একটা ইয়াতো বড় কাহিনী……

আমি তখন ক্যাডেট কলেজে মাত্র আসছি ক্লাস সেভেনে, একদম প্রথম সপ্তাহর কথা। লাঞ্চের একটু পরে পরে কমন রুমের দিকে যাচ্ছিলাম। কে জানি ধোপার কাপড় নিয়ে আসতে বলছিল……। হাউজলীডারের রুমটা ক্রস করে কমনরুমে ঢোকার আগেই তৎকালীন ২৮তম ব্যাচের ডাইনিং হল প্রিফেক্ট আমাদের হাউজের জুলফিকার ভাইয়ের একদম মুখোমুখি পরে গেলাম! উনার সাথে আগে কখনো কথা হয় নাই, সাথে সাথে পাকড়াও করলেন আমাকে……

নাম কী?
— কাইন্ডলি আশিকুল।
তোমার নাম ‘কাইন্ডলি আশিকুল’? (উনি এবং উনার দুই পাশের আরো দুই ক্লাসটুয়েল্ভের হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ……)
— কাইন্ডলি জ্বী না, শুধু আশিকুল…… (আমার ক্যাডেট নাম তখন আশিকুল……)
আমাকে চিন?
–কাইন্ডলি জ্বী।
আমি কে?
–কাইন্ডলি ডাইনিং হল প্রিফেক্ট জুলফিকার ভাই কাইন্ডলি……
আমাকে দেখলে ভয় লাগে?

তাকাইলাম জুলফিকার ভাইয়ের দিকে। প্রায় ৬ফুট লম্বা দানবের মতন বিশাল! আর আমি তখন চারফুট আট দশ কিছু একটা হব……ঘাড় আকাশমুখী করে কথা বলতে হয়……ভয় না পাওয়ার কোন কারণ নাই……তার উপরে আবার ক্লাস টুয়েল্ভ বলে কথা……

–জ্বী লাগে।
(জুলফিকার ভাইকে কিছুটা সন্তুষ্ট মনে হল)
চাচা চৌধুরীর সাবুকে চিন?
–জ্বী চিনি…
আমাকে দেখলে সাবুর মতন মনে হয়?
–জ্বী মনে হয়।
(এই বেলা উনি আরো সন্তুষ্ট……)

আশিকুল, তোমার ইয়া কত বড়?
(বলা মাত্রই তিনি এবং তার পাশের বাকি দুই টুয়েলভ আবারো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি……)

বেদম ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। প্রশ্নটাই বুঝি নাই! আমাকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়ে থাকতে দেখে জুলফিকার ভাই বললেন, ‘দুই হাত মাথার উপরে তুল……’। তুললাম। ‘দুই হাতের মধ্যে ফাঁকা কর’। করলাম…। ‘এইবার বল, আমার ইয়া এত বড়’।

কিছুই বুঝতেছিলাম না……। দুই হাত মাথার উপরে তুলে ধরে আছি, বাম হাতের পাঁচ আংগুল ডান হাতের পাঁচ আঙ্গুলের দিকে মুখ করা……কিছু একটা যে বড় সেইটা খালি বুঝা যাইতেছে……

দুইহাত তুলে রেখেই বললাম, ‘ কাইন্ডলি ইয়াতো বড়’
আবার তারা হেসে উল্টায় পালটায় পড়ে টাইপ অবস্থা……বলে, ‘হয় নাই, টেনে টেনে বল, ইয়ায়্যায়্যয়্যাতো বড়’। বললাম। এইবার তাদেরকে সন্তুষ্ট মনে হল। আমাকে জানাইলেন যে এর পরে আবার জিজ্ঞেস করলে যেন এইভাবে উত্তর দেই।

ঘটনাটা ঘটল এক বা দুই দিন পর। আমি তখন ডাইনিং হলে জুনিয়র হাই টেবিলের পাশের ক্লাস টুয়েল্ভের টেবিলে বসি। লাঞ্চ টাইমের মাঝা মাঝি টাইমে আমার টেবিলের টেবিল লীডার আমাকে বললেন, ‘আশিকুল, হাই টেবিল থেকে ডালের বাটি নিয়ে আস।’ আমিও সুবোধ বালকের মতন জুলফিকার ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম, ‘কাইন্ডলি ডালের বাটিটা নিতে পারি?’ আমাকে দেখেই জুলফিকার ভাইয়ের চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠল। উনি উনার পাশের প্রিফেক্টের দিকে তাকায়ে বললেন, ‘একটা মজা দেখ, একটা মজা দেখ’। আমার দিকে তাকায়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আশিকুল, তোমার ইয়া কত বড়?’ আমি পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী মাথার উপর দুইহাত তুলে জানাইলাম, ‘ইয়ায়্যায়্যয়্যাতো বড়’। পুরা জুনিয়র হাই টেবিলের এই মাথা থেকে ঐ মাথা পর্যন্ত হাসির রোল উঠে গেল।

ভাগ্যের চক্রে, সেইদিনই কলেজের তখনকার ক্যাডেটদের হার্টথ্রব সুন্দরী গোলগাল ম্যাডাম ডিউটি মাস্টার। উনি ঐপাশের অনেক দূরে সিনিয়র হাইটেবিলে খাচ্ছেন। জুলফিকার ভাই আমাকে নির্দেশ দিলেন সিনিয়র হাইটেবিলের দিকে ফিরে ডিউটি মাস্টারের দিকে তাকায়ে ইয়া কত বড় ঘোষণা দিতে। দিলাম। এইবার শুধু জুনিয়র হাইটেবিল না, তিন হাউজের তিনটা ক্লাস টুয়েল্ভের টেবিল থেকে হাসির শব্দ পাওয়া গেল। এইবেলা জুলফিকার ভাই আমাকে বললেন, যাও, ম্যাডামকে গিয়ে বলে আস………

আমি তখন নিতান্তই ক্লাস সেভেনের বাচ্চা। মাত্র মায়ের কোল থেকে নেমে ক্যাডেট কলেজে চলে আসছি টাইপ অবস্থা। ‘ইয়া’র অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আমার কাছে পুরাটাই ধোয়াশা। কোন একটা মজা করা হচ্ছিল সেইটা পরিষ্কার, কিন্তু ক্লাস সেভেন মানেই তো টুয়েল্ভের কাছে হাসি তামাশা করার খেলনা টাইপ ব্যাপার। কাজেই স্থান কাল পাত্র উদ্দেশ্য কিছুই ভালমতন না বুঝে আমি সরল মনে সিনিয়র হাই টেবিলের দিকে হাঁটা দিলাম……

চারদিক থেকে চেচামেচি করে আমাকে থামানো হল……

-আরে আরে কই যায়!!!
-ঐ! এদিকে আস!
-কাম ব্যাক! কাম ব্যাক!
এর সাথে সাথে কারো হাসি এতটুকু থামে নাই……

উদ্ধার পাইলাম আমার টেবিলের ক্লাসটুয়েল্ভের ভাইয়া হাসতে হাসতেই ‘অই তোরা বাচ্চা পোলাটারে খাইতে টাইতে দে! ‘ বলে ডাক দিয়ে আমাকে আমার জায়গায় বসায় দিলেন……

সহজ সরল প্যাচগোচ বিহীন সেই আমার ওই ‘ইয়া’র মর্মার্থ বুঝতে বহুদিন সময় লেগে যায়।

অনেক অনেক পরে আমরা যখন ক্লাস টুয়েল্ভে, তখন MECA এর কোন এক পিকনিকে এক্সক্যাডেটরা কলেজে আসে। কলেজ থেকে বের হবার পরে সেই প্রথম জুলফিকার ভাইয়ের সাথে আবার দেখা দেখা হয়। উনি আমাকে চিনেন নাই। এমনিতে চেনার মতন তেমন কোন কারণও নাই। আমি তখন ক্লাস টুয়েল্ভে। প্রেস্টিজ বোধ অনেকটাই চাঙ্গা। প্রায় ৬ বছর আগের সেই ইয়াতো বড় কাহিনীটা জুলফিকার ভাইকে মনে করায় দেবার চেষ্টা করার ধারে কাছ দিয়েও যাই নাই।

৩,৫৫৩ বার দেখা হয়েছে

৫২ টি মন্তব্য : “একটা ইয়াতো বড় কাহিনী……”

  1. তৌফিক

    ক্লাস নাইনে থাকতে মেকু ভাইরা কলেজে আসছিল। জুলফিকার ভাইও আসছিলেন। বাস্কেটবল খেলার সময় একটা আমার সাথে সংঘর্ষ সামলাইতে গিয়া মাটিতে পইড়া গেছিলেন উনি। তৎকালীন সাড়ে পাঁচ ফুটি আমার জন্য এইটা বিরাট সাফল্য। আমি আমার বাস্কেটবল ক্যারিয়ারে এইটারেই সবচেয়ে বড় সাফল্য বইলা মানি।

    ইয়াতো বড় অশ্লীল কাহিনী লেখার জন্য ব্লগ এডু বরাবর আশিকের নামে আরো পাঁচখানা ব্লগ ইস্যু করার জোর দাবী জানানো হইল।

    জবাব দিন
  2. যাও, ম্যাডামকে গিয়ে বলে আস………

    :khekz: :khekz: :khekz:

    আশিক ভাই আপনি যখন ডাইনিং হল প্রিফেক্ট ছিলেন, আপনেরে নিয়াও আমার একটা ঘটনা আছে। মনে করানোর চেষ্টার ধারে কাছ দিয়াও যামু না।

    জবাব দিন
  3. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    হাহাহাহাহাহাহাহা বহুত মিজা পাইলাম =)) =)) =)) =)) =))


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  4. ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    আশিকুল, হাই টেবিল থেকে ডালের বাটি নিয়ে আস।’

    তোমরা খাওয়ার সময় উঠতে পারতা নাকি? আমাদের তো উঠা নিষেধ ছিল, শুধু প্রিফেক্ট আর মাঝে মাঝে দরকার পড়লে টেবিল লিডার উঠত। আর ক্লাস টুয়েল্ভ সব কি একটেবিলে বসত নাকি? তাহলে অন্য টেবিলে টেবিল হেড কে হত?

    কিছু মনে করনা, আমাদের সময়ের অনেক নিয়মের সাথে মিলছে না তো তাই জানতে চাইছি।

    লেখাটা খুব ভাল হয়েছে।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
    • আশিক (১৯৯৬-২০০২)

      ভাইয়া, ক্লাস টুয়েল্ভ ক্লাস ইলেভেন এরা ক্লাস সেভেন কে উঠায়ে এইদিক সেইদিক পাঠাইত......
      ক্লাস টুয়েল্ভ সাধারণত জুনিয়র হাইটেবিলের দিকে তিনজন করে একটেবিলে বসত আরো অন্য ক্যাডেট সহ, এই টেবিল গুলি আমরা ক্লাস টুয়েল্ভের টেবিল বলতাম......
      আপনি তো রংপুর, আমরা মির্জাপুর...মিলাইবেন ক্যামনে! 😀

      জবাব দিন
    • আহ্সান (৮৮-৯৪)

      ডাইনিং হলে আমরাও কখনো টেবিল ছেড়ে ওঠার কথা চিন্তাও করতে পারতাম না। এমনকি ক্লাশ টুয়েলভ ও না। আমাদেরও প্রতিটি টেবিলে টেবিল লীডার হত ক্লাশ টুয়েল্ভ। সব ক্লাশ টুয়েল্ভ বসার পরে যে সমস্ত টেবিলে চেয়ার ফাকা থাকতো, সেগুলিতে ক্লাশ ইলেভেন। আর যখন তখন টেবিল চেঞ্জ করা ও সম্ভব ছিলনা।

      জবাব দিন
  5. জাবীর রিজভী (৯৯-০৫)
    আমার ইয়া এত বড়

    কাইন্ডলি,আশিক ভাই,কত বড়? :dreamy:

    হার্টথ্রব সুন্দরী গোলগাল ম্যাডাম ডিউটি মাস্টার

    ফল ইন এ এনারে দেখতে গিয়া অ্যায়সা পাঙ্গা খাইছি :frontroll: 🙁 😛

    কঠিন,আশিক ভাই।আপনার উদ্দ্যেশ্য আমার একখানা অনাগত পোস্ট উৎসর্গ করিব বলিয়া মনস্থির করেছি 😀

    জবাব দিন
  6. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)
    ইয়াতো বড়

    :khekz: :khekz: :khekz: :khekz: :awesome: :awesome: :awesome: :awesome:

    বিএমএ'তে সিনিয়রমোস্ট টার্মের পোলাপাইন একইভাবে জুনিয়রমোস্ট পোলাপাইন নিয়া মজাক করত।
    বিশেষ বিশেষ ভঙ্গিমায় আইসক্রিম খাওয়ানো হতো 😉 😉 , বিশেষ বিশেষ অস্ত্র দিয়ে "বেয়োনেট ফাইটিং" করানো হতো 😉 😉 😉 😉 ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  7. তানভীর (৯৪-০০)

    আশিক, এই প্রম তোমার লেখায় কমেন্ট দিতেসি।

    তোমার লোয় সাবলীলতা আছে, পড়ে মজা পাওয়া যায়। :clap: :clap:

    (অফটপিকঃ আমাদের ছাইড়া কোন দূর দেশে গেলা রে ভাই! এখানে আমাদের জান খারাপ হয়ে যাচ্ছে 🙁 )

    জবাব দিন
  8. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    হুমমমম...
    আসলেই অনেকদিন পরে লিখছ আশিক।
    লেখা ভালো হইছে। এক্কেবারে ভোলাভালা ক্লাশ সেভেনের মাসুম বাচ্চার চিত্রটা খুবই সুন্দরভাবে ফুটে উঠছে।
    তৌফিকের মত আমিও বলবো, ব্রেক নিওনা আর।

    জবাব দিন
  9. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    সবই বুঝলাম,ভালো লেখা।
    শুধু আমার প্রিয় ফর্মমাস্টারনিকে নিয়া কমেন্টানোটা ভালো লাগলো না।
    আমার বড়ই প্রিয় ম্যাডাম।
    সেভেনে অঙ্ক কইরা দুবার তার কাছে মিমি জিতেছি।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।