দূর্নীতি নিয়ে বোধহয় দূর্নীতিপরায়ন দেশগুলোতেই বেশী শোরগোল লেগে থেকে। প্রায় প্রতিদিন আমাদের মিডিয়া সবিস্তারে দুদক ( দূর্নীতি দমন কমিশন)-এর বিভিন্ন কর্মকান্ড বর্ননা করে। কিন্তু প্রশ্ন হল যতখানি শোরগোল হয় তার ডামাডোলে আসলেই কতখানি কাজ হয়? আদৌ কী এর কোন প্রভাব সমাজে তৈরী হচ্ছে? আমার মনে হয় সামান্য কিছু প্রভাব অবশ্যই পড়ছে, তবে নিশ্চয়ই তা যথেষ্ট নয়। আবার ভাবতে গিয়ে মনে হল হবেই বা কী করে?? এদেশের প্রতিটি মানুষ বা পরিবার প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে, স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, কম বা বেশী, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দূর্নীতির সাথে জড়িত। ভদ্রতা বা সামাজিকতার অজুহাতে আমরা প্রত্যেকে যে সাহায্য আমাদের আত্মীয়-স্বজনকে করতে চাই তার আরেক নাম হল স্বজনপ্রীতি- আর এটাই হল যাবতীয় দূর্নীতির প্রসূতি স্বরুপ। ধূমপান যেমন যাবতীয় নেশার পথে আমাদের ধাবিত করে, এই তথাকথিত ভদ্রতা বা সামাজিকতার দায় মিটাতে গিয়ে আমরা যে স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নেই সেটা আমাদের ধাবিত করে দূর্নীতির দিকে। আর যে বাঘ একবার নরমাংসের স্বাদ পায়, বা সীমিত আয়ের যে মানুষ একবার নিশ্চিন্ত, সহজসাধ্য, হিসেবহীন অর্থের স্বাদ পায় সে বাঘ বা মানুষকে ঠেকায় কে!!
তবে এর চেয়ে গুরুতর , সম্ভবতঃ দুর্নীতির প্রধানতম ( সামাজিক বৈষম্য বা অবিচার জনিত কারন ব্যতীত) কারন আমাদের প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারের , প্রায় প্রত্যেকটি পারিবারিক সদস্যের মাঝে নিহিত!! জানি, আমি অত্যন্ত আপত্তিকর বা অস্বস্তিকর কথা বলে ফেলেছি। যথেষ্ট তত্ত্ব, উপাত্ত না দিতে পারলে অনেকেই আমার উপর ক্ষুব্ধ হবেন। বেশ, আসুন একটু হিসাবটা মেলাই। কিছু প্রশ্ন নিজেদের করে দেখি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি- বন্ধুর বিয়েতে কম দামী উপহার দিলাম কেন? ১৬,০০০ টাকা বেতন নিয়ে একজন শিক্ষকের দায়িত্ব আন্তরিকতার সাথে পালন করা সত্ত্বেও রোগী দেখে (অবশ্যই সেবার অর্থে নয়) অর্থ উপার্জন করি না কেন? আমি কী উপহার হিসেবে বই এজন্যই পছন্দ করি , যে বই কিনতে কম টাকা লাগে? এ জাতীয় প্রশ্ন আমাকে হরহামেশাই শুনতে হয়। আর এসব প্রশ্নের অর্থ আমার কাছে একটিই, যারা এসব প্রশ্ন করেন তারা চান আমি অর্থ উপার্জনের জন্য হন্যে হয়ে উঠি, আর আগেই বলেছি অর্থের অতিরিক্ত আকুতি-ই সকল অনর্থের মুল। অথচ সেটা যখন ঘটবে তারা-ই আবার কোমর বেঁধে আমার সমালোচনা করতে নামবেন।
