আমার আবার বেঁচে উঠা

মে ২০২০
প্রেক্ষাপটঃ করোনা ভাইরাসের আক্রমণে মহামারী চলমান। “Stay home” এর campaign চলছে। প্রতিদিনের রোজগারে বেঁচে থাকা মানুষের সাথে এটা প্রহসন। ধনীরা ঘরে বসে, আর গরীবরা প্রতিদিন গায়ে-গায়ে ঘেঁষে সামাজিক দূরত্বের বিপরীতে অন্ন যোগাচ্ছে। বেঁচে থাকার যুদ্ধে গরীবের শ্রম আর ঝুঁকির বিনিময়ে বেঁচে আছে ধনীরা। বেঁচে আছে অর্থনৈতিক কাঠামোর গালভরা সব পরিমাপক।

আমি ধনী সমাজে বন্দি। একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত আর পুঁজিবাদী সমাজের কাঠামোতে আমার দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। সমাজের আমাকে, আমার মতো, আমার বয়সী ছেলেদের অনেক প্রয়োজন। কিন্তু আমি এক পুঁজিবাদী কাঠামোর দাবার গুটি হয়ে সৈন্য থেকে মন্ত্রী হবার প্রতিযোগিতায় হাসফাস করছি।

জুন ২০২০
আমি, আমার বড় ভাই আর বাবা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলাম। আমি আর ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম শ্বাসকষ্ট আর প্রচন্ড অসুস্থতা নিয়ে। বাবা ঢাকা সি.এম.এইচ এ ভর্তি। বাসায় মা, ভাবি আর দুটা বাচ্চা। মোট ৩৭ দিন বন্দি থাকলাম। কারো স্পর্শ ছাড়া, কাছে না এসে।


আমার শরীর বেশ খারাপ থাকতো। জ্বর, গা ব্যাথা, গলা ব্যাথা, দূর্বলতা, গলা শুকানো, স্বাদ গন্ধ না পাওয়া, ডাইরিয়া, প্রচন্ড কাশি, শ্বাসকষ্ট সব একসাথে। হাসপাতালে আমি আর আমার ভাই দুই জন দুই বেডে পাশাপাশি থাকতাম। পরিবারের কাউকেও আনতাম না সংক্রমণ এর ভয়ে। হঠাত কখনো জ্বর নামলে আমি হাসপাতালে ওয়ার্ডের শেষ মাথায় গিয়ে বারান্দার রেলিং এর পাশে ডাস্টবিন উপচানো ময়লার পাশ দিয়ে শহর দেখার চেষ্টা করতাম। মনে হতো এবার মনে হয় জ্বর আর আসবে না। শহরের কোন এক ছাদে আমি বসে থাকতে পারবো। কিন্তু আবার হয়তো পরের বেলাতেই বিছানায়। মাঝে মাঝে মোবাইল এ কিছু দেখার চেষ্টা করতাম।

মনে হতো বাস্তব জীবনের চার দেয়ালের বন্দিত্ব ভার্চুয়াল জীবনের বিশালতা দিয়ে রঙ্গিন করে ফেলা যাচ্ছে না। হাতের মুঠোফোন বা দেয়ালে ঝুলানো ইলেকট্রিক জানালার হাজারো বিকল্পের থেকে কাঠের কাচের বা স্টিলের জানালার ছবি সুন্দর। সেটা কোন স্থবির অলস দুপুর হলেও। সেখানে জীবনে বারবার জেগে উঠার প্রত্যাশা আছে। অনেক রং এর ছটা আছে। না থাকা রংগুলো হঠাত চলে আসার স্বপ্ন আছে।


