যুদ্ধাপরাধে বিষয়টিতে পাকিস্তান সরাসরি একটি পক্ষ তাই বাংলাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ এবং কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করছে তখন পাকিস্তানও বসে না থেকে বাংলাদেশের সাথে নতুন করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, প্রলোভন এবং সম্পর্কের অবনমন হতে পারে বলে হুমকি পর্যন্ত দিচ্ছে। এটা শুধুমাত্র বাংলাদেশ পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বাংলাদেশ যেমন আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে ব্যস্ত ঠিক তেমন করেই পাকিস্তানও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে নিরোধ করার জন্য কূটনৈতিক প্রচারণা চালাতে পারে। এখানে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক তৎপরতা আলোচনা করা হল।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে বাংলাদেশ সরকারের গৃহিত পদক্ষেপ –
২৯শে জানুয়ারি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে একটি বিল পাস করা হয়।
পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া –
১৯শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকারের পক্ষ হতে একজন বিশেষ প্রতিনিধি জিয়া ইস্পাহানি বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী সাথে সাক্ষাৎ করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী সাথে সাক্ষাৎ কালে তিনি বলেন,
“আমরা অবশ্যই যুদ্ধাপরাধী বিচারের ইস্যুতে যাব্না, কেননা আমরা বাংলাদেশের সাথে অন্যান্য ইস্যুতে পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে উভয়েই লাভবান্ হতে পারি। আমাদের সামনের দিকে তাকানোর সময় পিছনের দিকে নয়”।
যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনা দাবি করা হলে তিনি বলেন, “আমরা বহুবার ক্ষমা চেয়েছি, আমাদের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ স্মৃতিসৌধে গিয়েছেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অনুরুপ কাজ করেছেন”।
পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাংলাদেশ সরকারের গৃহিত পদক্ষেপ –
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তান সেনা অফিসারদের বিচারের আবেদন করতে পারে। ৭ই মার্চ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রানালয়ের মন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম বলেন, “আমরা যুদ্ধাপরাধ এবং পাকিস্তানি আগ্রাসনের জন্য দায়ীদের বাংলাদেশের নিকট হস্তান্তরের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে উত্থাপন করব”। পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীরা বাংলাদেশের হাতে গ্রেফতার নেই। তাই তাদেরকে বাংলাদেশের নিকট বহিসমর্পন করতে পাকিস্তানকে রাজি করাতে বা বাধ্য করতে হবে। আমরা আন্তর্জাতিক বিশ্বের সকলের সাহায্য চাই যাতে আমরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের সকলকে বিচারের সম্মুখীন করতে পারি।
যুদ্ধাপরাধের জন্য পাকিস্তানের নিকট বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমা প্রার্থনা দাবি –
১২ ই মে পাকিস্তান হাই কমিশনার আলমগির খান বাবর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনির সাথে সাক্ষাতে করলে দিপু মনি পাকিস্তান কে ১৯৭১ সালের গনহত্যার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার দাবি করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী লক্ষ্যাধিক আটকেপড়া পাকিস্তানিদের দেশে ফেরত নেওয়ার প্রসঙ্গের অবতারণা করেন। বৈঠক চলাকালীন সময়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৩৮ বছর ধরে অমীমাংসিত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের তাগিদ দেন। এসব বিষয় হল সম্পদের পুনর্বন্টন, ৭১ পূর্ববর্তী নথিপত্র সরবরাহ, বাংলাদেশের জনগণের নিকট আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা এবং বাংলাদেশে বসবাসরত পাকিস্তানিদের স্বদেশে পুনর্বাসন উল্লেখযোগ্য।
