১৯৭১- ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে ………………… লেখাটি অনেক পাঠক কে বিব্রত করেছে। আমি লিখেছিলাম তাদের অভিযোগের কিছু গঠণমূলক সমালোচনা এখানে হতে পারে এই আশায়। যেহুতু লেখাটি আমার এবং পাকিস্তানি সাংবাদিকদের লেখাগুলো আমার পড়া তাই এর জবাব দেওয়ার দায়িত্ব আমার উপরই বর্তায়। তাই ১৯৭১ কটু দৃষ্টিকোণ………………কিছু ব্যক্তিগত উত্তর শিরোণামে এর জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
প্রথম অভিযোগঃ *৫০০০ বিহাড়ি ও অবাঙ্গালী (শরনার্থী) চট্টগ্রাম বন্দর হতে করাচি বন্দরে উপস্থিত হয়।
* সহস্রাধিক অসহায় মুস্লিম শরনার্থী দেশ বিভাগের সময় যারা পুর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল গত সপ্তাহে তারা প্রায় সকলেই বাঙ্গালী কতৃক হত্যার স্বীকার হয়েছে।
* প্রায় লক্ষাধিক অবাঙ্গালী মুসলমান পুর্ব পাকিস্তানে আটকা পরেছে। আশংকা করা হচ্ছে এরা সকলেই বাঙ্গালী কতৃক চরম প্রতিশোধের শিকাড় হবে।
অভিযোগ খন্ডনঃ অবাঙ্গালী বা বিহাড়ীদের আদি বাসস্থান ছিল ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং বিহাড় রাজ্য। পাকিস্তান কখনই এদের আপন করে গ্রহণ করেনি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশে আটকে পরা বিহাড়িদের নেওয়া প্রসঙ্গে নেওয়াজ শরিফ হতে পারভেজ মুশাররফ সবাই বলেছে এরা ভারতীয় মুসলমান পাকিস্তানের সাথে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। ১৯৭১ সালের এই ৫০০০ বিহাড়ীদের প্রতি তাদের এই দরদ অবশ্যই সন্দেহের উদ্রেক করে।
এই ৫০০০ হাজার শরনার্থী প্রশাসনিক নিরাপত্তা বলয়ে কেও জাহাজে করে অথবা কেও উড়োজাহাজে করে পাকিস্তান করাচি বন্দরে উপস্থিত হয়। পৃথীবির কোন গোলযোগ বা যুদ্ধরত স্থানে প্রশাসনিক নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ সুবিধায় শরনার্থী স্থানান্তরের উদাহরণ পাওয়া যাবেনা। সতিকার শরনার্থীদের চিত্র কেমন হয় তা দেখা যায় ২৫ শে মার্চের পরবর্তি দিনগুলোতে। সত্যিকার অর্থে এই ৫০০০ হাজার অবাঙ্গালী মুসলিম বিহাড়ী ছিলনা, না ছিল শরনার্থী। এরা ছিল পাকিস্তানি অভিজাত শ্রেণী। এরা সকলেই ছিল সামরিক, বেসামরিক, ব্যবসায়ী, কলকারখানার মালিক ও তাদের পরিবার। মার্চের প্রথম সপ্তাহে এদের পাকিস্থানে স্থানান্তরের মূল উদ্দেশ্য ছিল মার্চের শেষ সপ্তাহে যখন পুর্ব পাকিস্তানি আন্দোলনকারীদের উপর স্টিম রোলার চালানো হবে তখন যাতে এই পাকিস্তানি অভিজাত শ্রেণী নিরাপদে থাকে তা নিশ্চিত করা। নির্বিচারে হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ করার জন্যই এদের পাকিস্তানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এই অভিজাত শ্রেণীর একটি বড় অংশ ছিল ব্যবসায়ী, এই ব্যবসায়ীরা সামরিক সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা করত। তাই এসব অভিজাত শ্রেনীর নিরাপত্তা বিধান ততকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কাজ ছিল ।
দ্বিতীয় অভিযোগঃ আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তানে বিজয়ী হওয়ার পিছনে একটি প্রভাবক হল অর্থ। ভারতীয় গুপ্তচরদের মদদে আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। এই পরিমাণ অর্থ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি।
