স্বপ্ন-১

“স্বপ্ন” শব্দটাই আমাদের কেমন যেন স্বপ্নাতুর করে ফেলে। স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে না এমন কোন মানুষ কী এ পৃথিবীতে আছে?? থাকা সম্ভব? শুধু তা-ই নয়, যে কোন স্বপ্ন দেখলেই, বিশেষ করে অদ্ভূত কোন স্বপ্ন দেখলেই আমরা নেমে পড়ি তার রহস্য উদঘাটনে- কী দেখলাম, কেন দেখলাম, স্বপ্নটার কী কী অর্থ থাকতে পারে ইত্যাদি নিয়ে শুরু হয়ে যায় বিস্তর চিন্তা-ভাবনা, কাছের মানুষদের সাথে আলোচনা। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এমন অতি চর্চিত বা সাধারন বিষয়টা নিয়ে আমাদের বেশীরভাগ আলোচনাই বিভিন্ন কুসংস্কার বা শোনা কথার ভিত্তিতে হয়ে থাকে, আর “সোলেমানী খাবনামা” নামক বইটাতো নাচনে বুড়ীর উপর ঢোলের বাড়ির মত। বাংলাদেশে বোধহয় এমন কোন বইয়ের তাক খুঁজে পাওয়া ভার যেখানে এই বইটি নেই। এটি বোধহয় বাংগালীর অন্যতম প্রিয় একটি বই!
আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগ থেকেই স্বপ্ন নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষনা শুরু হয়েছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। যদিও সিগমুন্ড ফ্রয়েডের আগে কেউই এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন অবদান রাখতে বা আবিস্কার করতে পারেননি। কিন্তু ফ্রয়েড বা তার পরবর্তী বিভিন্ন গবেষকের হাত ধরে স্বপ্ন সংক্রান্ত গবেষনা পাড়ি দিয়েছে প্রায় ১০০ বছর। আর এ সময়ে স্বপ্নের শারীরতাত্ত্বিক ভিত্তি, স্বপ্ন বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, স্বপ্ন দেখার কারনসমূহ, স্বপ্ন সংক্রান্ত বিভিন্ন মানসিক রোগ, এমনকী স্বপ্নের মাধ্যমে মানব মনের বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বা গতিবিধি নিয়ন্ত্রন ইত্যাদি স্বপ্ন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে হাজার হাজার গবেষক চালিয়ে গেছেন তাদের নিরলস গবেষনা। আর এই গবেষনার ফলেই আমরা আজ স্বপ্নকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভংগী দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধের আলোকে স্বপ্ন নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ভাবে আলোচনা বা গবেষনা করতে পারি ( যদিও আশেপাশের অনেক মানুষের আচরনেই মনে হয় তারা সোলেমানী খাবনামা’তেই বেশী সন্তুষ্ট ছিলেন। স্বপ্নের বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা তাদের কাছে রস-কষহীন মনে হয়, বরং কুসংস্কারসর্বস্ব বিশ্লেষনেই তাদের অগাধ আস্থা!)।
স্বপ্ন নিয়ে বলতে চাইলে বলার অনেক কথাই আছে, তাছাড়া স্বপ্ন নিয়ে আমাদের ভ্রান্তিগুলো দূর করার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাই করা প্রয়োজন। কিন্তু আজ শুধু স্বপ্ন দেখার বিভিন্ন কারনের কথাই বলব। পরবর্তীতে হয়ত অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়েও বলব। খুব সহজ করে বলতে গেলে স্বপ্ন দেখার কারন হিসেবে যে বিষয়গুলিকে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা যায় সেগুলো হল-