আচ্ছা, ৭,০০০ টাকা বেতন পাওয়া কোন ছেলে যখন তার বাবার জন্য ২০,০০০ টাকার মোবাইল কিনে ঘরে ফেরেন, তখন কয়জন বাবা প্রশ্ন করেন, টাকাটা ছেলে কোথায় পেল? ১৫,০০০ টাকা বেতন পাওয়া স্বামী যখন স্ত্রী-সন্তানদের মালয়েশিয়া বেড়াতে নিয়ে যান, তারা কী প্রশ্ন করে এত টাকা কোথা থেকে এল? আমার বিশ্ব্যবিদ্যালয় পড়ুয়া ভাই যখন আমাকে কয়েক হাজার টাকা দামের পাঞ্জাবি উপহার দেয়, আমি কী জানতে চাই তার অর্থের উতস কী? একজন কলেজ পড়ুয়া প্রেমিক যখন প্রেমিকাকে ল্যাপ্টপ উপহার দেয়, সে কী মুচকী হেসে জানতে চায় এর অর্থের যোগান দিতে তার প্রেমিককে কী করতে হয়েছে? এমনকী স্নেহময়ী মায়ের বড় মাছের মুড়োটা কুটতে কুটতে যখন আনন্দে চোখে জল আসে, উনি কী ক্ষনিকের জন্যও ভাবেন তার বেকার বা সীমিত বেতন পাওয়া ছেলেটি প্রতি সপ্তাহে হাত ভর্তি করে বাজার কোথা থেকে কীভাবে আনে? আমার মেয়ে হয়ত একদিন জানতে চাইবে আমি মেসির মত ফুটবল খেলতে পারি কীনা, অথবা সুন্দর গাইতে পারি কীনা, কিন্তু সে কী কোনদিন জানতে চাইবে যে ঘরে, যে বাড়িটিতে সে বেড়ে উঠছে তার প্রতিটি ইট, পাথর, বালুকনা কোন অর্থে কেনা? আমার চারপাশ দেখে আমার স্থির বিশ্বাস প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা এই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে চলি। আর সত্যকে এড়িয়ে চলার এই সাধারন প্রবনতাই আমাদের সত্য থেকে ক্রমাগত বহু দূরে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সম্ভবতঃ মাত্র দুইটি কাজ আমরা সুচারুভাবে করতে পারলে এদেশে দূর্নীতি দমনের জন্য কমিশন-ও লাগবে না, আর সামাজিক নীতিবাগ্মিতার প্রদীপের নীচের অন্ধকারও থাকবে না। এক- আমরা প্রত্যেকে আমাদের পরিবারের সকল উপার্জনক্ষম ব্যক্তির আয়ের উতস সম্বন্ধে সচেতন থাকব এবং যে কোন অস্বাভাবিকতাকে সাবলীলতার সাথে প্রশ্নবিদ্ধ করব। দুই- আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে সর্বোচ্চ দূর্নীতি পরায়ন ব্যক্তিটির সাথে সমস্ত সামাজিক সম্পর্ক এই শর্তে স্থগিত রাখব যে, তিনি অন্ততঃ সহনীয় মাত্রায় দূর্নীতি করলেও আমরা স্বাভাবিক আচরন করব, নতুবা নয়। আর সবার আগে যে কোন প্রকারে পরিবার বা সমাজের কাছে নিজের আর্থিক সামর্থ্য প্রমানের প্রবনতা বা পরিবারের সদস্যদের লাগামহীন আকংখার টুটি চেঁপে ধরতে হবে শক্ত মুঠোয়।
