এখনো মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা আব্বু আম্মুর হাত ধরে ক্যাডেট কলেজে ঢুকলাম। সেদিন ভুল করে হাফহাতা শার্ট পরে গিয়েছিলাম। গাইড নাহিদ ভাই আমাকে রুমে নিয়ে গেলেন এবং রুমে থেকে ফুলহাতা শার্ট পরে অডিটরিয়াম এ আসলাম। প্রিন্সিপাল কী যেন বক্তৃতা দিলেন কিছুই মাথায় ঢুকলনা। এরপর আব্বু আম্মু আমার রুম দেখলেন। তারপর একটা সময় বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
সেদিন খুব ঘোরের মাঝে ছিলাম। বুঝতে পারছিলামনা কী হচ্ছে আসেপাশে । আব্বু আম্মুর সাথে নাকি আবোল তাবোল কথাও বলছিলাম। মাথার মধ্যে কেমন যেন লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমি কোথায় যাচ্ছি, কী হবে আগামী কয়েকটা বছর। বাসা ছেড়ে কীভাবে ওই জায়গায় থাকব। জানিওনা কী হয় সেখানে। এমনকি এই ধারণাটুকুও ছিলনা যে সেখানে বড় ভাইরা পানিশমেন্ট দেন। সেদিন যখন পা রেখেছিলাম আমি এমন একটা নবজাতক শিশুর মতন ছিলাম যার কোন ধারণা ও থাকেনা সামনে কী হবে।
ভাবতে অবাক লাগছে সেদিনটার পর আজকে ১০ বছর কেটে গেছে। আমি সেই ক্যাডেট কলেজের গণ্ডি পার হয়ে আজ কীভাবে কীভাবে যেন ভার্সিটিও পার করতে বসেছি। বিশ্বাস হয়না। এই আমি সেদিন কলেযে ছুটি শেষে যাওয়ার সময় মনে করতাম, ইশ কলেজটা যদি ধ্বংস হয়ে যেত। কত মজা হত। বাসায় ছুটি কাটাতে পারতাম। আজ আমি সেই কলেজকেই মিস করি।
আমি যখন এই লেখাটা লিখছি আজ থেকে দশ বছর আগে ঠিক এই সময়ে বরিশালে ফুপুর বাসায় ছিলাম আর ভাবছিলাম আর কয়েক ঘণ্টা পরেই আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে। আর আজকে আমি সেইদিনের স্মৃতিচারন করছি। এর মাঝে কীভাবে কীভাবে যেন দশ বছর কেটেও গেছে। সময় কতই না দ্রুত কেটে যায়!
কিছু কিছু ঘটনা এখনো চোখের সামনে ভাসে। যেমন ক্যাডেটের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট যেদিন দিল। আমি ভাবছিলাম যে ভুলেও চান্স পাবোনা। তবুও প্রথম আলোতে লিস্টে নিজের নাম দেখে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। আম্মু আব্বু ছোট বোন তিনজনই অবাক। কারন পরীক্ষা দিয়ে আমি বলছিলাম যে মনে হয়না চান্স পাব। এমনকি আম্মুকে গোপণে বলছিলামও যে আম্মু আমি আরেকবার ট্রাই করব, দেইখ পারব ইনশাআল্লাহ। Written এ চান্স পাওয়ার জন্য আম্মু নানাবিধ ব্যবস্থা নিলেন। যেমন ওজন বেশি ছিল দেখে প্রতিদিন সকালে খিলগাও ফ্লাইওভারে এক চক্কর হাটা। চোখে প্রব্লেম থাকার কারনে চার্ট নিয়ে আসা হয়েছিল মুখস্ত করানো জন্য(আমি সেই চার্ট মুখস্ত করিনাই এবং মেডিকেলের দিন গিয়ে দেখি সেই চার্ট)। ইত্যাদি আরো নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। ভাইভায় গিয়ে আমি আবার বোকার মতন এক স্যারকে প্রশ্ন করে বসছিলাম। তখন বুঝছিলাম আমি শেষ। প্রথম আলোতে চান্স প্রাপ্তদের তালিকায় নিজের নাম দেখে আমার চেয়ে অবাক বোধ হয় তাই কেউই হয়নি।
