ফাহিম-বন্দনা-১

যুবরাজ

(গল্পের যুৎসই কোন নাম না পেয়ে এই নামটা চুরি করলাম আরেকটা গল্পের নাম দেখে, আডমিন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি দিয়ে দেখবেন আশাকরি)

সোহরাব আলী তালুকদার নামে একজন প্রিন্সিপাল ছিলেন সিলেট ক্যাডেট কলেজে। আমি তাঁর গল্প শুনতে শুনতে তাঁর প্রেমে পড়ে গেলাম। “ তারে আমি চোখে দেখিনি, তার অনেক গল্প শুনেছি’ টাইপ প্রেম। এই সব গল্প আমি শুনতাম ফাহিমদের কাছ থেকে। ফাহিম আর আমি ছোট বেলার, মানে এক্কেবারে লেংটা কালের দোস্ত। ফাহিম হঠাৎ করে আমার সাথে বিট্রে করে সিলেট ক্যাডেট কলেজে চলে গেল ’৯০ তে। সে তো গেল ভাল কথা, কিন্ত আমার বাপ আমার জীবন দুর্বীষহ করে তুলল, কথায় কথায় তার রেফারেন্স দিয়ে। আমাকে অহরহ কুলাঙ্গার ডাকা হত এই কারনে।(যদিও এই শব্দের মানে আমি আজও জানিনা)।
সেকালে ক্যাডেট কলেজে চান্স পাওয়া একটা স্ট্যাটাস এর ব্যাপার ছিল।ফাহিমের বাপ তার ছেলের কীর্তি বুক ফুলিয়ে বলত আর আমার বাপ আমার রিপোর্ট কার্ডে প্রতিবার দেখত “বিশেষ বিবেচনায় উত্তীর্ণ”। একারনে আমার বহু লাঞ্ছনা-গঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। আজ আমি ওপেন ফোরামে জনতার মঞ্চে ফাহিমের নামে বিচার দিলাম। জাতির বিবেকের কাছে আমি আজ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম।
যাইহোক ফাহিমদের বাসা আর আমাদের বাসা পাশাপাশি। সুতরাং সব খবর অতি দ্রুত চলে আসত। বন্ধুত্ব আমার জীবনে অভিশাপ হয়ে দেখা দিল।আমি খুব কষ্টে দিন-যাপন করতে থাকলাম। এত কিছুর পরেও আমি পণ করে রাখলাম আমি মরে গেলেও ক্যাডেট কলেজে পরীক্ষা দিবনা। যদিও চান্স পাওয়ার কোন কারণই ছিলনা, যেহেতু ছোটবেলা থেকেই রবীন্রনাথ,নজরুল, আইনষ্টাইন, মার্ক টোয়েন দের মত আমার প্রতিভা বিকাশ দেখা দিয়েছিল। অর্থাৎ পড়া লেখায় আমার মন বসত না, অন্য যেকোন বিষয়ে আগ্রহ অতি প্রবল। আমি নানা অজুহাতে ষষ্ট শ্রেণী তে ক্যাডেট কলেজের পরীক্ষার হাত থেকে বাঁচলাম। আমি তখন সিলেট ব্লু বার্ড স্কুলে ভর্তি হলাম। তাবৎ নারীকুল কে ছেড়ে, শোকের সাগড়ে ভাসিয়ে, ক্যাডেট কলেজে যাওয়া আমার কাছে তখন পুরোপুরি দুঃস্বপ্ন।আমি নানা প্যাঁচ খেলে এই যাত্রা রক্ষা পেলাম।

ফাহিম যখন টার্ম-এন্ডে বাসায় আসত তখন আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হতোনা।নানা রকম দুস্টামী করে আমাদের আনন্দের সময় কাটত। শুরু করেছিলাম সোহরাব স্যারের গল্প দিয়ে,আজ সোহরাব স্যারের গল্প না বলি।কারন আপনারা সবাই কোনো না কোন ভাবে তার গল্প শুনেছেন, আমি তার গল্প বলা মানে” মার কাছে,মাসীর গল্প “ বলা হয়ে যাবে। আজ সোহরাব স্যারের গল্প বাদ। আমি আমার বন্ধু ফাহিমের গল্প বলি।
ফাহিমরা তিনতলা একটা বাসায় থাকত, যার বাকি ২ তলায় আমাদের আর ২ জন বন্ধু থাকত। আমরা ৪ জন ক্রিকেট খেলতাম, এবং নানা ধরনের অপকর্ম করতাম। ফাহিমের কাছ থেকে ক্যাডেট কলেজের অনেক মজার মজার কাহিনী শুনতাম ।তখন ক্যাডেট কলেজ না যাওয়া পার্টি হা-ভাতের মত এইসব গল্প গ্রোগাসে গিলতো। গল্প শুনতে শুনতে আমরাও তখন সিলেট ক্যাডেট কলেজের একজন হয়ে যেতাম।সেই সব গল্পের হিরোদের নাম তখন আমাদের মুখস্ত। তাদের মধ্যে সর্ব জনাব, ক্যাডেট কলেজের আডজুট্যান্ট, আবিদ, জ়োহা, এশান, রোমেনিও, আজিজ, তানভীর, আরমান এদের নাম এখন মনে আছে। সবচেয়ে শুনতাম সোহরাব স্যারের গল্প। আমি তাঁকে দেখিনি। তবে আমি যখন তাঁর কথা কল্পনা করতাম আমার মনে হত নন্টে-ফণ্টে গল্পের সুপারেন্টেড স্যারের মত মোটা, ভুঁড়ী ওয়ালা, টাঁক মাথার একজন রাগী লোক হাতে বেত নিয়ে ঘুরছে।

