মিরোস্লাভ ক্লোসাঃ একজন অন্তরালের নায়ক

এবারের বিশ্বকাপের শুরু আগে থেকে কোন দল চ্যাম্পিয়ন, রানারআপ হবে, কারা চমক দেখাবে কারা ফ্লপ করবে ইত্যাদি হিসাব নিকাশের সাথে সাথে আরেকটা হিসাব সবার মুখে মুখে ঘুরছিলো। মিরোস্লাভ ক্লোসা কি পারবে সর্বকালের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার(আমার দেখা সেরা) রোনালদোর বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ভাঙ্গতে? জার্মানীর জার্সি গায়ে ক্লোসার ইতিপূর্বের নৈপুন্যের কারনে বেশিরভাগের মতই ছিল ক্লোসার পক্ষে কিন্তু তাদের বেশিরভাগই চাচ্ছিলো রেকর্ডটা যাতে রোনালদোরই থেকে যায়, তাদের মতে এরকম একটা রেকর্ড তো রোনালদোর মত ফেনোমেননকেই মানায়!রোনালদো নিজেও তার এই রেকর্ড নিয়ে চিন্তিত ছিল, গত সপ্তাহে ব্রাজিলে সে ফ্যানদের আহবান জানায় ক্লোসা যাতে একটা গোলও করতে না পারে সেই কামনা করতে। (“I have one big favour to ask of you,” he said. “Please cast a tiny spell on Miroslav Klose. That would be good, so that Klose scores no goals.”)

রোনালদোর সাথে আসলেই ক্লোসার তুলনা হয় না, রোনালদো সবসময়ই ইতিহাসের অন্যতম সেরা হিসেবে বিবেচিত হবে, তার বিপক্ষে খেলা খুব কম ডিফেন্ডারই আছে যারা খেলার আগে রোনালদোকে আটকানোর কথা চিন্তা করে ঘুম নষ্ট করেনি। ক্লোসা সেদিক থেকে অনেক সাধারন পর্যায়ের খেলোয়াড়। ভবিষ্যতে নিতান্ত কিছু কুইজ প্রতিযোগিতার প্রশ্ন ছাড়া তার নাম আলোচনায় আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। মাঠে সবসময় অন্যদের ছায়ায় থেকে যাওয়া এই স্ট্রাইকার ইতিহাসেও ছায়ায় থেকে যাবে, কিন্তু তারপরো সে এখন ফুটবলের অন্যতম মযার্দাপূর্ণ রেকর্ডের যৌথ অধিকারী।

ব্যক্তিগতভাবে ক্লোসের অবশ্যই বিশ্বকাপের শুরু থেকে এই রেকর্ড নিয়ে চিন্তা ছিল কিন্তু জার্মানী দল বিশেষ করে কোচ লো এর এ নিয়ে চিন্তা ছিল কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা যায় পর্তুগালের সাথে প্রথম খেলার পরে। পর্তুগালের বিরুদ্ধে খেলা শেষ হবার বেশ আগেই জয় নিশ্চিত যাবার পরেও ক্লোসার মাঠে নামা হয়নি। শেষ পর্যন্ত মাঠে নামার সুযোগ পেলেন ঘানার বিপক্ষে দ্বিতীয় খেলায় ৬৯ মিনিটে, জার্মানী তখন ১-২ গোলে পিছিয়ে। আর সুযোগ কাজে লাগাতে ক্লোসা সময় নিলেন মাত্র দুই মিনিট। এই বিশ্বকাপে প্রথমবার বল স্পর্ষ করেই রোনালদোর রেকর্ড স্পর্ষ করলেন ক্লোসা।

