ছোটবেলা থেকে নিজেকে ভাল ছাত্র হিসেবেই জানতাম। ক্লাশে রোল কখনো ১ থেকে ৩ এর বাইরে যায়নি, অন্তত ক্লাশ সিক্স পর্যন্ত। ক্লাশ ফাইভে বৃত্তি পাওয়া এবং ক্যাডেট কলেজে চান্স পাওয়া এই দাবী কে আর জোড়ালো এবং পাকাপোক্ত করেছে। এলাকাতে তখন আমি একজন আদর্শ ছেলে হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছি। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম ছিল যে, সব বাবা মা রা ই চাইতেন তাদের ছেলেটি ও যেন এরকম আদর্শবান হয়। অথচ আমার এই সফলতার পুরো কৃতিত্বটা ই যে আমার বাবার, তা কেউ বুঝতে পারেননি, এমন কি আমি নিজেও না।
ব্যাপারটা একটু খুলে বলি। পড়ালেখা আমার দুই চোখের বিষ। আমি কখনই পড়তে বসতে চাইতাম না। পৃথিবীর কোন শক্তিই ছিলোনা যে আমাকে পড়ার টেবিলে বসাতে পারে, শুধু একজন ছাড়া। তিনি হলেন আমার বাবা। আমি আমার বাবা কে যমের মত ভয় পেতাম। আব্বা ঠিক যতটুকু সময় বাসাতে থাকতেন ঠিক ততটুকু সময় ই আমি পড়তে বসতাম, তা থেকেই আমার এই রেজাল্ট।
অবশেষে কলেজে জয়েন করলাম। জ়য়েন করার পরে দেখলাম অনেকের ই মন খারাপ বাসার জন্য। কিন্তু আমি মহা খুশী। কারণ, আমাকে শাসন করার জন্য আব্বা নেই এখানে। পড়ার জন্য কেউ জোড় করেনা। কেউ এসে পড়া তৈরী হয়েছে কিনা জানতে চায়না বা পড়া ধরেনা। প্রেপ টাইমে আমি মহা উৎসাহে চুড়ি করে গল্পের বই পড়ি, ঘুমাই, অন্যদের বিরক্ত করি। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সারা দিন কমন রুমে থাকি। এভাবেই এক সময় আবিস্কার করলাম, যে সবার জানা সেই ভালো ছাত্রটি কলেজে ক্লাশের সবচেয়ে পিছনের সাড়ির একজন ক্যাডেটে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি পরীক্ষাতে খারাপ করতে করতে আমার মাঝে একটা বদ্ধমুল ধারণা হলো যে, আমি আসলেই খারাপ ছাত্র। এতদিন ছোট্ট একটা গন্ডীর মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলাম বলে বুঝতে পারিনি। অথচ কলেজে লেখা পড়া না করার কারণে যে আমার রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছিলাম না।
কলেজে জয়েন করার পরেও আব্বা আমার লেখা পড়ার ব্যাপারে ভীষণ সিরিয়াস। আমি ছুটিতে যাবার আগেই আমার জন্য প্রাইভেট টিউটর ঠিক করে রাখতেন। ছুটি শেষে নেক্সট টার্ম এ যা যা পড়াবে প্রতিটি সাবজেক্ট এর সেই সেই চ্যাপ্টার গুলো আমার ছুটিতে থাকা অবস্থায় ই শেষ করতে বাধ্য করতেন আব্বা। আব্বার সিরিয়াসনেসের আরো নমুনা দিচ্ছি। রাফ লেখার জন্য আমার যে খাতা প্রয়োজন হবে, তা আব্বা দোকান থেকে বাধাই করে এনে নিজ হাতে রাত জেগে জেগে মার্জিন টেনে আমাকে প্রিপেয়ার্ড অবস্থায় দিতেন। তার লজিক ছিল, যতটা সময় এই খাতা বানাতে আমি নস্ট করব, সেই সময়ের মধ্যে আমি একটা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করতে পারব। আর আমি ছুটি থেকে কলেজে এসে ছুটিতে শেষ করে ফেলা সেই পড়া গুলো একটু ছুয়ে ও দেখতাম না, কিংবা নোট গুলো খুলেও দেখতাম না। সুতরাং ফলাফল সেই শূণ্য।