ইতিমধ্যে আমাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় ১৯৯৪ ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল এল।ফাহিম ও তখন ছুটিতে। প্রায় মাঝরাতে খেলা থাকত। আমরা একজন, আরেকজনের কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে পড়তাম, তারপর শুরু হত বাঁদরামী। যেমন আমরা তখন ১ টাকা দিয়ে এক ধরনের বোমা কিনতে পাওয়া যেত, সে সব কিনতাম। সেগুলাকে আমরা আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে মিসাইল বানাতাম। দুর্ভাগ্যক্রমে একবার আমাদের ছোঁড়া মিসাইল আগুন লাগানোর পর……লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পাড়ার অতীব সুন্দরীর বাথরুমের জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে। বিরাট বিস্ফোরনের শব্দ শুনা যায় এবং কারো হাত থেকে স্টীলের বদনা পড়ার ঝনঝন শব্দ ও শুনা যায়। এটা নিয়ে বিরাট গ্যাঞ্জাম পাড়ায়, তবে আমাদের কেউ ধরতে পারে নাই!
সুন্দরীর কথা আসলোই যখন, বলি আরেক সুন্দরীর কথা। তিনি আমাদের পাড়ার হার্টথ্রব নায়িকা যিনি কিনা বয়সে আমাদের বড়। কিন্তু প্রেম তো বয়স মানেনা। আমরা ও তার প্রেমে পড়লাম জামাতের সাথে। আমরা ভাবলাম ভালবাসার কথা গোপন রাখতে নাই, প্রকাশ করতে হয়। সবাই ভালবাসা প্রকাশ করে চিঠি দিয়ে, ফোন করে, সাক্ষাৎ করে, গোলাপ ফুল দিয়ে- আমরা চিন্তা করলাম ঢিল ছুঁড়ে আমরা আমাদের ভালবাসা প্রকাশ করব। সেটা কীভাবে? সেটা হল সুন্দরীর বাসা টিনের চালের। সুতরাং আমরা তার টিনের চালে ঢিল দিয়ে ভালবাসা প্রকাশ করব। আমাদের ছোঁড়া ঢিল তার বাসার টিন এ ঝনঝন আওয়াজ করে পড়বে- এবং এই সুর তার মনে ভালো লাগার ঝংকার তুলবে- (সেরমই একটা এস্যাসমেণ্ট ছিল আমাদের)। কিন্ত তার বদ একটি ভাই ছিল, যার মনে ভালবাসার ঝংকার এর বদলে হুংকার উঠতো। আমরা যতবার ঢিল ছুঁড়তাম ততবারই তার এই হুংকার শুনা যেত। অতঃপর সে বাসার সামনে পাহারা বসাল আমাদের ধরার জন্য। আমরা অচিরেই নতুন রাস্তা আবিস্কার করলাম। ফাহিমের তিন তলা বাসার ছাদ থেকে সরাসরি ঢিল মারা যায়। এতে অন্য ঘটনা ঘটে গেল। দেখা গেল ঐ সময় বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া নিরপরাধ পথচারীরা ধরা খেতে থাকল।এভাবে কয় দিন মারার পর আমাদের হাত এত পাকা হল যে আমরা যে কোন আঙ্গেল থেকে, না দেখে পর্যন্ত ঢিল লাগাতে পারতাম। আমরা এতই পাকা ছিলাম যে চোখে কাপড় বেঁধে মারতাম এবং নিপুন লক্ষ্যভেদ হতো। আমাদের এই কাহিনী কিভাবে জানি এ-কান, দু-কান হয়ে পাড়াময় ছড়িয়ে পড়ল। পাড়ার সকল যুবক-কিশোর ভাইয়েরা ঢিল ছোঁড়ার এই আইডীয়ার কপি রাইট ভঙ্গ করে নিজেরা ও শুরু করল। অতি দ্রুত এই ঘটনা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করল। পাড়ার যে ছেলে ঐ বাসার সামনে, পিছনে যে দিক দিয়ে যায়, একটা করে ঢিল ছুঁড়ে যায়।তার ভাই বাসার সামনে পিছনে পাহারা লাগিয়েও কোন কুল কিনারা করতে পারল না। অন্য পাড়ার ছেলেরাও ঢিল মেরে যায়।একদিন ঐ ভাই আমাদের ডেকে কারা এই কাজের সাথে জড়িত তাদের নাম-ধাম দেওয়ার জন্য বললেন। আমরা তাকে আস্বশ্ত করলাম দোষীদের অতি সত্তর ধরিয়ে দেওয়া হবে। আমরা পাড়ার অতন্দ্র প্রহরী, অন্য পাড়ার ছেলেরা এসে আমাদের পাড়ার মা-বোনদের বাসায় ঢিল মেরে যাবে- এটা কোনভাবেই বরদাশত্ করা যায়না। অন্য পাড়ায় জানিয়ে দেওয়া হল- এপাড়ায় যেন তারা ঢিল ছুঁড়তে না আসে। ইতিমধ্যে সুন্দরীর ভাই এই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য বাসার ছাদ ঢালাই করার চিন্তা করলেন। আমরা এতই পাথর ছুঁড়ে ছিলাম যে তাকে শুধু মাত্র সিমেন্ট কিনতে হয়েছিল টাকা দিয়ে, ছাঁদ ঢালাই এর সমস্ত পাথর আমাদের সাপ্লাই দেওয়া!!
(চলবে)