তেমন আহামরো গোল না, গোলের একদম সামনে থেকে প্রায় ফাঁকা বারে আলতো একটা টোকা। একেবারে ট্রেডমার্ক ক্লোসা গোল, কোন ঝলক নেই, আহামরী কোন স্কিল নেই কিন্তু তার সঠিক সময়ে সঠিক জায়গার থাকার প্রমাণ আছে এবং সবচেয়ে বড় কথা জার্মানীর পরাজয় এড়ানোয় গুরত্ব আছে। ৭০ গোল করে ক্লোসা এখন জার্মানীর সর্বোচ্চ গোলদাতা আর সে গোল করেছে এমন ম্যাচে জার্মানী কখনো হারেনি।

klose1

ক্লোসা এখন পেলে এবং উই সেলার এর পরে তৃতীয় খেলোয়ার যে চারটি বিশ্বকাপে গোল করেছে। ঘানার সাথে গোল করে ১৫ গোলের রেকর্ড ছোঁয়া একটু কাকতালীয়ও বটে, রোনাল্ডোও তার ১৫তম গোল করেছিলেন ২০০৬ বিশ্বকাপে এই ঘানার বিরুদ্ধে। রোনালদো তার ১৫ গোল করেছিল ১৯ ম্যাচ খেলে আর ক্লোসা করলেন ২০ ম্যাচে, তবে মাঠে রোনালদো বেশি খেলেছেন, ক্লোসার সুযোগ কাজে লাগানোর হারও বেশি।

klose

মিরোস্লাভ ক্লোসার জন্ম ১৯৭৮ এ পোল্যান্ডে। ৮ বছর বয়সে তার পরিবারের সাথে পোল্যান্ডের কমুনিস্ট শাষন থেকে পালিয়ে জার্মানীতে আসার সময় সে মাত্র দুটো জার্মান শব্দ জানতো, ‘হ্যাঁ’ এবং ‘ধন্যবাদ’। শরনার্থী ক্যাম্পে জার্মান জীবন শুরু করা ক্লোসাকে ফুটবল সুযোগ করে দিয়েছে মূল জার্মানদের সাথে মিশে যেতে, তাকে আলাদা পরিচয় দিতে। ক্লোসা সবসময়ই পরিচিত ছিলেন একজন ভদ্র, নম্র পুরোপুরি পেশাদারী একজন খেলোয়াড় এবং মানুষ হিসেবে। মাঠের ভিতরে বা বাইরে কখনোই কোন ধরনের বিতর্ক সে জন্ম দেয়নি বরং মাঠে তার ফেয়ার প্লে সবসময়ই তাকে প্রসংশিত করেছে। যার সবচেয়ে বড় উধাহরন হলো ওয়ার্ডার ব্রেমনের হয়ে খেলার সময় রেফারি তার পক্ষে পেনাল্টি দিলে সে রেফরিকে বলে সেটা পেনাল্টি ছিল না। ২০১২ সালে ল্যাজিওর হয়ে খেলার সময় তার হাতে লেগে গোল হবার পর সে রেফারিকে জানায় গোল বাতিল করে হ্যান্ডবল দেবার জন্য।

এই বিশ্বকাপে আরো এক গোল করে ক্লোসা রেকর্ডটি সম্পূর্ণ নিজের করে নিতে পারুক বা না পারুক ইতিহাসের সেরাদের তালিকায় সে কখনোই গন্য হবে না এটা যেমন সত্য তেমনি ভাবে এটাও সত্য যে কিছু মানুষ একজন ভদ্র, পরিচ্ছন্ন ভাবে ফুটবল খেলে যাওয়া এবং দেশকে সবসময় সর্বোচ্চ সার্ভিস দিয়ে যাওয়া ফুটবলার হিসেবে তাকে সমসময় মনে রাখবে।

অভিনন্দন এবং শুভকামনা মিরোস্লাভ ক্লোসা।

(লেখাটির সকল তথ্য, উপাত্ত এবং অধিকাংশ বক্তব্য বিবিসিরএই লেখা থেকে নেয়া)

৩,১২৫ বার দেখা হয়েছে

২২ টি মন্তব্য : “মিরোস্লাভ ক্লোসাঃ একজন অন্তরালের নায়ক”

    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      রোনালদো আমার দেখা সেরা স্ট্রাইকার আর ফেবারিটও, কিন্তু মন থেকে চাচ্ছিলাম ক্লোসা যাতে রেকর্ডটা করে। লো এর উপর ক্ষেপছিলাম প্রথম ম্যাচে না নামানোর জন্য, দ্বিতীয় ম্যাচে সুযোগ পেয়েই কাজে লাগালো, আশা করি কমপক্ষে আরেকটা গোল করবে।