অভিযোগ খন্ডনঃ ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ভুমিধস বিজয় প্রমাণ করে দেশ বিভাগের পর মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা পূর্ব পাকিস্তানে কমতে শুরু করেছিল। সত্যিকার অর্থে মুসলিম লীগ পুর্ব পাকিস্তানে কখনই জনপ্রিয় ছিলনা। ইংরেজ শাষণামলে মানুষ এদের পক্ষে ছিল এর প্রধান কারণ ছিল দুই বাঙ্গালী বরেণ্য ব্যাক্তি তখন মুসলিম লীগের রাজনীতি করত। এই দুইজন হলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও হোসেন সহিদ সোহরাউয়ার্দী, এরা যখন মুসলিম লীগ ত্যাগ করে বাঙ্গালীদের জন্য পৃথক রাজনৈতিক মোর্চা গঠণ করলেন ততখনাত বাঙ্গালী জনসাধারণ মুসলীম লীগকে ত্যাগ করেছিল।
১৯৫৮ সালের সাধারন নির্বাচনের পুর্বে আইয়ুবের ক্ষমতা দখলের একটি বড় কারণ ছিল আওয়ামীলীগের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা।
“গোয়েন্দাদের গোপন রিপোর্টের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার জানতে পারে ১৯৫৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার গঠণ এবং কেন্দ্রীয় সরকার গঠণের জন্য প্রয়োজনীয় আসনে বিজয়ী হউয়ার সম্ভাবনা রয়েছে”।
The failure of integration in Pakistan – Rounak Jahan.
পাকিস্তানের শাষণ ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি শাষকদের নিকট হতে পূর্ব পাকিস্তানি তথা বাঙ্গালীদের হাতে চলে আসতে পারে এই আশু সম্ভাবনা ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা কে সামরিক শাষণ জারি করাতে অন্যতম প্রধান ভুমিকা রেখেছে।
এই হতে প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল ১৯৫৮ সাল হতেই অবশ্মভাবি ছিল।
এরপর সময় যত প্রবাহিত হয়েছে মুসলীম লীগের জনপ্রীয়তা তত কএমছে।
অন্যান্য সাধারণ কারণগুলোকে যদি নিষ্ক্রিয় ধরি তারপরও পাকিস্তানপন্থী দলগুলোর পরাজয় নিশ্চিত ছিল। বাঙ্গালী জাতীয়তা, সেক্যুলার আদর্শে বিশ্বাসী ভোটগুলো আওয়ামীলীগের একক বাক্সে পরেছে অপরদিকে ডানপন্থী এবং অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী ভোট মুসলীম লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি দুটি বৃহত অংশে ভাগ হয়ে গেছে। এই সাধারণ সরল সমিকরণ রাজনৈতিক ও নির্বাচন কে কভার করা সাংবাদিকদের না বুঝার কোন কারণ নাই। এরপরও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেস্টা উদ্দেশ্যপ্রনোদিত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অযৌক্তিক প্রমাণ করার ছেলেমানুষি প্রয়াস।
আইয়ুব সরকার পুর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের প্রায় ৩২% সদস্য, ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের দ্বারা পুর্ণ করেছিলেন। তাই অর্থের প্রতিযোগীতায় পশ্চিম পাকিস্তান পন্থী এবং ডানদিকে ঝোক প্রবণ দল সমুহ আওয়ামীলীগ হতে অগ্রসর ছিল।
তৃতীয় অভিযোগঃ শেখ মুজিবর রহমানের ৬ দফার দুটি দাবি যা কিনা পৃথিবীর ইতিহাসে কোন ফেডারেল রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় পাওয়া যায়নি। একটি হল বৈদেশিক ঋণ ও বানিজ্য বিষয় ব্যাতিত অন্যান্য পররাষ্ট্রনীতি কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করতে পারবে, দ্বিতীয়টি হল শুল্ক, কর ও রাজশ্ব ধার্য ও আদায় করার ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের নিকট থাকবে। বাস্তবচিত্রে শেখ মুজিব শ্বায়ত্বশাষণের ছদ্মবেশে পুর্ব পাকিস্তানের স্বাধিনতার কথাই ৬ দফায় উল্লেখ করেছিল। যা কিনা পৃথিবীর কোন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