শেষ করব দু’টি গল্প দিয়ে । প্রথমটি ৫০ –এর দশকের শেষভাগে সোভিয়েত রাশিয়া’য় পতিতাবৃত্তি উতখাতের গল্প – সাধারনভাবে ধরে নেয়া হয় যে, পতিতাবৃত্তি মানব সমাজের আদিমতম পেশা। আর এটা সবারই জানা, আইন ও ধর্মের যাবতীয় ততপরতাকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে পেশাটি সদা সততঃ সকল সমাজেই বিরাজমান। কিন্তু রাশিয়া কিন্তু অন্ততঃ কয়েক দশকের জন্য হলেও এটা থেকে গোটা রাশিয়াকে মুক্ত করতে পেরেছিল। সংক্ষেপে শুধু বলি তারা কী করেছিল। কোন পতিতালয় পুলিশ রেইড দিয়ে যে খদ্দেরদের পেত তাদের নাম ঠিকানা নিয়ে ছেড়ে দিত আর পতিতাদের পুনর্বাসনের জন্য একটি আলাদা সরকারী দপ্তর নিয়োজিত ছিল। পরের দিন প্রত্যেক খদ্দেরের বাড়ীর মহল্লার মোড়ে মোড়ে বড় করে তাদের নাম ও তাদের গতরাতে কোথায় কী অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল তা লিখে টাংগিয়ে দেয়া হত। ব্যস,কয়েক মাসের মধ্য পতিতালয়গুলো খদ্দের শুন্য হয়ে পড়তে শুরু করল।( আশ্চর্য্য হল, যুগে যুগে এ ধরনের ঘটনার জন্য পতিতাদের দায়ী বা শাস্তি দেয়া হলেও খদ্দেরদের ব্যপারে সবাই সর্বকালে ছিল উদাসীন!)(উতসঃ ডাইসন কার্টারের “সামাজিক পাপ”)। আর শেষের ছোট গল্পটি হল মহানবী হযরত মুহাম্মদ(সঃ)-এর। ওনাকে কেউ কিছু খেতে দিলে উনি আগে নিশ্চিত হয়ে নিতেন সে খাবারে উতস কী। একবার প্রচন্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় উনি ঘরে ফিরে খাবার চাইলে ওনার সহধর্মিনী ওনাকে কিছু খাবার খেতে দেন, কিন্তু মাঝ পথে নবীজির মনে হয় এই খাবারের উতস ওনার অজানা। উনি ততক্ষনাত গলায় আংগুল দিয়ে বমি করে ফেলেন, এরপর প্রশ্ন করে খাবারের উতস সম্বন্ধে নিশ্চিত হন, অতঃপর আবার খাওয়া শুরু করেন।
গল্পদুটি থেকে ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে যে কোন অন্যায় প্রবনতার বিরুদ্ধে সতর্কতা বা সাবধানতা হিসেবে কী করা যেতে পারে তার ছোট্ট, সাধারন দুটি উদাহরন পাওয়া গেল। দেখার বিষয় হল এই সাধারন শিক্ষাটা ধারন করার মধ্য দিয়ে আমরা পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অসাধারন কিছু ঘটাতে পারি কী না?? অন্ততঃ এতটুকু চেষ্টা তো করে দেখা যায়!!
২৯ টি মন্তব্য : “দূর্নীতি?? অন্যেরা করে,আমরা সাধু!”
মন্তব্য করুন
অসাধারন লেখা আসিফ ভাই :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:
শুধু মাত্র অর্থ বিত্তই এখন আমাদের সমাজে মর্যাদার মাপকাঠি, কে কি ভাবে তা অর্জন করছে তা কোন ব্যাপার না। অপ্রিয় প্রশ্নগুলো যতক্ষন না আমরা করা শুরু করতে পারবো ততক্ষন পর্যন্ত আমাদের দূর্নীতিসহ অন্যান্য সামাজিক সমস্যাগুলো থেকে বের হতে পারবো না।
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
প্রত্যেকটি সামাজিক সমস্যার পিছনেই আমাদের নিরন্তর উদাসীনতা দায়ী। আমার এখনো মনে আছে আমাদের পাড়ায় কেউ মেয়েদের উত্যক্ত করলে তাকে বিচারের সামনে দাড়াতে হত, আর আমরা তাকে নিম্নস্তরের পুরুষ মনে করতাম, আর আজ??