জীবনের যেখানে আমি দাঁড়িয়ে, তার পেছনে অনেক সুন্দর মূহূর্ত ছিলো। সুস্থ হতে পারবো কিনা বুঝতে পারতাম না। বারবার একটা অন্ধকার সুস্থতায় ডূবে যাচ্ছিলাম। সুস্থ হতে পারলে আরো সুন্দর মুহুর্ত পাবো। মনে হচ্ছিলো আমি খুব ছোট কিছু মূহূর্ত সবথেকে বেশী উপভোগ করে এসেছি। বারান্দায় ভেজা তোয়ালে রাখতে গিয়ে হঠাত ছাই রঙ্গয়ের মতো ক্ষীণ হতে থাকা বিকাল আর সন্ধ্যার সন্ধিক্ষন। আহ! অথবা আম্মু খাবার বানাচ্ছে, সেটার টুংটাং শব্দ! অথবা আমার ডাইনিং টেবিলে বসার পুরনো হয়ে যাওয়া চেয়ারের গদি তে একপাশে চেপে বসায় আরাম। খুব ছোট কিছু কেনা লাগবে বলে দোকানে গিয়ে কাশেম চাচার সাথে দু’একটা কুশল। আমি কোন প্রোমশন, চ্যাম্পিয়ন হবার ঘোষণা মিস করতাম না। তাহলে কি চাইছিলাম জীবনে? আমার মনে হতো আমি প্রতিদিন অনেক মূহুর্ত পার করে এসেছি। দুর্দান্ত রকম সুন্দর মুহুর্ত। আমি আরো ভালো করে মুহূর্ত গুলা উপভোগ করতে শিখলাম তখন। সুস্থ হলেই থামতে শুরু করবো। মুহূর্তগুলো দেখা দরকার খুব আবার সুস্থ হলে।


অনেক মানুষ আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। পরিবারের মানুষেরা, ছোট বেলার কোন বন্ধু, অফিসের কলিগ, কলেজের বন্ধুরা যে যেভাবে পারছে কোন ডাক্তার কে বলছে আমাকে দেখে আসতে। অনেকেই ডাক্তারই দেখে যাচ্ছেন। যারা কিছু করতে পারছে না, মোবাইলে ম্যাসেজ দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছে! আমি কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হচ্ছি। কী চমৎকার সব সম্পর্ক হয়েছে জীবনে! খেয়াল করি হয়নি যে আমি এতো মানুষের কাছে আসতে পারছি।

আবার আমার পাশে এক বৃদ্ধ বাবাকে সেবা দিতে এসে তিন ছেলে ছোঁয়াচে রোগের ভয় বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়ে বাবা কে খাবার blend করে নাক দিয়ে খাওয়াচ্ছেন!

মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক গুলোই জীবনের সব থেকে বড় পাওয়া।


আমি যখন ভাইয়া কে নিয়ে ভর্তি করলাম, আমার নিজেরও শরীর খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু বেড ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বুঝতে পারছি না, ভাইয়া কে রেখে যেতে পারবো কি না। আমি নিজেই কি যেতে পারবো? আবার ভাইয়ার কি চিকিৎসা হবে আমি চলে গেলে? দুজন থাকতে পারবো কিভাবে বুঝতে  পারছিলাম না। আমারও চিকিৎসা লাগবে। তখনই ভাইয়ার সামনের বেডে এক রোগী মারা গেলেন। রোগীর আত্মীয়রা কান্না করছেন। আমি একটু সময় নিয়ে ওয়ার্ড বয়’কে মৃত রোগীর বিছানা দেখিয়ে বললাম, ওই বেড কি পাওয়া যাবে?

বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সব সংকোচ উধাও হয়। আদিম সত্ত্বা বেঁচে থাকা প্রবৃত্তি নিয়ে বেরিয়ে আসে। জীবন শুন্য অথবা এক, সাদা অথবা কালো, আলো বা অন্ধকারের মতো পরিষ্কার হয়।


কখনো আমার মনে হতো, আমি কি মারা যাবো এখানে? খুব বেশী অস্বাভাবিক ঘটনা না এটা। আমার মৃত্যু মানে এই পৃথিবীতে কি? প্রিয়জনের মাঝে অনেক দুঃখ, কান্না’র সূচনা হবে। শামসুর রহমানের ফটোগ্রাফ কবিতার মতো আমার একটি ছবি দেয়ালে ঝুলবে, কেউ কেউ দেখবে, কেউ দেখবে না। দেয়ালের শো-পিস এর মতো অনেক ফটোগ্রাফে স্থান পাওয়া আমার অস্তিত্বের স্বার্থকতা?

