রাজাকারনামা………………………১(বর্ধিত)

আমি এর আগে রাজাকারনামাতে জেনেভা কনভেনশনের কথা উল্লেখ করেছিলাম। কতিপয় বন্ধু ও পাঠকের আগ্রহের কারণে রাজাকারনামা…………………..১ এর বর্ধির্তাংশ লিখলাম। এখানে শুধুমাত্র রাজাকার ও অন্যান্য যুদ্ধপরাধীদের বিচারের জণ্য আন্তর্জাতিক আইনের বিশ্লেষণ করলাম।

১/

জেনেভা কনভেনশন মূলতঃ ৪ টি কনভেনশনের সম্মিলিত রূপ। প্রথম ২ টি কনভেনশন অস্ত্রত্যাগ এবং যুদ্ধাহত সৈন্যদের রক্ষার জন্য। ৩য়টি হল যুদ্ধাবন্ধীদের সঙ্গে আচরণ সংক্রান্ত কনভেনশন। ৪র্থটি হল বেসামরিক জনসাধারণকে রক্ষার জন্য। এগুলোকে রেডক্রস কনভেনশন ও বলা হয়। ১৯৪৯ সালের কনভেনশন পূর্বকার প্রচলিত ও সনাতন সকল প্রটকল, ডিক্লারেশন, প্যাক্ট হতে ভিন্ন এবং তাতপর্যপুর্ন।

১। এখানে প্রথমবারের মত আন্তরাষ্ট্র যুদ্ধ নয়, গৃহযুদ্ধ, ও জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে বিধান রাখা হয়েছে। যুদ্ধে খুন, নিপীড়ন, ও জিম্মিকরন নিষিদ্ধকরণ করা হয়েছে।
২। শত্রুবাহিনী কর্তৃক দখলকৃত এলাকাকে মুক্ত করার জন্য গেরিলা যুদ্ধকে বৈধতা প্রধান করে।
৩। কোন সামরিক সংঘর্ষের ক্ষেত্রে, যদি কোনো পক্ষ যদি যুদ্ধকে স্বীকার নাও করে তবুও তার জন্য জেনেভা কনভেনশনের শর্তাবলী অবশ্য পালনীয়।

এছাড়া আরও কতিপয় সংযোজিত বিধান আছে কিন্তু তা আমার আলোচনার অন্তর্ভুক্ত নয়। তাই এখানে উল্লেখ করা হলনা।

জেনেভা কনভেনশনে অন্তর্ভুক্ত নতুন বিধান পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যুদ্ধোত্তর কালে পাকিস্তান ও তার দোসররা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অবশ্যই জেনেভা কনভেনশন মেনে চলতে বাধ্য। আর এর ব্যাতিক্রম হল যুদ্ধাপরাধের সামিল।

২/

প্রথম ২ টি কনভেনশন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য মুখ্য নয়। কেননা পাকিস্তান যুদ্ধপরাধীদের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাই নাই। ইয়াহিয়ার দম্ভোক্তি মনে হয় সবার মনে আছে, “I want only land not people”. যুদ্ধে তাদের আচরণ ছিল অনেকটা narnia muviর white which এর মত I do not have any interest about prisoners. Kill them all. এরপর আসা যাক ৩য় কনভেনশনে, যেহেতু তাদের যুদ্ধাবন্দী গ্রহণের কোনো আগ্রহই ছিল না তাই তাদের সাথে অসদাচরণ এর প্রশ্ন আসাটা অবান্তর।তা ছাড়াও এ সংক্রান্ত আমাদের হাতে পর্যাপ্ত প্রমানাদির অভাব আছে। সুতরাং আমাদের শেষ ভরসা ৪র্থ কনভেনশন।
এই কনভেনশনের ৫৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, দখলকৃত এলাকায় কোনো সম্পত্তি ধ্বংস করা যাবে না। কিন্তু পাকিস্তান ও তাদের দোসরদের কর্তৃক আগুন সংযোগ, লুণ্ঠন স্পষ্ট জেনেভা কনভেনশন অমান্য করার সামিল। এছাড়া জেনেভা কনভেনশনের ১৮ – ২০ এবং ৩২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পাকিস্তান এবং তাদের এদেশীয় দোসররা যুদ্ধপরাধ করেছে।