অসাধারন ::salute::
:shy:
দারুন একটা লেখা পড়লাম। অসাধারণ।
চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।
🙂
অসাধারণ লেখা আসিফ ভাই। খুব ভাল লাগল পড়ে। ::salute::
তানভীর আহমেদ
ভাইয়া অসাধারন একটা লেখা। এই কথাগুলো মনে মনে অনেক ভেবেছি, দু'একজনকে হয়ত বলেছিও। সবাই দুনীতি করছে, আর শেষে সরকার আর সমাজ ব্যাবস্থাকে দোষী করে বিশাল বক্তব্য দিচ্ছে।
আসিফ তুমি একেবারে আমার মনের কথাগুলো লিখেছো। গতকাল রাতেই আমি ভাবছিলাম আমার দুর্নীতিপরায়ন আত্মীয়কে পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দেব যে আমি আপনাকে বয়কট করলাম।
আমি একটা উপন্যাস লিখেছিলাম। সেখানে মাত্র এক পৃষ্ঠার মধ্যে কয়েক লাইন প্রকৌশলীদের দূর্নীতি নিয়ে লিখেছিলাম। দেশে কিংবা বিদেশে আমার পরিবারের অধিকাংশ পুরুষরা আবার প্রকৌশলী। তাদের দু-একজনের বৌরা আবার আমার সেই কটা লাইনকে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসেবে নিয়েছিল। তারা আমার কাছে এই ব্যাপারে পরোক্ষভাবে নিজেদের সাফাই গেয়েছে। আমাদের লেখাগুলো যে কোন কাজে দেয় না তা কিন্তু ঠিক নয়। একজন-দুইজন ধাক্কা খেলেও অনেক। বিন্দু থেকেই তো সিন্ধু হয়। আমি এই রকম কার্যকরী অনেক লেখা দেখতে চাই।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
চমৎকার লেখা আসিফ ভাই। সহজ ভাষায় সত্যি কথাগুলো সুন্দরভাবে বলে গিয়েছেন।
পাঁচ তারকা। শেয়ার করলাম লেখা।
জনগণের টাকায় মেডিকেল পড়েছি। দেশের মানুষের পাশে না থেকে, পরিবারের পাশে না থেকে বিদেশে যে 'গবেষণা' করছি তা দেশের মানুষ কেন, মনবজাতিরই কোন কাজে আসবে যে না তাতে মোটামুটি নিঃসন্দেহ। এটাও তো দুর্নীতি।
দেশেও চাকরি শুরু করার আগে, কোন এক শুক্রবার (ছুটির দিন) সুবিধাজনক জায়গায় (কম প্রত্যন্ত অঞ্চলে)পোস্টিং এর জন্য খামভর্তি ঘুষ দিতে গিয়েছিলাম।
"তাতাড়ি দ্যান কি দিবেন, নামাজের সময় চইলা যাইতেসে''। গুনে বললেন, কম দিলেন তো। দরদাম করে পোস্টিং ঠিক করলাম। এসব ডালভাতের মতো হয়ে গিয়েছে আমাদের কাছে, এই যে ঘুষ দিয়ে অন্যায়টুকু করলাম সেটাকে অন্যায় ভাবার ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে গিয়েছে আমাদের, শুধু যে নিল তার দোষ দেখি নিজেরটা চোখে পড়েনা।
[সেবার পরিস্থিতি এমন হয়েছিলো যে, পোস্টিং পাবার জন্য সিংহভাগ লোককেই কিছু না কিছু দিতে হয়েছিলো। রিজিওনাল হেলথ ডিরেক্টরকে সরাসরি টাকা দিয়েছে এমন লোকও আছে, উনার বাসায় গিয়ে তার স্ত্রীর হাতেও খাম ধরিয়ে দিয়েছে এমন চেনা ডাক্তারও কম নয়। রাগে দুঃখে দেশের প্রধান সব পত্রিকায় ইমেইল করেছিলাম ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে, কোথায় কিভাবে কি হচ্ছে তা জানিয়ে। কেউ আসেনি, কিচ্ছু থামেনি; সরকারী অফিসে খোলামেলা বাজারে পোস্টিং বেচাকেনা হয়েছে। শেষে থানচি বা রুমায় পোস্টিং ঠেকাতে টাকা হাতে নিয়ে দৌড়েছিলাম আমিও। ছাত্রজীবনের সব নীতিবোধ একদিনে বিকিয়ে গেলো।]
রাজনীতি থেকে শতহস্তে দূরে থেকে সব কিছুতে রাজনীতিবিদদদের দোষ দেখাও দুর্নীতি (যা হরহামেশাই করছি প্রতিদিন)।
নিজের নীতিহীনতার পরিমাণ দেখে অন্যের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে সাহস পাইনা, ভরসা পাইনা।