১/প্রধানতঃ স্বপ্ন আমাদের অবদমিত কামনা বা আকাংখাসমূহ যা প্রচলিত সমাজ বা ব্যাক্তি বিবেকের দৃষ্টিতে অগ্রহনযোগ্য বা আপত্তিকর অথবা নানাবিধ কারনে বাস্তবায়নযোগ্য নয়, সেগুলো পূরনের একমাত্র মাধ্যম ( যদিও তা আমাদের জাগ্রত, বাস্তব অবস্থায় ঘটছে না)। যেমন- আমি হয়ত স্বপ্নে মেসির সাথে ফুটবল খেলছি বা শচীনের সাথে জুঁটি বেঁধে রানের পাহাড় গরে তুলছি। স্বপ্নের মাধ্যমে অবদমিত বাসনা পূরনের এ ঘটনাটি আমাদের জীবনে এক রাত বা দুই বা বহু রাত নয়, বরং প্রতিটি রাতেই ঘটে। আর এমনটা ঘটে বলেই একটা গোটা দিন শেষে ঘুমের মাঝে দেখা স্বপ্নে নিজেদের অবদমনের চাপ থেকে আমরা ভারমুক্ত হয়ে আরেকটি ঝরঝরে সতেজ দিন শুরু করতে পারি। সার্বিক অর্থে একজন মানুষের মানসিক বিকাশ, সুস্থতা বা ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে স্বপ্ন দেখার এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ দায়িত্ব পালন করে।
২/এরপর বলা যেতে পারে ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের শারীরিক পরিস্থিতি বা শারীরতাত্ত্বিক বাস্তবতার কথা। যেমন- শরীরের কোন অংশে ব্যাথা বা প্রচন্ড ক্লান্তি বা পাকস্থলীতে গ্যাসের উতপাত, এমনকী হয়ত আমাদের শরীরে উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোন পোকার উপস্থিতি ইত্যাদি। এরকম বিভিন্ন শারীরিক পরিস্থিতি স্বপ্নের বিভিন্ন গঠনগত উপাদান তৈরীতে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন- হয়ত স্বপ্নে হন্যে হয়ে টয়লেট খুঁজছিলাম, জাগার পরে দেখা গেল আমার আসলেই টয়লেটের বেগ পেয়েছে অথবা স্বপ্নে পেট পুরে বিরানী খেয়ে হয়ত পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছিল, জেগে উঠে দেখলাম সত্যিই আমার পিপাসা পেয়েছে।
৩/স্বপ্ন দেখার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কারণ হল আমাদের কোন বিষয়, ঘটনা বা ব্যাক্তিকে ঘিরে ভাবনা বা চিন্তা, অনেক ক্ষেত্রে এর সাথে যুক্ত হতে পারে ঐ ঘটনা, ব্যক্তি বা বিষয় সংক্রান্ত কল্পনার অনেকটাই। এটি হতে পারে ঠিক ঘুমুতে যাবার আগের সময়ের বা সারাদিনের বা বিগত কয়েকদিনের এমনকী অতীতের কোন সময়ের চিন্তা বা ভাবনাজাত। যেমন- সাধারনতঃ পরীক্ষার আগের বা মধ্যবর্তী দিন গুলোতেই আমরা সাধারনতঃ পরীক্ষা সংক্রান্ত স্বপ্নগুলো দেখে থাকি বা চাকুরীর সাক্ষাতকার দেবার আগের দিন আমরা প্রায়ই সাক্ষাতকারের প্রথম অংশটা স্বপ্নেই সেরে ফেলি।
৪/এরপর বলা যেতে পারে ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের চারপাশের পরিবেশের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কথা, যেমন- বাতাস, তাপমাত্রা, শব্দ, আলো ইত্যাদির মাত্রা বা মাত্রার পরিবর্তন, এমনকী কোন ঘ্রাণ, বিছানার ধরন, শোয়ার ভংগী ইত্যাদি। যেমন- হয়ত স্বপ্নে আমি হঠাত চলে গেলাম সমুদ্র তীরে যেখানে প্রবল বেগে বাতাস বইছে, ঘুম ভেংগে দেখা গেল মাথার কাছের বন্ধ জানালাটা কে যেন খুলে দিয়ে গেছে।
৫।সাধারন বা দৈনন্দিন ভাবনা বা চিন্তার বাইরেও আমরা যদি গভীরভাবে দীর্ঘ্যদিন কোন কিছু নিয়ে ভাবতে থাকি তাহলেও সেই ভাবনা বা চিন্তা দ্বারা স্বপ্ন প্রভাবিত হতে পারে। যেমন- স্বপ্নযোগে অগাস্ট কোকুলের বেনজিন চক্রের গঠন বা উইলিস কতৃক মানব মস্তিষ্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধমনীতন্ত্রের গঠন আবিস্কারের কথা আমরা কে না জানি!