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন
  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    বর্তমান ব্রজিল দলে যে অবস্থা ক্লোসা'র মত একজন স্ট্রাইকার থাকলেও ওরা বর্তে যেত... 🙁
    স্ট্রাইকারের কাজ গোল দেয়া, সেটা আকর্ষনীয় বা দৃষ্টিনন্দন হল কিনা-সেটা পরের ব্যাপার! এদিক দিয়ে ক্লোসা সফল! বিশ্বকাপের অনেক দেশেরই, বিশেষ করে আফ্রিকান দেশগুলোতে এরকম ক্লিন একজন স্ট্রাইকার থাকলে তারা অনেক দূর যেতে পারত।

    শেষ কথা হল রোনাল্ডোর জায়গা ক্লোসা নিতে পারবে না এটা যেমন সত্য, ওর অর্জন (অন এন্ড অফ দ্যা ফিল্ড) তাতে ম্ল্যান হবে না- এটাও সত্য!


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    রেকর্ড সে নাথিং।

    আমাদের সময়ে দেখা সেরা স্ট্রাইকার নিঃসন্দেহে রোনাল্ডো।
    সামনের দুই দাঁত বের করে থাকা মিকি মাউস টাইপ, কিঞ্চিৎ অলস খেলোয়াড়টি ডি বক্সের মধ্যে কতোটা ভয়ঙ্কর তা না দেখলে বোঝানোর উপায় নেই।

    মিরোস্লাভ ক্লোসে আরো ৫-৬ টা গোল দিক। রেকর্ডে নাম উঠুক।
    রোনাল্ডো সেরা স্ট্রাইকার ই থাকবেন।

    রোনাল্ডো ভক্তদের এমনকি রোনাল্ডোর নিজের এরকম আচরণ হাস্যকর।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      রোনালদো রোনালদোর জায়গাতেই থাকবে ভাই, আর এই রেকর্ড হাতছাড়া হয়ে গেলেও তার গ্রেটনেসের এক ছটাকও কমতি হবে না।

      আমার মূল বক্তব্য আসলে ছিল ক্লোসা তার উপযুক্ত রিকগনিশন পায় না, আমাদের মত দূরের সাপোর্টারদের কাছ থেকে তো নয়ই খোদ জার্মানীতেও না। ক্লাবের হয়ে তেমন জ্বলে না উঠতে পারা একটা বড় কারন আরেকটা কারন হলো ওর মাঝে কোন আলগা ফ্লেয়ার না থাকা। উপরে জুনাদা যেমন বলছে, স্ট্রাইকারের কাজ গোল দেয়া, সেটা আকর্ষনীয় বা দৃষ্টিনন্দন হল কিনা-সেটা পরের ব্যাপার! আর এই কাজটাই সে জার্মানীর মত সফল একটা দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশিবার করেছে। আর ওর মত স্ট্রাইকারকে আমরা সাধারনত তেমন পাত্তা দিতে চাই না, সুযোগ সন্ধানী হিসেবে উড়িয়ে দেই। কিন্তু আমার কাছে একজন স্ট্রাইকারের সবচেয়ে বড় গুন হলো ডি এর ভিতরে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গার পৌছানোর ইন্সটিং আর তারপ্র পাওয়া সুযোগ গুলো ঠান্ডা মাথায় কাজে লাগানো। ক্লোসা হলো এর পারফেক্ট এক্সামপল।


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন
  3. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    গতকালের গোল দেবার পরে ফ্লাইং সামারসল্টটা দিয়ে শেষ করতে না পারা দেখে একটা কথাই মনে হয়েছেঃ ঘোড়ার বয়স হয়েছে। দুইজনেই স্ট্রাইকার, দুইজনেই ফুটবল খেলে তারপরেও রোনালদোর সাথে ক্লোসা, মেসির সাথে রোনালদো (পর্তুগাল), এই তুলনা গুলো নিয়ে মারামারি দেখলে খুবই হাসি পায়। মানলাম খেলাটা ফুটবল। কৌশলে বড় দাগে খুব একটা ভিন্ন কিছু নাই। তারপরে ক্লাব ফুটবলের বদৌলতে এখন আর লুকানো শক্তি বলে কিছু নেই। সবাই জানে কে কোথায় কিভাবে খেলে। তারপরেও প্রত্যেকটা খেলোয়ার তথা মানুষের চিন্তাধারা ভিন্ন, ফুটবল-জীবনদর্শন ভিন্ন, আবেগ ভিন্ন--প্রত্যেকটি খেলোয়ার ভিন্ন। আমি এটায় বিশ্বাস করি।