নাহ! আমার মৃত্যু মানে আমার জীবন দর্শনের মৃত্যু। একটি দর্শন বিচ্ছুরণ এর সুযোগ হারাবে। জীবন দর্শন এর বিচ্ছুরণ জীবনের অনেক বড় অর্থ।


এই কম্যুনিটি রোগে আর্থ সামাজিক স্তরের নিরাপত্তা কাজে দিবে না। ধনীরা যদি গরীবদের মাঠে পাঠিয়ে, আগোরা, ইউনিমার্ট এ শপিং করে বাঁচতে চায়, তা হবে না।

মিলিয়ন বছর ধরে বাদুর আর গাছের সম্পর্ক হয়েছে। জীবন শেষ করা প্রাণী-গাছ-গাছের ফল এদের সাথে ছত্রাকে সম্পর্ক হয়েছে। আর আমরা কয়েক দশক বা শতকে গড়ে উঠা সামাজিক নিরাপত্তার দেয়ালের সুযোগ নিয়ে co-existence কে অস্বীকার করতে পারবো?

সব কমিউনিটি আক্রান্ত হবে। সমাজ টা এক কাতারে দেখতে হবে।


দেশের সেরা হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ৷ এতো মানুষ কে বিনা খরচে খাবার, ওষুধ, চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। অনেক দূর্নীতি সিন্ডিকেট অব্যাবস্থা দেখছিলাম আমিও। সেগুলো কাটিয়ে উঠার উপায় আছে। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলের মতো সরকারি হাসপাতাল কম্যুনিটি কে বাঁচিয়ে রাখছে।


একদিন সন্ধ্যায় একজন রোগীর হাতে স্যালাইন এর Canola সরে গিয়ে অনেক রক্ত পড়ছে। ডিউটি’র নার্সে সময় শেষ হবার ৩০ মিনিট আগেই পিপিই খুলে বোরখা পরে বসে আছেন। উনি আসতে পারবে না। পরে জনও আসেননি। আমি দেখছি, কী করবো বুঝতে পারছি না। হাত উঁচু করে রাখতে বলছি রোগী কে। তখন অন্য এক রোগীর সাথে আসা ছোট একটা মেয়ে, কি চমৎকার ভাবে ড্রেসিং করে দেয়া শুরু করলো হাতের যেখান থেকে রক্ত পড়ছিলো। কোন ভাইরাসের ভয় নাই, সংকোচ নাই! ১৮-১৯ বছর হবে বয়স মেয়েটার। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম সাহায্য করতে।

ভেঙ্গে পড়া স্বাস্থ্য ব্যাবস্থায় কিছু মানুষের ব্যাক্তিগত উদ্যোগ, অবদান মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে। সিস্টেমের প্রাণ হয়ে আছে ব্যাক্তি, কিছু ডাক্তার, কিছু নার্স, কিছু সেচ্ছাসেবী মানুষরা।


ঢাকা মেডিকেল এর থাকাকালীন সময়ে আমার পাশের বিছানায় বরিশালের এক রোগী আসলেন, যিনি একটি স্কুলের পড়ান। একদিন দেখলাম আমার বাতিল করা একটি প্লাস্টিকের মগ ধুয়ে ওটা করে উনি পানি খাচ্ছেন। সমাজটা ভুল হাতে জিম্মি। একজন শিক্ষক একটি সিগারেট কোম্পানির কর্মকর্তার ফেলে দেয়া জিনিস গ্রহন করছে। সমাজের মুক্তি প্রয়োজন। শিক্ষকের প্লাস্টিকের মগের অভাব দূর করতে না পারা সমাজ কখনো শিক্ষিত হতে পারবে না।

 

একটা মহামারী অনেক ভাবতে শিখিয়েছে আমাকে। আমি অনেক কান্না দেখেছি। কান্নার মাঝে অনেক রঙ আছে, রকম আছে, সুর আছে। সবথেকে ভয়ানক কান্না আমার মনে হয় স্বজন মারা যাওয়ার কান্না। এই কান্না অনেক শুনেছি হাসপাতাল থাকতে। মহামারী কি শেষ হয়েছে? অন্তুন ভেরিয়েন্ট আসছে এখন আবার। আশা করি এবার কান্নার আওয়াজ শুনাবে না আর।

৬০৩ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “আমার আবার বেঁচে উঠা”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।