কাজের কারণে দেশের নানা জেলায় যেতে হয়। কখনও রেলগাড়িতে, কখনও বাসে, কখনও বিমানে। দু-তিন দিন করে থাকাও হয়। হোটেলে থেকে কাজ করা বেশ অন্যরকম অভিজ্ঞতা। হোটেলগুলোর স্থাপত্যকলা চমৎকার, থাকার রুমগুলো ঝকঝকে, আসবাবপত্র অপূর্ব, গোসলখানা আরামদায়ক! সুইমিং পুল আছে, শরীরচর্চার জন্য জিম আছে। কোথাও-কোথাও আবার বারও আছে। মনে হয় পারলে হোটেলেই থেকে যাই। ঢাকায় ফেরার দরকার নেই।
তবে প্রায় প্রতিটি হোটেলেই আপ্যায়নের অভাব। আর এতেই ভাটা পড়ে আমার উৎসাহে। আতিথেয়তার মূল বিষয়গুলোই চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে দেখে কষ্ট পাই বেশ।
সিলেটে এক তিন-তারকা হোটেলে ঢুকে দেখলাম অতিথির জন্য অনেক কিছু রাখা। জায়নামাজ, পানির গ্লাস ইত্যাদি। সারাদিন ভ্রমণের পর দিনশেষে ক্লান্ত। কেবিনেটে দেখলাম একটা ইলেকট্রিক কেটলি। ভাবলাম চা-কফি খাই। আধা লিটারের দু’বোতল পানি আছে টেবিলের ওপর। কিন্তু চা-কফি বা চায়ের কাপ কোথাও খুঁজে পেলাম না। সাধারণত অতিথিদের জন্য দু’টি টি-ব্যাগ আর কফির স্যাশে থাকে এ ধরনের হোটেলে। আমার রুমে সেসব নেই। রুম-সার্ভিসকে কল দিলাম। উৎসাহে দু’জন ছুটে এলেন।
‘স্যার, আপনার জন্য কী করতে পারি?’
‘ইলেকট্রিক কেটলিটা এখানে কেন?’
‘স্যার, আপনি চা খাবেন, কফি খাবেন।’
‘তো, চা কই, কফি কই? চা-কফি খাওয়ার কাপ কই?’
‘স্যার, ভুল হয়ে গেছে! এক্ষুণি এনে দিচ্ছি।’
আমার এক সহকর্মী ছিলেন অন্য আরেক রুমে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম তার রুমে চা-কফি আছে কিনা। তিনি বললেন ‘না নেই’। এত সুন্দর হোটেলে থাকার ইচ্ছেটাই চলে গেল। বিশেষ করে দিনশেষে যখন আমাকে অনেকগুলো টাকা গুনতে হবে। মনটা দমে গেল। নাহ, এরপর এলে এ হোটেলে আর থাকা যাবে না।
পরদিন সকালে রেস্তোরাঁয় গেলাম নাস্তা করতে। ডায়াবেটিস থাকায় দু’টো কুসুমবিহীন ডিমপোচ আর একটু ভাজি খেয়ে কফি নিয়ে জানতে চাইলাম, ‘ডায়াবেটিক চিনি আছে?’ উত্তর এলো, ‘স্যার, নেই। কাল রাতে শেষ হয়ে গেছে; আর আনা হয়নি।’
মনে মনে বললাম, এত সুন্দর স্থাপনা বানিয়েও আপ্যায়ন শিখতে পারলাম না আমরা! আমার বাসায় মেহমান এলে আমি এর চাইতে ভালো আপ্যায়ন করতে পারবো। কার কী লাগবে, তা আগে থেকে ভেবে সব ব্যবস্থা করতে পারবো। সারা দেশের হোটেলগুলোর কি এই একই অবস্থা? তাই যদি হয়, তাহলে আমাদের হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা ভালো না। অনেক শেখার বাকি।
এরপর আমার ঠিকানা হল খুলনার একটি হোটেলে। সেটাও তিন-তারকা গোছের। ঝকঝকে সুন্দর। সাড়ে চার হাজার টাকা ভাড়া প্রতি রাতের। সকালে নাস্তা করতে গিয়ে দেখলাম শুধু পরোটা, ভাজি আর ডিম। রুটি নেই, পাউরুটিও নেই। ডিম পোচ করিয়ে ভাজি খেয়ে কাজে বেরুলাম। সকালের কাজ সেরে দুপুরে ফিরে হোটেলের রেস্তোরাঁয় গেলাম খাবারের খোঁজে। বিশাল এক রেস্তোরাঁয় দু’তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই। বসে রইলাম পনেরো মিনিট। ওয়েটারের দেখা নেই। একজনকে পেলাম। তিনি বললেন, পরোটা-মাংস দিতে পারবেন, একটু অপেক্ষা করতে হবে। রাজি হলাম। বসে রইলাম ঝাড়া চল্লিশ মিনিট। তারপর তিনি যা নিয়ে ফিরলেন তা খাওয়ার যোগ্য নয়। ভাবলাম, ‘এ হোটেলেও আর নয়।’
