সৈয়দ হককে মনে পড়ে

খবরটি শুনেই মনে হয়েছিল একসাথে হাজার তারার আগুন বুকের ভেতর ছুরি হয়ে বিঁধেছে। নিজেকে আকাশের মতো একা মনে হলো, মানুষ জন্মের আগে পৃথিবী যেমন একা ছিল, তেমনই একা মনে হয়েছিল। তিনি চলে গেছেন এ বাস্তবতাটি মেনে নেয়া আমার জন্য কঠিন ছিল। জানি না কেন। আমরা সবাই জানতাম তিনি চলে যাচ্ছেন; ডাক্তাররা তাই-ই বলেছিলেন। বললেই বা কী! ওনাকে কীভাবে যেতে দেই? এমন মানুষকে যেতে দেয়া যায় না।

তাঁকে হূদয় থেকে ভালোবাসেন—এমন মানুষের অভাব নেই। এঁরা কি তাঁর চলে যাওয়া মানতে পেরেছেন? আমি পারিনি। আমরা কি নিজেদের তাঁকে যেতে দেয়ার জন্য তৈরি করেছিলাম? এমন মানুষ বোধহয় বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে আর জন্ম নেবেন না। আমি অন্তত তাঁর প্রস্থানের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

তাঁকে আমি কোনোদিন বলিনি তাঁকে আমি গুরু বলে মেনে চলতাম। এখন মনে হয় বলা উচিত ছিল। মানুষটি আমায় লেখা নিয়ে যত শিখিয়েছেন, ততটা আর কারো কাছ থেকে শিখিনি। দেখা হলেই একটি বাক্য বলতেন। ‘শোন ইকরাম, বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে আর কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা লেখার টেবিলে বসা।’ দেখা হলেই একথা বলতেন।

তাঁর এই বাক্যটিই আমার সাহিত্যজীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। তাঁর এই কথাটি মনে রেখেই আমি আমার প্রথম উপন্যাস লিখেছিলাম।

তাঁর সাথে পরিচয়ের অনেক অনেক আগে, তাঁকে চিনেছিলাম তাঁর ‘নীল দংশন’ পড়ে। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ লাইব্রেরিতে তাঁর অনেক বই ছিল। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়লাম ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘যুদ্ধ এবং যুদ্ধ’ ও ‘খেলারাম খেলে যা’। ‘ঈর্ষা’ নাটক দেখে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম নাটক লিখব বলে।

তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে থাকত। সবার ভেতর কেমন যেন শেকল-ছেঁড়া উদ্যম, বিপ্লবী উদ্দীপনা। আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম ক্লাসরুমের চেয়ে আমায় বেশি সাহিত্য শিখিয়েছে। ক্লাসে বসে আমি সাহিত্যের মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারিনি; তাঁর লেখা সাহিত্যকে আমার মনের ভেতর একটি মর্যাদার আসনে বসিয়েছে।

সে-সময় তাঁকে দেখেছি দূর থেকে—তিনি হয়তো কোনো সাহিত্য-মঞ্চে কথা বলছেন, আমি শুনেছি। সাহস হয়নি তাঁর সাথে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলার। অবশেষে তাঁর সাথে মুখোমুখি দেখা হলো বহুবছর পর। তখন আমি ঢাকায় ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনে কাজ করি। ভোরের অনুষ্ঠানে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসতাম; তিনি সংবাদ বিশ্লেষণ করতেন। সেই থেকেই তাঁর সাথে চেনা-জানা। তখন থেকেই জীবন নিয়ে, মানুষ নিয়ে, জগত্ নিয়ে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি সম্পর্কে আমার জানার শুরু।

সখ্য গড়ে উঠল। পারিবারিক পর্যায়ে বন্ধুত্ব হলো। তাঁকে আরো গভীরভাবে জানলাম। তাঁকে নিয়ে আগ্রহ আরো বাড়ল। লেখক-জীবনের প্রথম দিকে লেখা তাঁর সাহিত্যকর্মগুলো আমি পড়ে ফেললাম।