নূপুরদা কিছু কিছু জায়গায় আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করছি। দেশের টাকায় পড়ে এসে কোথায় কাজ করলাম তার থেকে দেশের জন্য কি করলাম তা মনে হয় অধিক বিবেচ্য হওয়া উচিত। আর দেশের জন্য করার জন্য দেশে সশরীরে থাকার প্রয়োজন হয়না। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় আর গেলাম না। শুধু কষ্ট পাই যখন একদিন যে বান্ধবীটিকে দেখে মনে করতা্ম সে একদিন অনেক কিছু করবে - এখন তাকে যখন মাদ্রাসার জন্য ফাণ্ড রাইজিং করাটাকেই একটা মহৎ কাজ বলে মনে করতে দেখি তখন আহত হই। সে দেশেই থাকে। এবং দেশে থেকে সে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থাই গুছিয়ে আনতে পারেনি - অন্যের জন্য করবে কি। মাদাম তেরেসা তো আর সহজে জন্মায় না যে সবাই নিজের কথা না ভেবে সবার কথা আগে ভাববে।
অফিসে একটা সেকশন চালাবার সময় আর নিজের পরিবার দেখভাল করতে গিয়ে যেটা বুঝিছি সেটা হলো বস কেমন তার উপরেই নির্ভর করে যে কোন প্রজেক্ট, তা সে একটা মুদী দোকানই হোক কিংবা দেশই হোক, এর সফলতা। শুধু আমি ভাল হয়ে তেমন প্রডাকটিভ কিছু করতে পারবো না(আমার গান্ধির মতো প্রফেটিক পাওয়ার থাকলে ভিন্ন কথা) যদি না আমি একটা ভাল সিস্টেমের মধ্যে না থাকি।
আমি জানি আপনার মত শুধুই আপনার ব্যক্তিগত অভিমত। আমিও আমার ব্যক্তিগত অভিমত জানালাম।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
শান্তা,
তুমি যেখানটায় দ্বিমত পোষণ করেছো, সেটা আমি বুঝি। বুঝি যে দেশের বাইরে গেলেই দেশের সংগে সম্পর্ক ছিন্ন হয়না, দেশের জন্যে কিছু করার প্রয়োজন বা সামর্থ্যও ফুরিয়ে যায়না। কিন্তু আমি এখনো বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের মতো দেশের জন্যে (আমাদের মতো লোকদের সেখানে পড়ে থেকে) সম্মুখসমরটা অনেক বেশী দরকারী। ফিল্ডে থেকে সমস্যাগুলোকে হতেকলমে মোকাবেলা করাটাই ছিলো (আমি মনে করি আমার ক্ষেত্রে) বেস্ট অপশন। এখন তো পৃথিবীটা আরো ছোট হয়ে আসছে, সত্যি সত্যি বড় কিছু করার স্কোপ দেশের বাইরে থেকে এখন অনেকই বেশি। তাছাড়া খুব গুরুত্বপূর্ণ না হোক, ছোটখাট কিছু আবিষ্কার হয়তো করেও ফেলতে পারি যেটা মানুষের কাজে লাগবে। আশা করতে দোষ কি বলো।
প্রথমেই বলে লেই- এই পোষ্টটা গত কয়েকদিনের মধ্যে সবথেকে ভালো। ধন্যবাদ আসিক, এমন একটা বিষয়ে লিখার জন্য। গত সপ্তাহে অধ্যাপক অর্জুন আপাদুরাই এসেছিলেন ইউসিএলএ'তে ভারতের সাম্প্রতিক দূর্নীতির মহা-মহা-স্ক্যান্ডালগুলোকে পাঠ করে তার নিজস্ব তত্ত্ব নিয়ে আলাপ করতে। যেখানে তিনি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন কেন দূর্নীতির জন্য আপামর জনতাকে দায়ী করা ভ্রান্ত এবং কিভাবে পলিসি-মেকিং এ উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক+আমলাতান্ত্রিক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদগুলো দূর্নীতির সূত্রপাত+ব্যাপকতার জন্য দায়ী। একই ধারায় আমি বলতে চাই, এই পোষ্টে ব্যক্তিকে যেভাবে দায়ী করা হয়েছে এবং ব্যক্তির নৈতিকতা বা শুভবুদ্ধির উদয়কে দূর্নীতি দমনের পথ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে, তা অসম্পূর্ণ, এবং কাজে কাজেই কোনরূপ সাফল্যের সম্ভাবনাবিহীন।