এরপর তো ক্যাডেট কলেজে ৬টা অন্যরকম বছর পার করে আসা। কত মধুর স্মৃতি, কত তিক্ত অভিজ্ঞতা, কত হাসি, কত কান্না- এখন যেন মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। খাকি ড্রেসটাকে বস্তা মনে হত আর এখন মনে হয় ইশ খাকি ড্রেসটা যদি ছুয়ে দেখতে পারতাম। ছোটবোন ক্যাডেটে পরে। ওকে যখন বাসায় আসার দিন আর বাসা থেকে যাওয়ার দিন খাকি ড্রেসটা পরতে দেখি খুব সেদিনগুলার কথা মনে হয়। বেল্ট লুজ, জুতা পালিশ নাই, শেভ নাই, ফলিনে দেরি করে আসা- ইত্যাদি কত পিকুলিয়ার পিকুলিয়ার কারনে ইডি খাইতাম। আর আজকে আমার দাড়ি হুহু করে বেড়েই চলে – কেউ ধরেনা। সকালে ড্রিল পিটিতে যেতে কতই না জঘণ্য লাগত। আজকে দিন দিন মোটা হয়ে যাচ্ছি। ওজনটা কমানোর কথা চিন্তা করলে ভাবি ক্যাডেট কলেজের মতন সকালে উঠে যদি একটু দৌড়াতে পারতাম। রুটিনময় জীবনের প্রতি কখনোই আগ্রহ প্রকাশ করিনাই। তবুও ক্যাডেট কলেজের সেই রুটিনটার প্রতি কেন যেন একটা অদ্ভুত আবেগ আছে। সেই বৃহস্পতিবার রাত, এখনো মিস করি। এখনো মুভি দেখি- নিজের ল্যাপটপে একা একা বসে। মাঝে মধ্যে দু একটা ফ্রেন্ডের সাথে বসেও মুভি দেখি। আর মিস করি সেই ভিডিওশোগুলাকে ।
ক্যাডেট কলেজ আসলে আমার জীবনে অনেক বড় একটা অংশজুড়ে ঠাই করে নিয়ে আছে। সেই ছোট ছোট পায়ে মায়ের আদরের মায়া ত্যাগ করে প্রবেশ করেছিলাম সেই অদ্ভুত জগতে। আমার আর বন্ধুরা যখন মায়ের হাতের রান্না খেত তখন ডাইনিং হলের কুকদের রান্না খেতে খুব আক্ষেপই লাগত। যখন ঘরে বসে কম্পিউটারে গেমস খেলত, বাইরের ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিত বা স্কুল পালাত তখন আমরা সবাই মিলে ফলিন হয়ে পানিশমেন্ট খেতাম। খুব রাতে যখন পড়ত মা হয়ত তখন হরলিকস এনে দিত খাওয়ার জন্য আর আমাদের তখন হাউস বেয়ারা এসে করিডরের লাইটটা বন্ধ করে দিয়ে যেত বা স্যার দেখলে ধমক দিয়ে যেত। সকালে ঘুমুতে দেখলে মা হয়ত ভালবেসে ডাক দিতনা – থাকনা ছেলেটা ঘুমোচ্ছে ঘুমাক। তখন আমরা তিন চক্কর দিতাম।
হ্যা দেখে মনে হচ্ছে এ জীবনটাকে একটা মানুষ কীভাবে ভালবাসে। কীভাবে এই দিনগুলার স্মৃতি রোমন্থন করে ? কিন্তু সেই শৃংখলাবদ্ধ জীবনের প্রতি কেমন যেন একটা ভালবাসা জন্মে গেছে । কঠিন নিয়মে আবদ্ধ সেসময়গুলোর মাঝে কীভাবে কীভাবে যেন আনন্দ খুজে নিয়েছিলাম আর ৪৮টা মানুষের সাথে। কঠিন সময়ে হেসেছি সবাই মিলে। লড়েছি সবাই মিলে। খুব অদ্ভুত একটা সময় কাটিয়ে এসেছি। এখনও মনে হয় আমি একটা সময়ে ক্যাডেট ছিলাম! কীভাবে ছয় বছর পার করলাম। এখনও মনে আছে যখন মাগরিবের নামাজ পড়তে কলেজ মস্কের দিকে যেতাম, হাইওয়েটার দিকে তাকিয়ে খুব ইচ্ছা করত কলেজ ছেড়েছুড়ে বাসায় গিয়ে আরাম করি। আর আজ যখন ক্যাডেট কলেজের পাশ দিয়ে বাসে যাই খুব ইচ্ছে হয় কলেজে গিয়ে যদি একদিন থেকে আসতে পারতাম। জীবনটা কতই না অদ্ভুত! জীবনের সেই কাঠিন্যের মাঝে যেতে চাইনা। অল্প কিছু কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। ক্যাডেট কলেজ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। খুব কষ্ট লাগে আজ পর্যন্ত এমন কিছুই করতে পারিনাই যার জন্য কলেজ আমার জন্য গর্ববোধ করে। হয়ত কখনোই কলেজকে কিছু দিতে পারবোনা। কিন্তু জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ক্যাডেট কলেজকে ভালবেসে যাব। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে যাব আমাকে এত বড় একটা সম্মান প্রদান করার জন্য।