চললাম কক্সবাজার আর চট্টগ্রামে। সেখানে কয়েক মাসে বেশ গোটা চারেক হোটেলে থাকলাম। চট্টগ্রামের এক হোটেলে উঠে দেখলাম চা-কফি আছে কিন্তু পানি গরম করার কেটলি নেই। যতবার চা-কফি খেলাম প্রতিবারই ওয়েটার ডেকে গরম পানি আনিয়ে খেতে হল। তবে নাস্তার রেস্তোরাঁয় গিয়ে বেশ ভালোই লাগলো। সব ধরনের অতিথির জন্য কিছু না কিছু আছে। একপাশে পরোটা-রুটি, ডিম, মাংস। আরেকপাশে দেখলাম পাউরুটি ও ওটস-কর্নফ্লেক্স কর্নার। অন্যদিকে আবার ফ্রাইড-রাইস আর চিকেন-সবজি। বেশ, বেশ! তবে বিড়ম্বনা বাঁধলো চা খেতে গিয়ে। এখানেও যথারীতি মিলল না ডায়াবেটিক সুগার।
মনে মনে চিৎকার করলাম, ‘কেন যে এরা সবার কথা চিন্তা করে না! ডায়াবেটিক চিনি এখন দুনিয়ার সব হোটেলগুলোতেই থাকে।’
কক্সবাজারে গিয়ে ‘সি-সাইড রুম’ বলে আমায় যা দিল সেখান থেকে সমুদ্র দেখাই যায় না। এবার আমি বাড়ি থেকেই চা-কফি, ডায়াবেটিক চিনি নিয়ে বের হয়েছি। শুধু গরম পানিটা চেয়ে নিতে হয়েছিল।
উত্তরের জেলা রংপুরের সরকারি মোটেলে এক রাতে আসার পর গোসলখানায় দেখলাম সাবান নেই। কেন যে বাড়ি থেকে সাবানটাও নিয়ে এলাম না! ফোন করে ওয়েটারকে আসার অনুরোধ করলাম। তিনি এলেন আধাঘণ্টা পর। রাতে শুয়ে ভাবলাম এসব কি শুধু আমার ভাগ্যেই ঘটছে? নাকি সবাইকে এ পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হয়? আমি জানি না। তবে আমার মনে হয় দেশে পর্যটনের উন্নয়নের কথা গত চুয়াল্লিশ বছর ধরে বলে যাচ্ছি, অনেক কিছু করেও যাচ্ছি, কিন্তু পর্যটক বা অতিথিদের ভালোলাগার ব্যাপারটা একেবারেই চিন্তা করছি না।
অতিথি আপ্যায়নের কিছু সূক্ষ্ম ব্যাপার আছে যা দালান-কোঠা বা সাজ-সজ্জা দিয়ে হয় না। গভীরে গিয়ে চিন্তা করতে হয়। আতিথেয়তা এবং আপ্যায়ন একটা ফুলের মালার মতো, যেটা গাঁথতে হয় এক সুতোয়। কোনও একটা ফুল না গাঁথা হলে মালা পূর্ণ হয় না। চায়ের কথা বলে কেটলি থাকবে না, বা কেটলি রেখে চা দেব না–এমন করলে অতিথিদের মন অপূর্ণই থাকবে। আর অতিথির মন অপূর্ণ থাকলে এই শিল্প সামনে এগোবে কী করে!
৫ টি মন্তব্য : “কেটলি আছে, চা কই?”
মন্তব্য করুন
দেশে হোটেলে কখনো থাকা হয়নি সেভাবে। তবে এসব মামুলি প্রত্যাশা পূরণ না হলে তো মুশকিল। হতাশার কথা।
রকিইইইইইইইব!!! ডাবল আপ। গেল কই পুলাডা? x-(
এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...
দুইটা বিষয়ে বলতে পারি।
০১ ডায়াবেটিস এর জন্য সুগার ট্যাবলেট সাথেই রাখুন, ১০০০/১৫০০ ট্যাবলেট বেশ ছোট কন্টেইনার পাওয়া যায়।
০২ ট্রাভেল এর জন্য একটা ছোট টয়লেট্রিস এর প্যাক্ট রাখুন।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
সবাইকে দিয়ে সব হয় না। যেমন বাংলায় স্পাই থ্রিলার। তেমনি কাষ্টমার সার্ভিস ব্যাপারটাও আমাদের ধাতে নেই। আজকাল হোটেলের সাজগোজ বেড়েছে- সে তো কেবল কাকের ময়ূরপুচ্ছ ধারন। তারচে সাধারন হোটেল, বা সুযোগ থাকলে সরকারি ডাকবাংলো- এসব অনেক ভালো। অন্তত সো কলড তারকা হোটেলগুলোর মত সেবার প্রত্যাশা সেখানে থাকে না।
অতিথি আপ্যায়নের কিছু সূক্ষ্ম ব্যাপার আছে যা দালান-কোঠা বা সাজ-সজ্জা দিয়ে হয় না - একদম ঠিক কথা।
আর অতিথির মন অপূর্ণ থাকলে এই শিল্প সামনে এগোবে কী করে! - এটাও ঠিক কথা।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য ধন্যবাদ।