অভিযোগ খন্ডনঃ ৩রা মার্চ ইয়াহিয়ার জাতীয় অধিবেশন স্থগিত করার প্রাথমিক উদ্দেশ্য সংবিধান ও অন্যান্য আইনগত বিষয়ে হোম ওয়ার্ক করার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের সময় দেওয়া। পাকিস্তানি সাংবাদিকের এই দাবী সম্পুর্ণ মিথ্যা।সত্য হল ৩ রা মার্চ জাতীয় সংসদে প্রথম অধিবেশনকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তান হরতাল আহবান করেন। ইয়াহিয়া ভুট্টোর দাবী অনুযায়ী ৩রা মার্চের অধিবেশন অন্রিদ্রিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন।
ফেডারেল রাষ্ট্র হসাবে পাকিস্তান বিশ্বে একটি চমক। ফেডারেল রাষ্ট্রের দুই অংশের মাঝে ভারতের ন্যায় বিশাল রাষ্ট্রের প্রস্থ্য পরিমাণ দুরত্ব পৃথীবির আর কোথাও দেখা যায়নি। এরুপ ফেডারেল রাষ্ট্রের ফেডারেসন সমূহের অর্থনৈতিক উন্নতির ও জীবনযাত্রার মানোউন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব থাকা অবশ্য প্রয়োজনীয়, ফরযে আইন। এতএব ৬ দফার ঐ দুই দাবি সময় এবং পরিস্থিতি এবং ভৌগলিকগত পশ্চাতপদ ফেডারেসনের জন্য মৌলিক অধিকার। আর এই বিষয়ে আপোষ করা কোন জনপ্রিয়, মানব হিতৈষী, জাতীয়তাবাদী নেতার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধুমাত্র ক্ষমতালোভী, স্বার্থপর, ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত নেতাদের পক্ষেই সম্ভব।
১৯৬২ সালের পাকিস্তান সংবিধান আইয়ুব খানের উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত যা কিনা তার মৌলিক গনতন্ত্রের মতই উদ্ভট। এর প্রমাণ মিলে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানে পুনরায় সংবিধান রচনার মাধ্যমে ৬২এর সংবিধানকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপের ফলে। এতএব এই রকম অগণতান্ত্রিক সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান করে বঙ্ঘবন্ধু ন্যায়সঙ্গত কাজ করেছেন। প্রকৃত নেতাদের নিকট হতে মানুষ এমনটাই আশা করে।
পাকিস্তানের বিভক্তির জন্য মুলত দায়ী জুলফিকার আলি ভুট্টো। তিনি স্পষ্টত বুঝতে পেরেছিলেন দুই পাকিস্তান একত্রিত থাকলে তিনি কখনই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রি বা প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না।
“Bhutto was more interested in getting power, no matter whether in a united or divided Pakistan. In fact he realized that in a united Pakistan, he had little chance of becoming either prime minister or president. According to G. W. Choudhury, “he realized from his discussions with Bhutto before and after the 1970 elections that if he had to make a choice between the two ‘Ps (power or Pakistan), he would choose the former. He was more interested in getting a 21-gun salute as the head of the state than in the maintenance of the unity of Pakistan.”
শাষক ও শোষকের চরিত্রে আমরা কখনই ছিলাম না তাই আমাদের বিরুদ্ধে ময়ানবতা বিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগ দেওয়া নিজেদের স্থুল পাপকে লঘু করার প্রয়াস এবং তা শধুমাত্র আত্মপ্ররোচনা মাত্র।
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই যুক্তিখণ্ডনগুলোর জন্যে।আশার বিষয়-এধরণের অপপ্রচারের পরেও পাকিস্তানের বহু তরুন কিন্তু ১৯৭১ এর সত্যিকারের কাহিনী জানা শুরু করেছে(ওভারহয়েলমিং মেজরিটি যদিও এখনো জানেনা)।
চালিয়ে যান ভাই। ভালো হচ্ছে :boss:
অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। আর এখানে মন্তব্য লেখার মাধয়মে আমরা আমদের মতামত ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারি। প্রসংশা কিম্বা স্রেফ কটু সমালোচনা ব্লগিং এর আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত করে।