প্রথম 🙂
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মনে হচ্ছে ৪/৫ বছর আগের লেখা। নতুন করে এডিট করা হয়নি।
পুলাপাইন আইলস্যা হয়া গ্যাছে :chup:
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ,
ও তো কলেজে গেছেই দশ বছর আগে, মানে ২০০৫ এ। আমি তো কোন সমস্যা দেখতেসিনা।
লেখার পর ৪/৫ বছর কাটলো কোনদিক দিয়ে
আরে, এ যে দেখি "নতুন" রাশেদ; আমি ভাবছিলাম (১৯৯৯-২০০৫) এর রাশেদ, সিসিবি'র শৈশবকালের নিয়মিত একজন!
যাইহোক, ব্লগারের নামের পাশে সাল দেখায় ফাঁকি মেরে আমি নিজেই প্রমাণ করে গেলাম যে, ক্যাডেট ফাঁকি মারে 😀
দুঃখিত নতুন রাশেদ, অনিচ্ছায় ভুল করে তোমাকে ফাঁকিবাজ বলায়। আর নূপুর ভাইকে ধন্যবাদ আমার ভুল্টা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।
শুভ ব্লগিং! (সম্পাদিত)
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
না ভাইয়া আমি কিছুই মনে করিনি 😀
পড়লাম। আর্কাইভিং-এর জন্য ভাল বিষয়। সব বন্ধুরা যদি তাঁদের অভিজ্ঞতা এইভাবে লিখে ফেলে, দারুন হয় ব্যাপারটা।
প্যারাগ্রাফ স্পেসিং কমাও, দেখতে অসুবিধা হচ্ছে...
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
সরি ভাইয়া আসলে লেখার সময় এ বিষয়গুলো মাথায় ছিলনা। মাথায় যেভাবে কথাগুলো আসছিল ঠিক সেভাবেই উপস্থাপন করেছি। বহুদিন পর আসলে লেখার চেষ্টা করেছিলাম তো এজন্যই হয়ত এসকল ভুল হয়ে গেছে 🙂
ভাল লাগলো রাশেদ :thumbup:
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
"আর আজ যখন ক্যাডেট কলেজের পাশ দিয়ে বাসে যাই খুব ইচ্ছে হয় কলেজে গিয়ে যদি একদিন থেকে আসতে পারতাম। জীবনটা কতই না অদ্ভুত!" - উত্তরবঙ্গের যেকোন জেলায় সড়কপথে যেতে হলে আমার কলেজ এমসিসি এর সামনে দিয়ে যেতে হয়। এখনো যাবার সময়, যদি ঘুমিয়ে না পরি তবে 'আইজ লেফ্ট' আর ফেরার সময় 'আইজ রাইট' করে ঐ নির্দ্দিষ্ট জায়গাটুকু পার হই। আর ঘুমিয়ে গেলে ঘুম ভাঙ্গার পর চোখ কচলে খুঁজতে থাকি আর না দেখার জন্য আফসোস করতে থাকি।
ক্যাডেট কলেজে প্রথম দিন নিয়ে আমারও একটা কবিতা আছে। সাইদুলের "প্রথম কান্না" পড়ার পর আমি আমার কবিতাটাকেও এখানে প্রকাশের উদ্যোগ নেই "প্রথম কান্নার পর" শিরোনাম দিয়ে। ওটা এখন এডমিনদের বিবেচনাধীন আছে। আশাকরি যথাসময়ে ওটা এখানে প্রকাশ পাবে।
শুধু উদ্ধৃতিটুকু বোল্ড করে দিতে চেয়েছিলাম, কি করে যেন পুরোটাই বোল্ড হয়ে গেলো। সরি!
:thumbup:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
ভাল লেগেছে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