দূর্নীতি নিয়ে আমার ভাবনার কথা আপাততঃ থাক, তোমার কাছ থেকেই আরেকটু শুনি। তার আগের দুটো ঘটনা বলি, এর পর একটা প্রশ্ন-
১। বিএনপির বিগত আমলে আমার ভাবী সরকারী প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরী পান। পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ করার পরেও পঞ্চাশ হাজার টাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে ঘুষ দিতে হয়েছে। তা-ও আবার আব্বা আমাদের এমপির কাছের লোক ছিলেন বলে এমপির এপিএসের মাধ্যমে, তা না-হলে অন্যদের মতো এক লাখের উপরে দিতে হতো। কাজেই, সঙ্গত কারণেই আমার বাবা এমপির প্রতি প্রসন্ন, এমনকি পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়ার পরেও!
২। আমার আম্মাও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। অনেক বছর ধরে আমাদের বাড়ির পাশের স্কুলে ছিলেন। কোন কারণ ছাড়াই (পরে বুঝেছি ওটা স্বাভাবিক বদলি বানিজ্যের অংশ) তাকে আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় বিশ/বাইশ মাইল দূরের এক স্কুলে বদলি করে দেওয়া হলো। শুনেছি তার স্থলে একজনকে নিয়োগ দিয়েছিল ত্রিশ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে। অনেক দেন-দরবার করে এক বছর পরে আম্মার বদলির ব্যবস্থা করা হলো আমাদের বাড়ির পাশে আরেকটা স্কুলে, থানা শিক্ষা অফিসের সাথে পচিশ হাজার টাকা রফায়। ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়ার পরেও আম্মাকে দেখি সহকারী শিক্ষা অফিসারের প্রতি কৃতজ্ঞ!
- আমার আব্বা, আম্মা, এবং তাদের মতো উপায়হীন আম-জনতার দূর্নীতি-বিরোধী বোধের উদয় ঘটানো যায় কি করে, বলতো?
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
সম্পা'দি কোথায় :(( :grr:
আমার মন্তব্যে কয়েকটা টাইপো রয়ে গেছে।
জন্যঃ নেই
পড়ুনঃ নেই
জন্যঃ আসিক
পড়ুনঃ আসিফ
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
কি হলো বুঝলামনা। মন্তব্যটা গেলোনা আগের বারে।
বলছিলাম অসম্পূর্ণ তো বটেই, কিন্তু অধিকতর সংবেদনশীল মানুষেরা কিছুটা প্রতিরোধ তৈরী করে বলে তারা দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য হলেও সেটা মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারেনা। বিবেকবোধ এজন্যেই জরুরী; তবে একা ব্যক্তির মেরুদণ্ড মটমট করে ভেঙে যায় যখন দুর্নীতির দৌরাত্ম্যটা সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছে।
সমস্যা সমাধান নিয়া কথা।
উপায় নাই গোলাম হোসেন।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
@ শান্তা আপা,
আপনার চিন্তা আরেকটু ব্যখ্যা করতে হবে মনে হচ্ছে। আপনার বন্ধুর মাদ্রাসার জন্য ফান্ড-রেইজিং দেখে আপনার আহত বোধ করার সাথে আপনার নিজের অফিসে লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে উপযুক্ত সিস্টেমের প্রয়োজনীয়তার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখতে পাচ্ছি- প্রথমটায় মনে হলো আপনি ব্যক্তির ক্ষমতায় আসস্থাবান, আরে পরেরটা সিস্টেমের প্রতি। ব্যক্তি না সিস্টেম- আরেকটু খোলাসা করে বলবেন কি?
