হলো। আবেগ, রাগ, ভালোবাসা – সবই এসএমএসে চলতে থাকলো। এখনকার প্রেমিক-প্রেমিকাদের ভালোবাসার গল্প-কথা চালাচালি হয় ইমেইল ও এসএমএসে।
আমার মনে আছে ‘৭০, ‘৮০ এবং ‘৯০য়ের দশকে, কিংবা তারও আগে, একই পাড়ায় বসবাসকারী প্রেমিক-প্রেমিকাও চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করতো। ছোটবেলার গল্প আরেকটি বলি। তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পাসের এক বড়-ভাইয়ের তার ক্লাসের একজন তরুণীকে ভালো লেগে গেলো। বলতে পারছেন না তাকে। শেষে চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু চিঠি দেবেন কী করে? আমায় এসে বললেন, আমি যদি মেয়েটির হাতে তার চিঠি পৌঁছে দিতে পারি তাহলে আমায় চার’ আনার ডালপুরি খাওয়াবেন। জীবনে সেই প্রথম আমি ডালপুরি খেয়েছিলাম – চার আনায় ৪টা।
কাগজের চিঠিতে শেষ পেরেকটি গাঁথলো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। সবাই যোগাযোগ করছে এই মাধ্যমে। হাজার বছরের পত্রশিল্প পৃথিবী থেকেই হারিয়ে গেলো। দেশে দেশে পোস্ট অফিসগুলো হয় এখন কুরিয়ার সার্ভিসের অথবা অর্থ লেনদেনের সংস্থায় পরিণত হয়েছে।
পত্রশিল্প হারিয়ে গেছে। সবাই নতুন মাধ্যমে যোগাযোগ করছে। যোগাযোগ চলছেই এবং চলবে। কিন্তু যে আবেগ মানুষ কাগজ-কলম দিয়ে প্রকাশ করতে পারতো, জানি, সেই আবেগ আর ফিরবে না। আমাদের সন্তানেরা জানবেই না, কাগজের পাতায় কত কথা কত ভাবে বলা যায়!
ক্যাডেট কলেজগুলোতে হয়তো এখনো চিঠির প্রচলন থাকলেও থাকতে পারে; আমি জানি না। শুনেছি ক্যাডেটরা এখন তাদের বাবা-মার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারে ও সপ্তাহে একদিন ইমেইল করতে পারে।
দেখি, ঝিনাইদাহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষকে চিঠি লিখে জানতে চাইবো- কাগজের চিঠি।
http://www.banglatribune.com/columns/opinion/250317/%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A0%E0%A6%BF
চিঠি লিখেছিলেন? উত্তর মিলেছিল?
আমার নিজেরও চিঠি লেখা অনেক পছন্দের ছিল। পুরো লেখাটা পড়তে পড়তে অনেক স্মৃতি চলে এলো মনে। মন্তব্য লিখতে গিয়েও ভাবছি সেগুলোই, মাথা থেকে যাচ্ছে না।
www.tareqnurulhasan.com