মানুষের জীবনে নিজের অজান্তেই এমন কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যার পরিব্যাপ্তি বুঝতে অনেক বছর লেগে যায়। অনেক সময় আবার পুরাটা উপলব্দিও করা যায় না। আমার জীবনেও তেমনি একটা ঘটনা ঘটেছিলো ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়। ক্যাডেট কলেজে পড়ব এমনটা কখনো ভাবি নি। আসলে ক্লাস সিক্সয়ের মাঝামাঝি এসে ক্যাডেট কলেজের নাম প্রথম জানতে পারি যখন বাবা ক্যাডেট কলেজের এডমিশন টেষ্টের ফর্ম নিয়ে আসলো। ভর্তি পরীক্ষা আমার কাছে বিষের মত লাগে। তার আগের বছর মাত্র কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়েছি সৃষ্টিকর্তা আর বার আওলিয়ার দোয়ায়। কলেজিয়েট স্কুল তখন সবেমাত্র জমে উঠেছে। ক্রিকেট খেলা নিয়ে সিনিয়ার ইয়ারের ছেলেদের সাথে মারামারি করা, দুপুরে বাধ্যতামূলক যোহরের নামাজ না পড়ার কারনে ইসলামিয়ার স্যারে’র তথা ‘লাল বিস্কুটে’র (স্যারের উপাধি, উনি অত্যন্ত ফর্সা হবার কারনে) কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালের মার খেয়ে জানালা দিয়ে ক্লাস পালানো ডেইলি রুটিনের অংশ হয়ে গেছে। এর মধ্যে আবার ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে শুনে মন্টা খারাপ হয়ে গেলো। মায়ের সহানুভূতি নিয়েও বাবার মেজাজের বিরুদ্দ্বে আমার কেইসটা খুব একটা টিকলো না। আমাকে ঘষা-মাজার দায়িত্ব দেয়া হোল কলেজিয়েট স্কুলের মহিউদ্দীন স্যারকে যিনি দায়িত্বটা খুব ভালভাবে পালন করেছিলেন। যতদূর মনে পড়ে ক্যাডেট কলেজের প্রসপেক্টাস অনুযায়ি ক্লাস সিক্সের সব সিলেবাস কমপ্লিট করিয়ে ক্লাস সেভেনের কিছু অংকও করিয়েছিলেন। সে সময় ক্যাডেট ভর্তি কোচিং তখনো চালু হয় নাই। (স্যারের প্রতি আমার সশ্রধ্য সালাম, কিছু বছর আগে স্যার স্বর্গীয়বাসী হয়েছেন)।
এরই মধ্যে বাবা নভেম্বর ডিসেম্বের কোন একটা সময়ে একদিন আমাকে কলেজ দেখাতে আনলেন। ক্যাডেটরা তখন ছুটিতে। এত সুন্দর পরিপাটি, চারিদিকে ফুলের সোমারহ, বিশাল সবুজ মাঠ, একাডেমিক বিল্ডিং সব দেখে এই প্রতিষ্ঠানে পড়ার খুব আগ্রহের সৃষ্টি হোল।
ভর্তি পরীক্ষার কথা খুব একটা মনে নেই। শুধু মনে আছে আমার পরীক্ষার সিট পড়েছিল একাডেমিক বিল্ডিং। কিভাবে কিভাবে যেন রিটেন পরীক্ষায় টিকে গেলাম। সে সময় জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় রেজাল্ট বের হোত। পরের ধাপ সাধারন জ্ঞান পরীক্ষা। যেহেতু তখনোও নিয়মিত নিউজ পেপার পড়ার অভ্যাস হয় নি, স্বদেশ ও বিশ্বের ডায়েরীর নাম কখনো শুনি নাই, সাধারন জ্ঞানে আমার জ্ঞান যে অসাধারন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রিটেন পরীক্ষার পর ভাইবা বোর্ডে ক্যাডেট কলেজের প্রন্সিপাল মেজর/কর্নেল মুজিব সহ আরো দু’জন স্যার ছিলেন, কি জিজ্ঞেস করেছিলেন বিস্তারিত মনে নেই। শুধু মনে আছে, আমেরিকার ক্যাপিটাল ওয়াশিং ডিসী’র পুরা এভ্যরিভিয়েশান এবং সে সময়ের বাংলাদেশের ক্রিকেটের ক্যাপ্টেনের নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন আর তার সঠিক উত্তরও দিতে পারেছিলাম। আল্লাহর অসীম কুদরত, শফিকুল হক হীরা সে সময় পাঁচলাইশে আমাদের নীচের তলায় থাকতেন, নইলে এর উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কানের পাশ দিয়ে গুলি যাবার পর, ডাক্তারী পরীক্ষায় নিজের মান-সম্মান সহ সব জলাঞ্জলি দিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রায় হাজার পঞ্চাশ জনের মধ্যে আমরা ৫২ জন নির্বাচিত হলাম। কলেজিয়েট স্কুল থেকে সহপাঠী ইশতিয়াক মান্নান আর ক্লাস এইট থেকে শাহ্সালাউদ্দিন নির্বাচিত হলো। কলেজিয়েট স্কুলে বাকীদিন গুলো একটু কলার উঁচিয়ে হাটতাম ক্যাডেট কলেজে চান্স পাবার করনে।
আমাদের ইন্টেইক ডেইট ছিলো ২রা’ জুলাই ১৯৭৯। আমার নামের বানান বদলে ইজাজ’এর স্থলে হোল এজাজ, ভাগ্যে জুটলো ক্যাডেট তথা কয়েদি নাম্বারঃ ১২৪৭, হাউসঃ নজরুল। নিদির্ষ্ঠ দিনে নতুন জামা-কাপড়, জুতা নিয়ে হাজির হলাম নজরুল হাউসের সামনে। সামান্য চেকিং-এর পর আমাকে নিয়ে যাওয়া হোলন দোতলায় ৭ নম্ভর রুমে। আর পেরেন্সদের ডাইনিং হলে। নতুনত্তের আহবানে আর সময়ের পারপ্যাঁচে বাবা-মাকে আর সুন্দর করে বিদায় বলা হয় নি, দোয়া চাওয়া হয় নি, মাকে জড়িয়ে ধরা হয় নি। তখনো বুঝতে পারিনি, অদৃশ্যের ইশারায় বাড়ি থেকে চিরতরে আমার একপ্রকার প্রস্থান হয়ে গেছে। বোধকরি প্রত্যেক সন্তান এই ভাবেই বাবা-মায়ের মায়া আর ভালোবাসার বলয় ছেড়ে প্রথম পদক্ষেপ নেয় পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার, ভবিষ্যতের আরও বড় বড় চ্যালেঞ্জের প্রস্তুতি হিসাবে। এর পর অনেকবার বাড়ি ফিরে গেছি, স্থায়ীভাবে নয়, শুধু অথিতি হয়ে। ক্যাডেট কলেজেই হয়ে গেলো আমার স্থায়ী ঠিকানা, অন্ত্যত ৬ বছরের জন্য। (চলবে)
ব্লগে স্বাগতম ইজাজ ভাই, আপনার স্মৃতিকথা গুলো শোনার অপেক্ষায় থাকলাম।
হ্যাপি ব্লগিং 🙂
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
ব্লগে স্বাগতম ভাইয়া
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
নামটা বাঙলায় করে দিয়েন ভাই।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
চালিয়ে যান ভাই।
আমিও লাল বিস্কুটের ছাত্র...
সিসিবিতে সুস্বাগতম!
পরবর্তীর অপেক্ষায় রইলাম।
বাহহ ! সরগরম সিসিবিতে সুস্বাগত ।
পড়ছি আর আরো পড়ার অপেক্ষায় থাকছি ।