এছাড়া ১৯৬১ সালে জাতিসংঘের ECOSOC কর্তৃক ৫৬ নং রেজুলেশন অনুযায়ী

১। যুদ্ধরত সকল রাষ্ট্র ও কর্তৃপক্ষ দখলকৃত অঞ্চলের নারী শিশু ও সকল জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বেসামরিক জনগণের উপর অন্যায় আচরণ করা যাবে না।
২। ম্যাচাকার করা যাবে না। জোর করে উৎখাত, কারারুদ্ধ, গুলি ধর্ষণ, ইত্যাদি নিষিদ্ধ।
৩। সশস্ত্র সংঘর্ষ চলাকালে সংশ্লিষ্ট এলাকার নারী পুরুষ ও শিশুদের উপর নিপীড়ন হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি নিষিদ্ধ।

আবার ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ৯৬(১) সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাবের মাধ্যমে গণহত্যাজনিত অপরাধ নিরোধ ও তার শাস্তি সম্পর্কিত কনভেনশন গৃহিত হয়। এই কনভেনশনে ১৯ টি অনুচ্ছেদ রয়েছে।

অনুচ্ছেদ ৪ অনুযায়ী গণহত্যা সংগঠনকারী সে রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারী, সামরিক, বে সামরিক, কিম্বা বেসরকারী যেই হোক না কেনো তাকে শাস্তি পেতেই হবে।

অনুচ্ছেদ ৫ অনুযায়ী যে কোনো দেশ তার শাসনতন্ত্র অনুযায়ী আইন প্রণয়ন ও তার বিচার করা ক্ষমতা রাখে।

অনুচ্ছেদ ৬ অনুযায়ী নিজ রাষ্ট্রের ট্রাইবুনাল অথবা আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠনের মাধ্যমে বিচার করার ক্ষমতা রাখে।

অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী গনহত্যাকারী কখনো বহিসমর্পণ এখতিয়ার পাবে না। অর্থাৎ তারা asylum seek করতে পারবে না।

অনুচ্ছেদ ৮ অনুযায়ী গনহত্যাজনিত যে কোনো কাজে জাতিসঙ্ঘ কিম্বা অন্য যে কোনো দেশ বা সংস্থার সাহায্য নেওয়া যাবে।

অনুচ্ছেদ ৯ অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্রের সাথে বিরোধ দেখা দিলে তা মীমাংসা জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যাবে।
এছাড়া রয়েছে ১৯৭৭ সালের জেনেভা কনভেনশনের এনেক্স। অতএব আমরা জেনেভা কনভেনশনের আওতায় এবং নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক গণহত্যা সম্পৃক্ত কনভেনশন এর আওতায় এর বিচার করতে সক্ষম।

৩/

আমরা কি আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে পারি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য। আন্তর্জাতিক আদালতে উভয় পক্ষকে অবশ্যই রাষ্ট্র হতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে এখানে মামলা করা যায়না। এই কারণে আমরা দেশীয় রাজাকারদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবনা। তবে কি আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে পারি। এখানেও সম্ভাবনা ক্ষীণ শুধু ক্ষীণ নয় অসম্ভব। কারণ আন্তর্জাতিক আদালতের আবশ্যিক বলে কোনো এখতিয়ার নেই। অর্থাৎ আমরা যদি আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হই এবং পাকিস্তান যদি আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে রাজি না হয় তবে তাকে বাধ্য করা যাবেনা। তবে আমরা যদি পাকিস্তানি জান্তাদের বিরুদ্ধে নিজস্ব আইন তৈরি করে বিচার করি তবে পাকিস্তান এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন সাপেক্ষে কোনো অভিযোগ করতে পারবে না। তবে যুদ্ধপরাধিদের বাংলাদেশের নিকট হস্তান্তর তাদের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত উপর নির্ভর করছে। তবে তারা যেন হস্তান্তরে বাধ্য হয় তার জন্য আমরা বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা, বিভিন্ন দেশের জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পাকিস্তানের উপর অব্যাহত চাপ সৃষ্টি, বিভিন্ন মানবাধীকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংঠনকে নিজেদের কনফিডেন্সে এনে তাদের কাছে গনহত্যার সুষ্ঠু বিচার চাইতে পারি। এর জন্য আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে শক্তিশালী কূটনৈতিক অবোকাঠামো।

১,১৯৯ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “রাজাকারনামা………………………১(বর্ধিত)”