রাষ্ট্রদূত এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুতে পাকিস্তান সরকারের শোক বার্তা পৌঁছে দিতে। দিপু মনি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মাঝে অমীমাংসিত প্রসঙ্গ সমুহের অবতারণা করলে তিনি প্রসঙ্গ সমুহকে পাকিস্তান পররাষ্ট্র দফতরে আলোচনা ও স্বিদ্ধান্তের জন্য পাঠাবেন বলে আশ্বাস প্রদান করেন।
জানুয়ারি মাসের ৬ তারিখে পররাষ্ট্র মন্ত্রানালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পর এবারই প্রথম তিনি পাকিস্তান কে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য বললেন। তবে শেখ হাসিনা তার প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) পাকিস্তানের করাচীতে সার্ক দেশসমুহের একটি সম্মেলন পাকিস্তানকে প্রথমবার ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেছিলেন।
আওয়ামী সরকার ৩০ লাখ সাধারণ মানুষ হত্যা এবং ৩ লাখ বাঙ্গালী নারীদের শ্লীলতাহানী করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার দাবি করে।
২০০২ সালের জুলাই মাসে পারভেজ মুশাররফ ঢাকা সফরকালে ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া অস্থিতিশীলতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
পাকিস্তানের কূটনৈতিক জবাব –
১৩ই মে পাকিস্তান পররাষ্ট্র দফতর হতে যুদ্ধাপরাধের দাবি নাকচ করে দেওয়া হয়। এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রানালয় হতে বলা হয়, “ঢাকা অতীতের ঘটনা ভুলে যাবে এবং আমাদেরকেও ভুলতে দিবে। এবং পাকিস্তান বাংলাদেশের দাবীকৃত হত্যা সম্পর্কে কিছু জানে না”। তারা ৩০ লাখ জনসাধারনকে হত্যা করার ঘটনাকে অস্বীকার করে। তারা বলে ৩০ লাখ সংখ্যাটি অযৌক্তিক। একটি দেশের প্রায় ৫% জনগনকে হত্যা করা অসম্ভব। এছারাও কিছু দেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাংলাদেশকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ককে শীতল করার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশকে যুদ্ধাপরাধ হতে বিরত রাখতে পাকিস্তানের অব্যাহত কূটনৈতিক তৎপরতা
পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রানালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব মাসুদ খলি রবিবার বাংলাদেশ গণমাধ্যমকে বলেন, “ বাংলাদেশ যদি বিচার পক্রিয়ার দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখে তবে পাকিস্তান বাংলাদেশ সম্পর্ক শীতল হতে পারে”। যদিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় তবুও ইহা বাংলাদেশ – পাকিস্তানের উষ্ণ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে উভয়েরই জন্য বেদনাদায়ক অধ্যায় বলে অভিহিত করেন। এছাড়া তিনি আরো বলেন আমরা স্থির সময়ের মাঝে নেই। সময় প্রবহমান। আমাদের সামনের দিকে এগুতে হবে পিছনের দিকে নয়।
সর্বশেষ সংবাদ-
জাতীয় সংসদে হাসানুল হক ইনুর এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি বলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয় বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়। এই বিষয়ে কোনো দেশের বিরোধিতা করা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অবমাননার শামিল। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে বলেই জনগণ ম্যান্ডেট দিয়েছেন। তবে বাংলাদেশ অবশ্যই সকলকে আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার দিবে এবং বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানের করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন সাহায্য এবং বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানাবে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং সৌদি আরব সহ অন্যান্য দেশ বাংলাদেশকে বিচার প্রক্রিয়ায় সাহায্য করবে। অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠন আমাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে। কোনো দেশ যুদ্ধাপরাধের বিষয়কে প্রভাবিত করছে না।