ছুটিতে থাকাকালীন ডাক বিভাগের কল্যাণে কয়েকটা দিন খুব খারাপ যেত। ডাক পিয়ন যেদিন রেজাল্ট এর খাম টি বাসাতে দিয়ে যেত, তার কিছু দিন পর পর্যন্ত বাসাতে সুনসান নীরবতা বিরাজ করত। আব্বার আশাহত সেই মুখ আমার আজো মনে পড়ে, কিন্তু তখন এর মানে বোঝার বয়স আমার ছিলনা। আমার বাবার আশা ভঙ্গের কারণে তার ব্যাথাতুর হৃদয়ে যে রক্তক্ষরন হতো, তা আমি তখন বুঝতাম না। ছুটি শেষে বাসে তুলে দিতে আসার সময় বাস স্ট্যান্ডে অন্যান্য ক্যাডেটদের বাবা রা যখন আমার বাবার কাছে আমার রেজাল্ট জানতে চাইতো, আমার বাবা তখন মুখ নিচু করে ফেলতেন। এত কিছুর পরেও আব্বা বাসে তুলে দেবার সময় আমাকে মাথায় হাত দিয়ে বলতেন, “একটু ভালো করে পড়িস বাবা।“
কলেজের কোনো রেজাল্ট দিয়েই আব্বার মুখে হাসি ফোটতে পারিনি। এস এস সি এবং এইচ এস সি তে আমার সহপাঠীরা বোর্ডে স্ট্যান্ড করে বাবা মা এর গলা জড়িয়ে ধরে ছবি তুলেছে আর পেপারে আমার বাবা সেই ছবি শুধুই দেখেছেন। হয়ত ভেবেছেন কেন আজ তার ছেলের ছবিটা পেপারে স্থান পেলনা? বাবা হিসেবে যা যা করার তিনি তো সব ই করেছেন। এমন কি অনেক বেশী ই করেছেন। তবু কেন দুটি পরীক্ষাতে ই তাকে তার ছেলের দুটি স্টার মার্কস নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে? ………আব্বার এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে ছিলনা।
সময় অনেক বদলেছে। কলেজের গন্ডী পেড়িয়ে আজ আমি নিজ কর্মখেত্রে প্রতিষ্ঠিত। কলেজের সেই শেষের সাড়ির ক্যাডেট টি আজ সেনাবাহিনী তে একজন সুপ্রতিষ্ঠিত অফিসার। আল্লাহ’র অশেষ রহমতে কলেজের মত আজ অন্তত কেউ আমাকে পিছনের সাড়ির অফিসার বলতে পারবেনা (দয়া করে কেউ আমাকে অহঙ্কারী ভাববেন না। আল্লাহ ও যেন আমাকে ক্ষমা করেন)।
আব্বা আজ অসুস্থ্য। হার্টে বাইপাস অপারেশন হয়েছে। মাঝে মাঝে নিজেকে ই এর জন্য দায়ী মনে হয়। আশা ভঙ্গের যে ব্যাথা আমি আব্বাকে দিয়েছি, যে রক্তক্ষরন তার হৃদয়ে আমার কারনে হয়েছে, হয়তো তার ছোট্ট হৃদয়টি তা সহ্য করতে পারেনি বলেই আজ এই অবস্থা। আজ আমাকে আর পড়তে বসতে বলতে হয়না। আজ আমি দিন রাত পড়া লেখা করি। নাওয়া খাওয়া ভুলে পড়া লেখা করি। মাঝে মাঝে ভাবি, এখন যেরকম লেখা পড়া করছি, তার ৫০% ও যদি কলেজে করতাম তাহলে হয়তো আমার বাবা ও আমার ছবি পেপারে দেখতে পেতেন। হয়তো আজ তিনি এভাবে অসুস্থ্য হতেন না।
জ়ানিনা আমার আজকের এই অবস্থান আব্বাকে কত টুকু সুখী করতে পেরেছে। তবে এটা ঠিক যে আজ আমি যা, তার পুরোটাই আব্বার জন্য। জানি, কোনদিনই আব্বা কে সামনাসামনি কথাগুলো বলতে পারবোনা। জ়ানাতে পারবোনা, যমের মত ভয়ংকর সেই বাবাটিকে আমি অনেক ভালোবাসি। পৃথিবীর সবাইকে আজ চিৎকার করে জানাতে ইচ্ছে করছে, “তোমরা শোন, আমি আমার বাবা কে অনেক অনেক ভালবাসি। আমার বাবা এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বাবা।“ সত্যি ই আমি আমার বাবাকে কখনো আমার ভালবাসার কথা জানাতে পারবনা……কোনদিন ও না……… But still its true, I LOVE YOU a lot dad….I LOVE YOU ….. If I become a father someday, I want to be a father like you….Please pray for me…. I LOVE YOU….