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
মাহমুদ - ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেক কিছু বলতে হয়। বাংলাদেশে একজন বিখ্যাত মহিলা চিকিসৎক ছিলেন। নাম ফিরোজা বেগম। মেয়েরা তখন অতো ডাক্তারী পড়তো না। ফিরোজা বেগমের বাবা গ্রামে মেয়েদের করুণ অবস্থা দেখে ঠিক করলেন মেয়েকে ডাক্তারী পড়াবেন। ফিরোজা বেগম ডাক্তার হয়ে পড়ে নিজের গ্রামে মেয়েদের স্কুল কলেজ তৈরি করে দিয়েছে। এখন তো মেয়েরা হাজার হাজার ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার এবং অনেক প্রফেশনে আসছে। কয়জন তাদের গ্রামের জন্য কিছু করছে? উল্টো মনে হচ্ছে তাদের চিন্তা-ভাবনার লেভেলটা অনেক রক্ষণশীল এবং স্থবির হয়ে যাচ্ছে। এতে তারা নিজেদের পরিবর্তন ঘটাতে পারছে না, সমাজের কথা বাদই দিলাম।
মাদ্রাসার কথা বললাম এই কারণে যে আমরা তো জানি যে মাদ্রাসা তেমন প্রডাক্টিভ ছাত্র তৈরি করতে পারে না। তারপরও শিক্ষিত মানুষদের যখন দেখি স্কুল, কলেজ বা একটা লাইব্রেরীর বদলে পরকালের কথা ভেবে মাদ্রাসা প্রতিষ্টাকেই উত্তম বলে মনে করে তখন খুব খারাপ লাগে।
“Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
― Mahatma Gandhi
সহমত আপা।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
উপায় নাই গোলাম হোসেন।
ভাইজান উপায় নাই। 😀
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
আসিফ ভাই ::salute:: আপনার এই চমৎকার লেখার জন্য... 🙂
:boss:
:hatsoff: ::salute::
"আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"
মাহমুদ ভাই@ আমি আসলে আমার একটি ধারনার কথা লিখেছি, তত্ত্ব হয়ে উঠতে আরো অনেক সময় বাকী। তবে আপনার সাথে আমি সম্পূর্ন একমত যে দূর্নীতি দমনে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উদ্যোগ অসম্পূর্ন। তবে খেয়াল করবেন আমি কিন্তু শেষের দিকে দুটি গল্প দিয়ে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক আচারের উদাহরন দিয়েছি। প্রথম ঘটনাটা থেকে বোঝা যাচ্ছে একটা সমাজের আপামর নৈতিকতাবোধ বা মূল্যবোধ এবং শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ন। তবে যেহেতু আমরা এখনই রাজনৈতিক মোকাবেলাটা করতে প্রস্তুত নই সেহেতু ব্যক্তিগত প্রস্তুতিটা সেরে নিতে পারি। কারন আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দৃড়তার উপরই নির্ভর করবে আমাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রস্তুতি যা আমাদের ধাবিত করবে প্রগতিশীল একটি সামাজিক উল্লম্ফনের জন্য।