বিবিসি’র চাকরি ছেড়ে আমি যোগ দিলাম আইস মিডিয়াতে পাঁচটি মাসিক পত্রিকার দ্বায়িত্ব নিয়ে। সেখানে তিনি ছিলেন সম্পাদকীয় উপদেষ্টা। আরো কাছ থেকে তাঁর সাথে মেশার সুযোগ হলো। এবারে তাঁর কাছ থেকে আমি শিখতে চাইলাম।

আমার আগ্রহ দেখে তিনিও সম্মত হলেন আমায় শেখানোর। পাঁচটি পত্রিকার মধ্যে ‘বেঙ্গল বারতা’ তাঁর বেশি পছন্দের ছিল। ‘বেঙ্গল বারতা’ শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক।

সাংবাদিকতা আমায় খবরের মানুষ হিসেবে তৈরি করেছে, খবর সম্পাদনা করতে শিখিয়েছে। কিন্তু কী করে শিল্প-সাহিত্যের লেখা সম্পাদনা করতে হয়, কীভাবে এ বিষয়ে একটি পত্রিকা বের করতে হয়—এই মানুষটি আমায় তা হাতে-কলমে শিখিয়েছেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ দেয়ার মতো সঠিক শব্দ বা বাক্য খুঁজে পাইনি; এখনো পাচ্ছি না।

ঠিক এ-সময়েই আমি আমার প্রথম উপন্যাস ‘এক দুষ্টু ক্যাডেটের গল্প’ লিখে ফেললাম। তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম পাণ্ডুলিপিটি একবার পড়তে। তাঁর ব্যস্ততায় সময় দিতে পারেননি। তবে তিনি আমায় বোঝাতে পেরেছিলেন তিনি লেখক হিসেবে আমার কাছ থেকে কী এবং কতটুকু আশা করেন, আমায় তিনি কেমন লেখক হিসেবে দেখতে চান।

উপন্যাস লেখার পর প্রায় তিন বছর ফেলে রেখেছিলাম। প্রকাশ করার মতো কাউকে পাইনি। দু’ হাজার পনের সালের ফেব্রুয়ারিতে অণ্বেষা প্রকাশন থেকে আমার উপন্যাস প্রকাশিত হলো। আকাঙ্ক্ষা ছিল কোনো বড় লেখক আমার উপন্যাসটির মোড়ক উন্মোচন করবেন। আমি অনেক লেখকের কথা ভেবেছি, কিন্তু সৈয়দ হকের কথা নয়। তিনি আসবেন আমার বই উদ্বোধন করতে! যাহ, তা হয় নাকি! তাঁর কথা তো ভাবাই যায় না। এমন পুঁচকে-ছিঁচকে লেখকের বই উদ্বোধন করবেন তিনি!

যা আশা করিনি, তাই-ই ঘটল। আমার বন্ধু শাকুর মজিদ ক্যাডেট কলেজ ক্লাব চত্বরে এক বইমেলায় ২০১৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি দিনে সৈয়দ হক এবং আনোয়ারা সৈয়দ হকেকে নিয়ে এলো প্রধান অতিথি করে। এই ক্লাবটি প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে তাদের প্রাঙ্গণে বইমেলার আয়োজন করে। যিনি বা যারা প্রধান অতিথি হয়ে আসেন, তিনি বা তাঁরাই ক্লাবের সদস্যদের প্রকাশিত নতুন বই উদ্বোধন করেন।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমায় দুজনের মাঝে দাঁড় করিয়ে সৈয়দ হক এবং আনোয়ারা সৈয়দ হক আমার ‘দুষ্টু ক্যাডেটের গল্প’র মোড়ক উন্মোচন করলেন। এর চেয়ে গৌরবের মুহূর্ত আর কী হতে পারে? আমি জানি এমন মধুর মুহূর্ত আর কোনোদিন আসবে না। তবে এও জানি আমার মনের গহিন থেকে তিনি চলে যাননি, কখনো যেতে পারেন না, আমি যেতে দেবো না।

৫,৮৬৪ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।