বি দ্র – বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মাঝে ৬০০ মিলিয়ন ডলার মুল্যমানের বাণিজ্য সংগঠিত হয়। বাংলাদেশ পাকিস্তান হতে তুলা, সুতা, ফল, এবং গারমেন্টসের কাঁচামাল আমদানী করে অপরদিকে শুধুমাত্র পাট এবং চা রপ্তানি করে। তবে উভয়ের মাঝে সরাসরি বাণিজ্য প্রক্রিয়া চালু হলে বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ২ বিলয়ন ডলারে। এটাই কি অনেক বড় সু্যোগ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে।
এছাড়াও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে বাংলাদেশ যখন আফ্রিকান এল,ডি,সি ভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সাথে একত্রিত হয়ে ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশে কোটামুক্ত ও বানিজ্যে বিশেষ সুবিধা আদায়ের দ্বারপ্রান্তে তখন পাকিস্তান প্রথম এবং শ্রীলঙ্কা তাতে আপত্তি জানায়। এমনকি তাদের আপত্তিতে ভারতও সমর্থন করে।
(বিশ্ব আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল স্বার্থপরতার রাজনীতি এখানে চিরস্থায়ী বন্ধু নাই। তাই কোনো বিশেষ দেশের হুমকি বা অনুরোধে বিচলিত হবার কিছু নাই)
comments off রাখা আমার অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির কারনে হয়েছে। পাঠকদের কিছু মনে না করার জন্য অনুরোধ করছি।
জানি না এত সময় কেন লাগছে
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এক বিবৃতিতে বলেছেন যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের অবনমন নয় বরং উন্নয়ন হবে কেননা তখন অতীতের গ্লানী থেকে পাকিস্তান কিছুটা হলেও মুক্তি পাবে এবং এ দেশের জনগণের ক্ষোভও কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সরকার বিচার পক্রিয়া টানতে টানতে আগামী নির্বাচনের আগে আগে শেষ করবে, যাতে তার একটা ফলাফল তারা হাতে হাতে পেতে পারে।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
আমি ভাবছি আমার এম,এস,এস এর জন্য আমি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম নিয়ে পড়ব। তাই এখন থেকে কিছু পেপার সংগ্রহ করছি। এতে করে বোঝা যায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে সময় নিবে। তা ছারা তারাহুরো করতে গিয়ে তাদের বৈশতা দেওয়ার কোনো মানে নাই।
আবারো ধন্যবাদ মাসুদ ।
:hatsoff:
চলমান একটি বিষয় নিয়ে লিখেছেন ভাইয়া।আমার ক্যান জানি মনে হয় যে আমাদের দেশে war criminal দের বিচার হবে না।নানা টাল বাহানা দেখান হবে।সেটাই হচ্ছে এখন।
যথারীতি চমৎকার লেখা মাসুদ ......... :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:
মাসুদ তোর লেখাগুলা এখানে অন্যরকম স্বাদ দেয়। চালায়ে যাইস। লেখাটা ভালো হইছে। তোর মতো খাটাখুটনি কইরা রেফারেন্স দিয়া ভালো একটা লেখা নামানোর মতো পরিশ্রমী লোক আমি না। তবু কাউকে কাউকে তো করতে হবে, তুইই কর... 🙂
যথারীতি :hatsoff:
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে এটা আমি কখনো মনে করিনা। তবে সতর্ক থাকা অবশ্যই ভালো। আমরা যেমন বলছি যে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে পাকিস্তানকে বাধ্য করতে হবে, তেমনি আমদেরও উচিৎ সরকারকে অনবরত চাপে রাখা যাতে সরকার এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র দেরী বা অসতর্ক না হয়। সবচেয়ে বড়কথা যে আমারা তাদের অপরাধকে আদালতে প্রমান করব।এটা অনেক জটিল ব্যপার। অনেক ভেবে চিন্তে আগাতে হবে যাতে আইনের ফাঁক ফোকরে তারা নির্দোষ প্রমানিত না হয়ে যায়।
ধন্যবাদান্তে,
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শাওন
প্রাক্তন ক্যাডেট , সিলেট ক্যাডেট কলেজ, ১৯৯৫-২০০১
["যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি"]
আগের মন্তব্যে ভুল করে "যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেনা এটা আমি কখনো মনে করিনা।" এর পরিবর্তে লিখে ফেলেছি যে "যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে এটা আমি কখনো মনে করিনা।"
অযাচিত ভূলের জন্য দুঃখিত।
ধন্যবাদান্তে,
মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শাওন
প্রাক্তন ক্যাডেট , সিলেট ক্যাডেট কলেজ, ১৯৯৫-২০০১
["যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি"]