ছুঁয়ে যাবার মত লেখা।
বাবাকে নিয়ে এরকম স্মৃতি বোধহয় আমাদের অনেকেরই আছে।
অন্তত আমি নিজে একই দোষী। বাবার কোন স্বপ্নই ঠিকঠাক পুরণ করে তাকে কখনো ফেরত দিতে পারিনি.....
আপনার বাবা খুব তাড়াতাড়ি সুস্হ হয়ে উঠুন। পরম করুনাময়ের কাছে প্রার্থনা করছি।
আপনি ভাল থাকুন। অাপনার বাবা ভাল থাকুক।
পৃথিবীর সব বাবারা ভাল থাকুক।
সাতেও নাই, পাঁচেও নাই
ধন্যবাদ ভাইয়া।
দোয়া করি আল্লাহ যেন তোমাকে তোমার বাবার স্বপ পুরণ করার তৌফিক দান করেন।
আমিন।
লেখাটা পড়ে অশ্রুসংবরণ করা গেলনা...
অত্যন্ত শিক্ষণীয়, বাস্তবসম্মত, প্রেরণাদায়ক এবং গঠণমূলক একটা লেখা।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
দোয়া করি যেখানে থাকো, ভালো থাকো। আর বাবা মা কে অনেক অনেক ভালোবসো।
আহসান ভাই,
আপনি শুধু শুধু নিজেকে অপরাধী ভেবে কষ্ট দেবেন না। আপনি আপনার বাবার যে আশা ভংগের বেদনার কথা বলছেন, তার স্বাদ শতকরা ৭০-৮০% ক্যাডেটের বাবা পেয়েছেন বলেই আমার বিশ্বাস। আমার নিজের কথা বলি, প্রতি বার ছুটি থেকে কলেজে যাবার সময় আমার কমন কথা ছিল,'এই বার আমি সিরিয়াস.......!!!' আমরা দুই ভাই এক্স-ক্যাডেট, সেই হিসাবে আমাদের বাবার অনেক আগেই হার্টের সমস্যা হবার কথা...(ভাল কথা, আমার ভাই আপনাদের সমসাময়িক-'জুলহাস','৮৮-'৯৪,ঝ.ক.ক। বর্তমানে নেভীতে।)
আমি নিশিচত, আপনার বাবা আপনাকে নিয়ে অনেক গর্ব করেন।
আল্লাহ্ আপনার বাবাকে জলদি সুস্থ করে দেবেন, সেই কামনা করি।
জুনায়েদ,
অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
তোমার ভাই কি নেভী ৯৫(আলফা)ব্যাচের?
আমি তাহলে ওকে চিনি।
আবারো তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমার কষ্ট লাঘব করার জন্য।
ভালো থেকো ভাইয়া।
95 আলফা।
আল্লাহ আপনার আব্বাকে সুস্থ করে দিক।
আর খামোখা নিজেকে অপরাধী ভাববেন না।
আহসান ভাই,
আপনি এখন যে position এ আছেন। আমি যে আপনাকে চিনি তাতেই আমার গর্ব হয়। আর আপনার বাবা তো আপনার বাবা।
so, কষ্ট পাবেন না। আঙ্কেল আপনাকে নিয়ে এখন নিশ্চয়ই গর্ববোধ করেন।
আঙ্কেলকে তো দেখলে মনে হতো খুবই নরম টাইপের মানুষ(আমি যত টুকু দেখেছি), আপনি এতো ভয় পেতেন কেন?