    উপরে জুনাদা বললেন, আমিও বলবোঃ প্রত্যেকটি খেলোয়ার তার সময়ের সেরা। ক্লোসা সেই সময়টুকুকে একটু টেনে এই বিশ্বকাপ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। আমার কাছে এখন ক্লোসা হলো মালিকের সেই প্রিয় বুড়ো রেসের ঘোড়া যে নীরবে দৌড়ে গিয়েছে। ১ম, ২য়, ৩য় হলো কিনা সেই চিন্তা করেনি। শুধু দৌড়ে গিয়েছেঃ একজন আদর্শ অন্তরালের নায়ক। :boss:


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  4. রকিব (০১-০৭)

    ক্লোসা ক্লাবের হয়ে যেমনই খেলুক না কেন জার্মান জার্সি গায়ে জড়ালেই আমূল বদলে যান। মাথার ছোঁয়ায় কতবার যে গোলকীপার পরাস্ত হয়েছে তা পুরো বিশ্বই দেখেছে। সবচেয়ে ভালো লাগতো ক্লোসার বিনয়ী আচরণ। ফেয়ার প্লে'র ব্যাপারেও এই লোক যে কাউকে হার মানাবে।

    তবে বিবিসির মূল লেখক বেশ এক হাত নেবার চেষ্টা করেছেন রোনাল্ডোর উপর। এইটা খুব স্পষ্টই লেগেছে যে রোনাল্ডোর ঐ আবেদনটুকু মজার সুরেই বলা। সেইটা নিয়ে ত্যানা পেচানো আর কী! যাউজ্ঞা, আবার অনেকে ভাবতে পারেন ব্রাজিল সাপোর্ট করি বলে এহেন বলছি। তবে রোনাল্ডোর নারী ঘটিত প্রবলেম ছাড়া আর কোনকালেই তেমন ছ্যাছড়ামি চোখে পড়েনি তো, তাই বললাম। যাউজ্ঞা।

    ক্লোসার গোলের পর রোনাল্ডোর টুইটঃ
    “Welcome to the club, I can only imagine your happiness!!! What a great World Cup!!!"


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
    • আহসান আকাশ (৯৬-০২)

      বিবিসির লেখাটা আমার কাছেও একটু অপ্রয়োজনীয় রোনালদো ব্যাসিং মনে হয়েছে। রোনালদো আমার অন্যতম ফেভারিট প্লেয়ার, আমার দেখা সেরা স্ট্রাইকার। আর মাঠেও সে দারুন স্পোর্টসম্যান ছিল, নারীঘটিত ঘটনাগুলোকেও আমি ঠিক কেলেঙ্কারি বলবো না।


      আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
      আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

      জবাব দিন
  5. মোকাব্বির (৯৮-০৪)
    ক্লোসার গোলের পর রোনাল্ডোর টুইটঃ
    “Welcome to the club, I can only imagine your happiness!!! What a great World Cup!!!"

    ইহার নাম স্পোর্টসম্যানশিপ। যুগে যুগে অমর হয়ে থাকুক রোনালদো ও ক্লোসার মতন খেলোয়াররা! :boss:


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  6. মুশফিকুর রহমান তুষার (২০০২-২০০৮)

    ক্লোসা একজন জাত স্ট্রাইকার। গোল দেয়া তাঁর কাজ। এবং কাজটায় সে অতি দক্ষ!
    ১৫তম গোলটা দেখে খুব শান্তি পেয়েছিলাম। তবে খারাপ লেগেছে ডিগবাজিটা নিঁখুতভাবে শেষ করতে না পারায়। বয়স হয়েছে বোঝা গেলো! 🙁


    ছোট হাতি

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।