একজন একা মানুষের গল্প……

যে ছেলেটা দিনের পর দিন একলা একলা তালা বদ্ধ একটা ছোট ঘরে বড় হয়েছে , তার জীবন আর কতটা ভাল হতে পারে বলতে পারেন ? সেই ছেলেটা যাকে তার বাবা মার অস্তিত্ব অনুভব করতে হত ঘুম এর মধ্যেই। হয়তো সকালে অফিস এ যাওয়ার সময় আদর মাখা চুমুর স্পর্শে , কিংবা রাত্রে অফিস থেকে আগত ক্লান্ত হাতের কোমল ছোঁয়ায় , অথবা হয়তো ঘুম এর মধ্যেই আধা জাগ্রত ছেলেতা কে খাইয়ে দেওয়ার মধ্যে।

যে শত ইচ্ছার পরও বাবা মা কে রাত নয়টা দশটার আগে কখন ও কাছে পেত না । যার সময় কাটতো জানালার ফাক দিয়ে রাস্তায় খেলতে থাকা বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে , কিংবা পাশের বাসার অর মত দুই হতভাগা জমজ ভাইয়ের পাগলামি দেখে । তবু ওদের খেলার সাথী ছিল । কিন্তু ছেলেটার সাথী ছিল নির্জনতা আর আঁধার । যার ছিল না ঘরের বাইরে যাবার অধিকার কারণ মুখোশ পরা ছেলেধরা রা নাকি বাইরে বস্তা নিয়ে দাড়িয়ে আছে হয়তবা !

ছেলেটা কে মাঝে মাঝেই ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া যেত দরজার গোঁড়ায় । ঘুমিয়ে যেত বাবা মার অপেক্ষা করতে করতে ।

কখন তার বাবা মা আসবে , দরজার তালাটা খুলে তাকে কোলে নিবে । তাকে একটু আদর করবে, একটু স্নেহ করবে ।

সেই ছোট থেকেই ছেলেটাকে এভাবে ভালবাসাহীন হয়ে বড় হতে হয়েছে । তার ছিল না একটা ভাই কিংবা বোন যার সাথে সে সময় কাটাবে । কেন জানি ছোট থেকেই ছেলেটার একটা বোন এর খুব শখ । জানতো না সে , সবার সব ইচ্ছা পুরণ হয়না । জানতো না এভাবেই তাকে থাকতে হবে সারাটা জীবন ।

সেই ছেলেটা …… ছোটবেলা থেকেই যে একটু ভালবাসা খুজে ফিরেছে । অথচ এর জন্যে তাকে কত কাদতে হয়েছে বা এখন ও কাঁদতে হয় তা কি আপনি জানেন ?

যেখানেই কেউ একটু ভালবেসেছে , তার কাছে ছুটে গিয়েছে। কখন ও মরিচিকার দেখা পেয়েছে, কখন ও বা মিথ্যে কুহেলিকা । কখন ও বা ভালবাসার ডাক ই তার অব্দি পৌঁছায়নি। সময়ের সাথে সাথে অন্তর এন্টার্কটিকার মত জমে গেল । এর পর আর সে পিছে তাকায়নি ।

বাবা মা । এই দুইটি মানুষ ছাড়া তার কেউ ছিল না। যে টুকু নাম মাত্র ভালবাসার ছোঁয়া পেয়েছে তা এই দুজনার অনেক কস্টের ফল। হয়তো তাই ই এক ছোট্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে একা ছেলেটা কিছুটা উদ্ভ্রান্ত, কিছুটা ছন্নছাড়া, কিছুটা বোকা । না না, ভুল বললাম অনেক খানি ই বোকা ।

ছেলেটা আজ বড় হয়েছে , বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে । বাসা থেকে অনেক দূরে। এখন সে অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছে । অথচ বুঝেনা কি করে তার অতি হিসাবি মা প্রতিদিন তার সাথে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে টাকা নষ্ট করে। তার ব্যস্ত বাবা তাকে এক নজর দেখার সব সময় জন্যে উতলা হয়ে থাকেন । ছোটবেলাতে যাকে একটা চকলেট এর টাকার জন্যে কাঁদতে হয়েছে, আজ তাকে টাকা প্রয়োজন না হলেও পাঠাতে দ্বিধা বোধ করছেন না।

এই ভালবাসাটা সে ছোটবেলায় অনেক চেয়েছে, অনেক কান্নাকাটি করেছে । কিন্তু হয়তো বাবা মা ইচ্ছাসত্ত্বেও দিতে পারেননি । চাচা চাচি রা হয়তো দেওয়ার প্রয়োজন বধ করেননি , ফুপুরা ছোট বাচ্চাকে হয়তো গ্রহণ করতে পারেননি । দাদির সময় হয়তো তার মেয়ের বাচ্চগুলোকে দেখতে চলে গেছে, ছোট্ট ছেলেটা কে কোনদিন কোলে নাওয়ার ও তার টাইম হয়নি । সে তখন এগুলোকেই নরমাল ধরে নিত ।

আসলেই ছোটবেলাটা অনেক সুখের । কারণ টা জানেন? কারণ সে তখন অবুঝ থাকে ……

ছেলেটা এখন ও একা একা পরে থাকে সব সময় । সে সুখি না থাকুক কিন্তু যাতে কেউ কখন ও তাকে দুঃখ না দিতে পারে । ওকে দেখলে কেউ বুঝবেও না ওর মাঝে কত দুঃখ লুকিয়ে । কেউ বুঝবে না ওর ঐ বোকা বোকা হাসিটার পিছনে কত কান্না জমা আছে । হঠাৎ কিছুদিন ওকে খুশি দেখছিলাম । কেন জানি খুব ভাল লাগছিল । কারণটা জিজ্ঞাসা করে ওর সুখটা কে ছোট করতে ছাইলাম না । থাকুক না

সেদিন দেখলাম ছেলেটা ছাদ এ চিত হয়ে শুয়ে জোৎসনা দেখছে । জিজ্ঞাসা করতেই বলে সামনের মাসে ওর “বেস্টেস্ট ফ্রেন্ডে”র বিয়ে । শুয়ে শুয়ে নাকি তাই নিজের জীবনের সুখ এর স্মৃতি গুলো মনে করছে …

তাকাতেই বুঝলাম কাঁদছিল ।

মনটা খারাপ হয়ে গেল । কাছে যেয়ে বললাম, “মেয়েটা তোকে অনেক ভালবাসত রে।”

কান্না ভেজা চোখে আমার দিকে যে দৃষ্টি দিল, পুরা বুকটা জুরে হাহাকার করে উঠল । সেই দৃষ্টি একজন সর্বস্‌সো-হারা মানুষের। সান্তনা দিয়ে কষ্টটা বাড়াতে চাইলাম না ।

তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে , সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

” এই আমি টা জীবনে সব কিছুই পেতে পেতে হারিয়েছি রে । কখন ও কিছু ধরে রাখতে পারিনি । সব এই ভালবাসার কাঙ্গাল টাকে ছেড়ে চলে যায় রে । সবার ভালবাসার অনেক দাম ।”

চোখের পানি আর আটকাতে পারলাম না । অবুঝ, বদরাগী , একটু খামখেয়ালি বন্ধুটাকে জরিয়ে ধরলাম শক্ত করে ।।

৮২২ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “একজন একা মানুষের গল্প……”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।