৮,৮০৮ বার দেখা হয়েছে

১২৩ টি মন্তব্য : “ফাহিম-বন্দনা-১”

  1. বন্য (৯৯-০৫)

    :khekz: :khekz: :khekz: :khekz:

    ব্যান খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা নিয়েও না বলে পার্লম্না...

    যুব্রাজ ভাই..আপ্নে এক্টা মাল..

    কিপ্পোর্লাম্রেবাবা..... এক্টু নাইচা লই..
    :tuski: :tuski: :tuski:
    :awesome: :awesome: :awesome:
    :tuski: :tuski: :tuski:
    :awesome: :awesome: :awesome:
    :tuski: :tuski: :tuski:
    :awesome: :awesome: :awesome:

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    বস, 'কুলাঙ্গার' শব্দ নিয়া আপ্নের এত আক্ষেপের কি আছে বুঝলাম না.. :dreamy:
    শব্দটারে ভাইংগ্যা আমরা পাই 'কুল' এবং 'অংগার'...এর মানে হইল বংশের বাত্তি... :-B ;;)

    স্মৃতিচারণ ভাল লাগছে... :thumbup:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. ভাবতেছি আপনি, ফাহিম ভাই আর আপনাদের ওই সুন্দরী এই তিন জনরে নিয়া একটা রোমান্টিক-একশ্যান ছবি বানামু। নাম হবে 'ঢিল মারি তোর টিনের চালে'-tit for tat 😉 😉
    ফাহিম ভাই আর আপনি দেশে আসলেই শ্যুটিং শুরু হবে। 😀 😀

    লেখা মজা হইছে।
    কাছ থেকে দেখার বন্ধুর কাছে, কাছ থেকে দেখা বড় ভাইয়ের গল্প শুন্তে ভালো লাগছে। 😀

    জবাব দিন
  4. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ঢিলা-ঢিলিতে বস ফাহিম ভাই ক্রিকেট কিংবা বেসবল না খেইল্যা পাহাড়ে চড়ায় ইন্টারেস্টেড ক্যান হইলেন- ঠিক বুঝলাম না... :-B ~x(


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  5. রকিব (০১-০৭)

    আমিও ঢিল ছুড়বো 😡 😡 অসাধারণ একটা সিরিজ শুরু করার জন্য যুবরাজ ভাইকে :salute: :salute:

    ফাহিম-বন্দনা-১

    তারমানে ফাহিম-বন্দনা-২ ও আসতেছে... :party: :party: :party:

    কবে? কবে? কবে??


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  6. জিহাদ (৯৯-০৫)

    মর্নিং শোজ দ্যা ডে। আমি তো সামনে পুরা বছর ফকফকা দেখতে পারতেসি :awesome:

    জট্টিল জট্টিল। :gulti: :gulti:

    একটা সাজেশন: ফাহিম-বন্দনা না দিয়ে ফাহিম + বন্দনা দিলে বেশি দৃষ্টিমধুর হয় মনে হয় :-B


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  7. রহমান (৯২-৯৮)

    ২/৩ ধরে নেটে বসতে পারছিলাম না 🙁 । ব্যস্ততা এবং কচ্ছপ গতির অত্যন্ত ধীর নেটওয়ার্ক ছিল এর কারন। আজ নেটে ঢুকে দেখি আমার ধারনা সত্য প্রমাণ করে যুবরাজ পুরা উরাধুরা ওপেনিং এর সাথে সাথে এখন সেঞ্চুরীর পথে :thumbup:

    সাবাশ বন্ধু :clap: । সিসিবির সবচেয়ে আকর্ষনীয় দিক হলো এর মন্তব্য এবং প্রতিমন্তব্য। এরকম প্রাণবন্ত এবং সুন্দর পরিবেশ আর কোথাও পাবিনা :no: । আশা করি নিয়মিত লিখবি এখানে। আমার মতো আরো অনেকে তোর লেখা পড়ার আশায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতে থাকবে :dreamy: ।

    লেখার ব্যাপারে মনে হয় আমার আর মন্তব্য করার প্রয়োজন নেই। উপরের সবার স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্যই কথা বলছে। আমি শুধু বলব নিয়মিত সিসিবিতে লিখতে থাক্‌ :boss: এইরকম স্পীডেঃ :guitar:

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।