নূপুর ভাই@ আমাদের অনেক সময়ই ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুর্নীতির সাথে আপোষ করতে হয়। সেটা আসলে একটা পর্যায় পর্যন্ত আমরা করতে বাধ্য, যতদিন সামগ্রিক কাঠামো পরিবর্তিত না হচ্ছে। এজন্যই আমি শুরুটা পারিবারিক কাঠামোতে করার আহ্বান জানিয়েছি, যাতে কিছুটা হলেও সফলতা আসে। আর এই যে আপনারা কেউ কেউ অকপটে নিজেদের বা পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির কথা স্বীকার করলেন, এটাই প্রক্রিয়ার কার্য্যকরীতার লক্ষন। আমরা যত খোলামেলাভাবে নিজেদের দূর্নীতি নিয়ে আলোচনা করব, আমাদের মাঝে ততই সেটা থেকে সরে আসার প্রবনতা তৈরী হবে। আর আপনার বিদেশ গমন নিয়ে বরাবরই একটা গ্লানি কাজ করে। 🙁 এটার প্রয়োজন নেই। আমরা আশা করি আপনি নিশ্চয়ই কোন না কোন অবদান নিয়ে আসবেন একদিন আমাদের সবার জন্য। :tuski: তবে প্রাথমিক ভাবে আপনি এদেশে একটা গবেষক দল বা সংস্থা গড়ে তোলার কাজে সাহায্য করতে বা উদ্যোগ নিতে পারেন। আমি আমার বন্ধুদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছি যাতে আমরা সবাই মিলে একটি গবেষনা কেন্দ্র বা গবেষনা সংস্থা গড়ে তুলতে পারি।
আফজা আপা@ অত্যন্ত ভাল লাগল যে আপনি ইতিমধ্যে মাঠেই ছিলেন। চালিয়ে যান, প্রথম প্রথম তারা মানবে না এটাই স্বাভাবিক,একদিন ঠিকই মানতে বাধ্য হবে। আর যারা তাদের আপনজনের দূর্নীতির পক্ষে সাফাই গায় তাদের ক্ষেত্রে একটা অস্ত্র প্রয়োগ করতে পারেন, যেটা আমি অত্যন্ত কার্য্যকরীতার সাথে আমার স্ত্রী'র ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছি। :shy: বিয়ের প্রথম প্রথম সে বলত- "এখন তুমি বিবাহিত, খানিকটা হলেও নিজেরটা বোঝা শুরু কর।" আমি বলতাম, "দেখো একজন স্বার্থপর মানুষ সর্বদাই স্বার্থপর। তুমি আজকে আমাকে স্বার্থপর হতে বলছ। কিন্তু আমি সেটা হলে তার প্রথম স্বীকার কিন্তু তুমিই হবে। তোমার পরিবার ,তুমি, তোমার পরিচিত জনদের সাথে আমি স্বার্থপরের মত আচরন করলে কী তোমার ভাল লাগবে, তুমি খুশী হবে?" আপনিও তাদের বলতে পারেন, "একজন মানুষ যখন অভাব ছাড়াও অসত হয়, একান্ত প্রয়োজন ছাড়াও নিয়মিত দূর্নীতির সাথে যুক্ত হয় তখন সেই মানুষটা আপনার সাথেও যে মিথ্যা বা ছলের আশ্রয় নিবে না আপনি কীভাবে নিশ্চিত হবেন?? একদিন কিন্তু তার অসততার স্বীকার আপনাকেও হতে হবে।" যাক, আপনাকে পরামর্শ দেয়ার জন্য মাফ করে দিয়েন।
চমৎকার লেখা।
কিন্তু আন্ধার কব্বরে বাত্তি নাইক্কা।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
খুব সুন্দর লেখা । এই চিন্তাধারা আজকে সবার ভিতরে পৌঁছে দিতে হবে । এই রকম লেখা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে হবে । সবাই ইন্টারনেট ব্যবহার করে না আর থাকলেও সবাই বিভিন্ন লেখা পড়ার কাজে সময় ব্যয় করে না । স্তরে স্তরে প্রতিটা মানুষকে এই ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে কথা গুলো সবার কাছে পৌঁছানর জন্য
শেষের দুইটা উদাহরণ ভাল লাগলো ।
পোস্ট দাতাকে আমার ::salute::
ধন্যবাদ আসিফ। :clap: