পুরো কলেজে থমথমে অবস্থা। পিটির ফলইন, পিটি হচ্ছে না। এমনটা না যে বৃষ্টি পড়ছে, অথবা ওয়াকিং দেওয়া হয়েছে। জাস্ট পিটি হচ্ছে না। কলেজের ৩০০ জন ক্যাডেট পিটির ফলইনে এই ভোর ৫ টায় আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে জবুথবু ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কারন, ক্লাস সেভেনের একটা ক্যাডেটকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এই শীতেও স্টাফদের শরীর ঘামে ভিজে গেছে। সিএসএম স্টাফ এডজুটেন্ড স্যারের সামনে তোতলাচ্ছেন। বাকি স্টাফরা নজরুল হাউসের ফলইনের সামনে দাঁড়িয়ে। ২ জন স্টাফ কথা বলছেন হাউস লীডারের সাথে। হাউস লীডার ছেলেটা খুবই চটপটে, গতকাল রাতেও হাউস রাউন্ড দেওয়ার সময় মিসিং ক্যাডেটটাকে দেখেছে। এই রাতের মধ্যে কি হয়েছে কেউ জানে না। হাউস লীডারের কথা শুনে স্টাফদের বুকটা আরো শুকিয়ে যায়। এক আদি, অকৃত্তিম ভয় জেগে ওঠে তাদের মনে। এডজুটেন্ড স্যারের সামনে কি বলবেন সেই ভয় না, এই ভয় ছেলেটার কথা ভেবে।
ছেলেটার নাম সাকিব। খুব ভদ্র ছেলে। কখনও কোন ফলইনে লেইট করে না, কলেজের সব রুল প্রোপারলি মেনে চলে, সিনিয়রদের সাথে রিলেশনও বেশ ভাল। এরকম কেউ কলেজ পালাবে এটা ভেবে নেওয়া ঠিক হবে না। ক্লাস সেভেনের বলে তো আরো নয়। এডজুটেন্ড কলেজের সব স্টাফকে ডেকে পাঠালেন পিটি গ্রাউন্ডে। সব স্টাফ মানে সব স্টাফঃ ডাইনিং হলের বেয়ারা, একাডেমিক ব্লকের বেয়ারা, হাউস বেয়ারা, গ্রান্ডসম্যান, নাইটগার্ড সবাই। সবাইকে সার্চ মিশনে পাঠিয়ে দিলেন এরপর। ক্যাডেটদের অস্থিরতা বাড়তে থাকল, ফিসফিস আওয়াজ কলেজ প্রিফেক্ট এর কানে আসে। “Dont Talk! ” শান্তশিষ্ট কলেজ প্রিফেক্ট এর গলায় কিছু একটা ছিল, সব ক্যাডেটের মুখ সেলাই হয়ে যায়।
ভয়, ভীষণ ভয় পেয়েছে কলেজ প্রিফেক্ট। কালকে রাতে সে নিজেও কলেজের বাইরে ছিল। সকাল বেলায় ক্লাস “সেভেনের” কাউকে নিয়ে সেই একই সমস্যায় পড়তে হবে ভুলেও চিন্তা করেনি সে। হার্টবিট যেভাবে বেড়ে গিয়েছে এডজুটেন্ড স্যার না শুনলেই হয়।
পুরো কলেজের সবচাইতে মলিন মুখটা অবশ্য এডজুটেন্ড এরই। এই ছেলের অভিভাবককে কি বলবেন আজকে ভেবে পাচ্ছেন না। ফলইন ব্রেক করে দিলেন তিনি। ক্যাডেটদের হাউসে পাঠিয়ে দিলেন। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছে স্টাফ পাঠালেন একটা। স্যার কলেজের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে শিডিউলে কোন চেঞ্জ না আনতে বললেন, বাকি ক্যাডেটদের মধ্যে যেন কোন ভীতি ছড়িয়ে না পড়ে। ব্রেকফাস্ট এর পর সবাইকে একাডেমিক ব্লকে ক্লাস করতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। পুরো ক্লাস টাইমেও সাকিবের কোন খোজ নেই। এডজুটেন্ড এর কপালের ভাঁজ বেড়ে গেল। স্টাফ লাউঞ্জে টিচারদের সামনে পুরো জিনিসটা এক্সপ্লেইন করতে গিয়ে ব্যাপারটার গ্র্যাভিটি আরো ভালভাবে ফিল করলেন। সেভেনের একটা বাচ্চা তার আন্ডারে হারিয়ে গেলে এর পরিণতি কি হবে সেটা চিন্তা করতেও পারছিলেন না। দুপুর হতেই ক্যাডেটদের লাঞ্চে পাঠিয়ে নিজেও ডাইনিং হলে ঢুকে পড়লেন। ছেলেদের পাশে থাকা উচিত এইসময়। তিনি নিজেও এক্স-ক্যাডেট, ভালমতই বুঝতে পারছেন কতটা ভয় পেয়েছে তার ক্যাডেটরা। লাঞ্চ যখন প্রায় শেষের পথে, তখনই ডাইনিং হলে ঢুকল সাকিব।
প্রায় দৌড় দিয়েই ছেলেটার কাছে গেলেন। হাইটেবিল থেকে পড়িমড়ি করে ছুটে আসলেন ডিউটি মাস্টার। তাকে ফলো করলেন সব প্রিফেক্টরা। পুরো ডাইনিং হল দাঁড়িয়ে পড়ল কি ঘটছে দেখার জন্য। এডজুটেন্ড বাইরে নিয়ে গেলেন সাকিবকে। ছেলেটাকে কোন প্রেশার না দিয়ে কোথায় ছিল এতক্ষন, কি করছিল এসব জানার চেষ্টা করলেন। সাকিব কোন প্রশ্নের জবাব দিল না। ছেলেটার মুখে কিছু একটা ছিল, যেটা দেখে আর চাপ দিলেন না তিনি। হসপিটাল এ পাঠিয়ে দিলেন। মেডিক্যাল অফিসারকে পাঠালেন খানিকপরে সাকিবের কাছে। মেডিকেল অফিসার নিজেও একজন এক্স-ক্যাডেট, ছেলেটার একটু ফ্রি হওয়ার কথা। কোন লাভ হল না। সাকিব চুপ করে বসে থাকল। এই ১২ ঘন্টায় ভয়াবহ কিছু একটা ঘটেছেই যার জন্য প্রচণ্ড শকে চলে গেছে ছেলেটা। চেষ্টার কমতি রাখলেন না এডজুটেন্ড. পরের দিন সিএমএইচ থেকে সাইকোলজিস্ট ডেকে পাঠালেন। ২ ঘন্টার সিটিংয়েও সাকিব মুখ থেকে একটা শব্দও উচ্চারন করল না।
এই আমাদের গল্পের নায়ক, সাকিব। তবে তার গল্পটা এখুনি শুরু না। সেভেনে এত কিছু করে ফেলার পরও ছয় বছর পর এই ছেলেটাই তাদের ব্যাচের কলেজ প্রিফেক্ট হয়। গল্পের শুরু সেখানেই। তবে ছয় বছরে কোনদিন কাউকে সে ঐ ১২ ঘন্টা নিয়ে কিচ্ছু বলেনি।
কারন সে জানে কোনদিন কেউ তাকে বিশ্বাস করবে না।
ঘটনা সত্যি নাকি? B-) B-)
রক্তিম প্রসাদ প্রাচীরে বন্দি সবুজ মায়া
এরি মাঝে খুজে ফিরি নিজের অচেনা ছায়া..