৬/অনেক সময় ঘুমের শেষভাগে বা আমাদের জাগ্রত হবার খানিকটা আগে আমাদের মস্তিষ্ক পরিপ্বার্শ থেকে যে উদ্দীপনা গুলো গ্রহন করে তা স্বপ্নের উপাদান হিসেবে দেখা দিতে পারে। যেমন- আমরা প্রত্যেকেই হয়ত জীবনে দু’একবার এমন স্বপ্ন দেখে থাকব যেখানে আমরা স্বপ্নে টের পাচ্ছি যেন কেউ কলিং বেল বাজাচ্ছে বা আমাদের মোবাইলের রিং টোন বাজছে, আর ঘুম ভেংগে দেখা গেল আসলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমাদের টেবিল ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে চলেছে।
৭/সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন বিষয়ে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করেও অনেক সময় আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি, তবে এভাবে স্বপ্নের উপাদান বা বৈশিষ্ট্য সাধারনতঃ নিয়ন্ত্রন করা যায় না। সেটা হয়ত আমাদের সচেতন মনের সাথে অবচেতনের বোঝা পরার দুরত্বের কারনেই ঘটে বা স্বপ্নের জগতে অবচেতনের কতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ।
৮/আবার প্রায়শঃই এমন কোন স্বপ্ন দেখতে পারি যা আমাদের নিয়ে যায় ফেলে আসা জীবনের বিভিন্ন মানুষ, ঘটনা বা স্মৃতির কাছে। হ্যা, অতীত রোমন্থনের একটি মাধ্যম হল স্বপ্ন। যার মাধ্যমে আমরা হয়ত এমন কিছু দেখি যা আমরা অনেক আগেই পিছনে ফেলে এসেছি ।
যাই হোক, স্বপ্ন দেখার আরো কিছু কারন বলা যেতে পারত, তবে তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক থাকায় সেগুলি এড়িয়ে গেলাম, যেমন- স্বপ্নের মাধ্যমে নিজের ভবিষ্যত দেখতে পাওয়া বা স্বপ্নে দেখা কোন ঘটনার সাথে বাস্তবের কোন ঘটনার হুবহু মিলে যাওয়া (যদিও আমরা প্রকৃতপক্ষেই দেখা স্বপের কতটুকু, কতক্ষণ সঠিক ভাবে মনে রাখতে পারি তা তর্কসাপেক্ষ!) ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে বিজ্ঞান এখনো স্থির কোন বক্তব্য পৌঁছাতে পারে নি, কিন্তু তার মানে কী এই যে ঘুম ভেংগেই আমরা সোলেমানী খাবনামা উল্টে নিজেদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা খুঁজতে বসে যাব? বা কোন গণকের কাছে ছুটব? উত্তরের ভার আপনাদের উপরেই রইল।

৬৮৬ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “স্বপ্ন-১”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আমি কেন জানি স্বপ্ন খুব কমই দেখি অথবা দেখলেও মনে রাখতে পারি না 🙁


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

    At that time the Prophet was in Mecca, and he said to the Muslims, "In a dream I have been shown your migration place, a land of date palm trees, between two mountains, the two stony tracts." So, some people migrated to Medina, and most of those people who had previously migrated to the land of Ethiopia, returned to Medina.

    (Book #58, Hadith #245)


    Smile n live, help let others do!

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।