দোয়া করি উনি তারাতারি সুস্থ হয়ে উঠুক।
সাব্বির,
ধন্যবাদ তোমার মন্তব্য'র জন্য।
তুমি ভালো বলে সব কিছুই তোমার কাছে ভালো। কারণ, তুমি ভালো মানুষ যে, তাই।
আব্বাকে তুমি দেখেছো যখন রায়হান (আমার ছোট ভাই) এর প্যারেন্ট'স ডে তে। হয়তো, ততো দিনে আব্বা অনেক ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন......। My poor dad....
"কারণ, তুমি ভালো মানুষ"
বুকের ছাতি ফুইল্লা তিন হাত হইয়া গেল। B-) ভাবে তো আমার মাটি তে পা পড়তেছে না।
আপনে ঠিক ধরছেন, রায়হানের পেরেন্টস্ ডে তেই আঙ্কেলের সাথে বেশ কয়েক বার দেখা হইছিল।
ভালো ছেলে,
দোয়া করি সবসময় তোমার কর্মকান্ডের মাধ্যমে বুকের ছাতি যেন ফুলেই থাকে। পা যেন আর মাটিতে না নামাতে হয়।
ভালো থেকো ভাইয়া।
আল্লাহ আপনার আব্বাকে সুস্থ করে দিক।এই দোওয়া করছি
সিরাজ,
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
আহসান ভাই,
আপনার লেখাটা নিচ থেকে উপরের দিকে পড়া শুরু করলে আমার সাথে মিলে যা্য় .... কেন জানি। সত্য।
হয়তো প্রকৃতির কোন খেয়াল...।
এইকানে সবার হাতের লেখাই একই রকম!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
ইমরান ভাই!
আপনি এখানে???
আপনার হাতের লেখাও তো বদলায়ে গেছে দেহি.......
সবাই keyboard দিয়ে লেখে তো তাই মনে হয় সবার হাতের লেখাই একই রকম!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
হা হা হা হা হা...।। :)) =))
I just liked the answer....
U ppl r genius..
হুম্ম।
পড়লাম। এবং দোওয়া করি সব সময় রে।
আংকেল এর জন্য শুভকামনা অফুরন্ত।
তুই মিছেমিছি কষ্ট পাচ্ছিস দোস্ত। আমরা জানি-তুই নিশ্চয়ই আংকেল আন্টিকে গর্বিত করেছিস।
এবং সামনে আরো করবি ইনশাআল্লাহ।
তোর দেয়া লিংকে আজ আসলাম।
ভাল থাকিস।
🙂
দোস্ত,
আমার ভাবতেই ভালো লাগছে যে তোর মত একটা গ্রেট লোককে ব্লগে আনার ক্ষেত্রে সামান্যতম অবদান আমার আছে।
ধন্যবাদ বাডি। ভালো থাকিস আর আমাদের সবাইকে সুন্দর সুন্দর মজার কিছু লেখা উপহার দিস।
আমি জানি তোর লেখার সামর্থ্য সম্পর্কে। So, no lame excuse.
আল্লাহ হাফেয দোস্ত।
😀
দোস্ত,
তোর অসামান্য অবদানের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
যাহ ! তুই তো Excuse রেও Excuse করে দিছিস !
😉
ভাল থাকিস।
আল্লাহ হাফেয।
সৈয়দ সাফী
কথা ঘুড়াবিনা।
নিয়মিত লিখবি।
ভালো থাকিস।
আপনার ছোট ভাইও এক্স-ক্যাডেট? কবেকার? সে এখন কোথায়?
হ্যা ভাইয়া। আমার ভাই ও আমার ই কলেজের এক্স ক্যাডেট। আমরা দুই ভাই ই শেরে বাংলা হাউসের ক্যাডেট। ওর নাম রায়হান। ক্যাডেট নং-১০৫০।
ও বর্তমানে লেফটেন্যান্ট। ৫৫তম দীর্ঘমেয়াদী কোর্সের সাথে পাস আউট করেছে।
আপনার অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা অসাধারণ...
অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
কতটুকু প্রকাশ করতে পেরেছি জানিনা, তবে ব্যাপারটা এভাবে বললে কি ভূল হবে যে, "তোমার অনুধাবন ক্ষমতা অসাধারন বলেই তুমি হৃদয় দিয়ে লেখাটি অনুভব করতে পেরেছ?"