  1. তৌফিক

    ভালো আলোচনা দোস্ত। পাকিস্থানী যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেয়া হয়তো যাবে না, বাংলাদেশের সেই ক্ষমতা হয়তো নাই। আমরা তো বুশের মত দম্ভোক্তি করে বলতে পারব না, হয় আমাদের পক্ষে নয় বিপক্ষে। তবে পাকিস্থান যুদ্ধাপরাধ করেছে - এটা বিশ্ববিবেককে জানানোর জন্য যা করা দরকার আমাদের তাই করতে হবে। আর নিজের দেশের যুদ্ধাপরাধীদের অবশ্যই আমরা বিচার করব, এবং এই বিচার শেষ করতে হবে আমাদের।

    আজকে জাহানারা ইমামকে নিয়ে পত্রিকায় পড়া একটা রিপোর্টের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। উনি ইন্তেকাল করার পর কোন একটা মসজিদের ইমাম খুতবা দেয়ার সময় তাঁকে জাহান্নামের ইমাম বলে সম্বোধন করেছিল। উপস্থিত মুসল্লিরা তাৎক্ষনিক এর প্রতিবাদ করে, ইমামকে ক্ষমা চাইতে হয় এবং নামাজ শেষে ইমাম তাঁর আত্নার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করতে বাধ্য হয়। ধান ভানতে শিবের গীত গাইলাম বোধহয়। তবে এই ঘটনাটা পড়ার পর মনে হয়েছিল জাহানারা ইমাম যেটা শুরু করেছিলেন আমাদের তা শেষ করতে হবে।

    জবাব দিন
  2. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    আমাদের প্রধান সমস্যা হলো, আমরা অতীত এবং অন্যায় এই দুটো জিনিস খুব দ্রুত ভুলে যাই। আমরা অতীত থেকে শিক্ষা নিই না। আর নিজের স্বার্থের জন্য জঘন্ন্য অন্যায় মেনে নিই। তাই আমরা একের পর এক অন্যায় আর অপকর্ম করতে ভয় পায় না।
    আমরা যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আজ থেকে ৩০ বছর আগে করতে পারতাম তবে আজ হয়তো জাতি কে এতো কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হতো না। এদের বিচার অতিশীঘ্রই এবং অবশ্য কাম্য।

    জবাব দিন
  3. যুদ্ধে খুন, নিপীড়ন, ও জিম্মিকরন নিষিদ্ধকরণ করা হয়েছে।

    ভাইয়া কথাটা বুঝিনাই 🙁 ........... যুদ্ধে গুলি করা হয় খুন করার জন্যে....... বোমা মারা হয় প্রাণহানির জন্যে....... তাইলে খুন করা নিষেধ মানে কি ??

    জবাব দিন
    • মাসুদুর রহমান (৯৬-০২)

      মুক্তিযুদ্ধে যেটা হয় মুক্তিকামি জনসাধারনের এলাকা পুর্ব হতেই দখলকৃত থাকে। আর এখানে থাকে অসঙ্খ্য বেসামরিক জনসাধারণ। তাদের খুন হত্যা করা যাবে না।

      জবাব দিন
    • সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

      সিউল : যুদ্ধ দুই পক্ষের সামরিক বাহিনীর মধ্যে হলে সমস্যা নাই। আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী, যুদ্ধ চলাকালে বেসামরিক লোকজনের ওপর হামলা, আক্রমন, হত্যা, লুটপাট, ধর্ষন বা জিম্মি করা যাবেনা। করলে সেটা যুদ্ধাপরাধ।

      সাম্প্রতিক গাজা আক্রমণে ইসরায়েলি বাহিনী যে বেসামরিক এলাকায় ফসফরাস বোমা ব্যবহার করেছে, বেসামরিক লোকজন হত্যা করেছে, বাসস্থান, হাসপাতাল ধ্বংস করেছে, এই কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পরিণতি জানিনা। কারণ ইসরায়েলের পক্ষে বিশ্বের তাবৎ প্রভাবশালীরা সক্রিয়!!


      "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

      জবাব দিন
  4. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    তুমি যদি কোনো যুদ্ধ বন্দির মাথায় গুলি করো, সেটা খুন। তুমি কাউকে গুলি করছো বা বোমা মারছো, যার পালটা গুলি বা এই ধরনের কিছু করার ক্ষমতা আছে, সেটা যুদ্ধ।

    -- (ব্যক্তিগত ধারনা)

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।