‘নিউজরুম‘ ‘নামের এক টিভি সিরিজ ফলো করতাম, সিরিজটা কিছুদিন আগে শেষ হয়ে গেছে । মুলত একটি নিউজ স্টেশনের নিউজম্যানদের পার্সোনাল এবং প্রফেশনাল লাইফ নিয়ে চমৎকার এক সিরিজ। এর শেষ সিজনে ‘বোস্টন বম্বিং‘ নিয়ে একটা চমৎকার এপিসোড ছিল, এই এপিসোডে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এর কারনে ‘ক্রাউড সোর্সিং‘ সৃষ্ট যে সমস্যাটা এখন তৈরি হচ্ছে সেটা চমৎকার ভাবে তুলে আনা হয়েছে, এবং ঐ ঘটনার সাথে এই ২ দিনে ‘জিহাদ’ নামক ছেলেটির মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এবং সময়ের সাথে আমাদের ভিউ পয়েন্ট চেঞ্জ হয়ে যাওয়ার মিল আসলে নেহাত কাকতালীয় নয়। এই সমস্যা এখন বাস্তব এবং নিদারুন ভাবেই কঠোর । নিউজরুমের অবতারনাও এই কারনেই ।।
‘নিউজরুম’ এ ‘বোস্টন ম্যারাথন বম্বিং‘ এ পর যখন ল’ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি গুলো ‘ম্যানহান্ট’ শুরু করে তখন চারদিকে শুরু হয়ে যায় ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা-রিউমার আর প্যানিক। ফেসবুক-টুইটার তথা সোসাল নেটওয়ার্কিং এর কারনে সবাই হয়ে যায় সাংবাদিক, চলতে থাকে ওয়াইল্ড গেসিং থিওরি। ঘটনার মাসখানেক আগে ‘সুনীল ত্রিপাঠি‘ নামক এক ইউএস সিটিজেন নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় তাকে খুজতে তার বোন ফেসবুকে এক পেজ খোলে, বম্বিং ঘটনার পর হিউজ নামক এক লোক হঠাত এক লোক থিওরি দিয়ে বসে যে সুনীল হয়ত এই বম্বিং এর সাথে জড়িত ! এই টুইট ফলো করে সিবিএস এর এক ক্যামেরাম্যান রিটুইট করে বসে যে পুলিশ স্ক্যানারে সে জানতে পেরেছে সুনীল এর সাথে জড়িত ! তার টুইট ফলো করে ‘বাজফিড’ (একটি পপুলার ট্যাবলয়েড, সব রিউমারের ঘাঁটি) এর এক রিপোর্টার রিটুইট করে তার ৮১,০০০ ফলোয়ারের কাছে যে সুনীলই এই বম্বার ! বাজফিডের এই টুইট ফলো করে এক সেলিব্রেটি (এখানে প্যারিস হিল্টন !) রিটুইট করে তার ১১ মিলিওন ফলোয়ারের কাছে যে বম্বিং কেস সল্ভ হয়ে গেছে, সুনীল ত্রিপাঠিই এই কালপ্রিট ! বাতাসের আগে খবর পৌঁছে যায় গোটা দেশে ! গভর্নমেন্ট অফিশিয়ালরা বারবার একে ডিনাই করে গেলেও ড্যমেজ এই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে তারা পাবলিক অপিনিওনের মুখে ইনভেস্টিগেট করতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল। ঘটনার এখানেই শেষ নয়, রাত থেকেই শুরু হয় সুনীলের বোনের মোবাইল এবং ফেসবুক পেজে একের পর এক আক্রমণ। ডেথ থ্রেট, রেপ থ্রেট থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত এন্টি ইজলামিক প্রোপ্যাগান্ডা। অথচ সুনীল কিন্তু আদতে মুসলমান ই নয় ! আর বম্বার ছিল দুই চেচেন ভাই !
ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নিউজের এ ধরনের সার্কুলার কে বলা হয় ‘ক্রাউড সোর্সিং‘। আমরা এমনিতেই গুজব প্রিয় হুজুগে জাতি, কদিন আগের ‘জিহাদের’ ঘটনার সাথে কি এর কোন মিল খুজে পাচ্ছেন? উন্নত বিশ্বে সরকার এবং নিউজ এজেন্সি গুলা তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারায় তারা হয়ত এই ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে সক্ষম, কিন্তু আমাদের দেশে কি সম্ভব ? আদতে এখন এই ২ সেক্টর যতসব ইঙ্কম্পিটেন্ট আবাল দিয়ে ভর্তি। কোয়ালিফাইড কিছু লোক অবশ্যই আছে, কিন্তু কোয়ালিটির কোন মূল্য আমাদের দেশে কখনই ছিল না, এরাও তাই টিকতে পারে না । ফেসবুকের ভাইভ দেখেই এরা নিজেদের কনভিকশন দিয়ে ফেলে, অথচ এদের একেকজনের ফলোয়ার হাজার হাজার থেকে লাখ লাখ ! একটা রিউমার বা অযাচিত কনভিকশন কতটুকু ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারে সেটা নিয়ে তাদের কোন চিন্তা নাই, এরা আছে লাইক কামানোর ধান্দায় ব্যাস্ত। এক সেলিব্রেটি থেকে আরেক সেলিব্রেটিতে নিউজ ছোটে, সাথে ছোটে লক্ষ লক্ষ হুজুগে বাঙালি। নিউজ চ্যানেলগুলা তো আরেক কাঠি সরেস, হরতালের এক্লুসিভ কক্টেল ফাটানো দেখানোর জন্য যারা পিকেটার দের সাথে আঁতাত করতে পারে, এয়ার টাইম পাওয়ার জন্য এরা করতে পারে না এমন কোন কাজ নাই। ‘জিহাদ’ কেস এর সর্বশেষ উদাহরণ।
দুপুরবেলা হঠাত জানা গেল ওয়াসার এক পরিত্যক্ত গভীর নলে ৪ বছরের এক শিশু পড়ে গেছে, ই মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মুহূর্তে সারা দেশে ছড়িয়ে পরল তীব্র উৎকণ্ঠা। নিউজ চ্যানেলগুলো শুরু করল লাইভ টেলিকাস্ট সাথে চারপাশের পাবলিক অপিনিওন, আর যায় কোথায় ! ১৬ কোটি বাঙ্গালীর অপিনিওন এট লিস্ট ৩২ কোটি না হলে চলে ! এক সময় জানা যায় শিশুটির কথা শোনা যাচ্ছে, তার কাছে জুস আর অক্সিজেন পাঠানো হয়, গোটা দেশ আশায় বুক বাধে। ছেলেটাকে হয়ত বাঁচানো যাবে । ‘Larger than Life’ বলে ইংরেজিতে এক প্রবাদ আছে, জীবন যখন শুধুমাত্র একটা জীবন ছাপিয়ে হয়ে ওঠে জিবনের চেয়েও অনেক বড়। ছোট জিহাদ তাই শুধু আর ‘আরেকটি বিপন্ন ছোট প্রান’ হিসেবে থাকেনি, সিম্বলিক মিনিং এ সে হয়ে ওঠে দেশের সবার ছেলে, পরিবারের আদরের ছোট সন্তান। বাড়ির মা’রা মোনাজাতে বসেছে ছেলেটিকে যেন জীবিত উদ্ধার করে মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেয়া হয়, বাবারা মসজিদে গেছেন সদ্গা দিতে ছেলেটিকে যেন শীঘ্র এই অন্ধ কুপ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এমন সময় মধ্যরাতে সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা লাইভ চ্যানেলে প্রস্ন করে বসলেন আসলেই জিহাদ নামের শিশুটা ঐ গর্তে আদৌ পরেছিল কিনা ! নিউজ চ্যানেলে এই টেলিকাস্টে দেশের মানুষ নির্বাক, দোলাচলে গোটা দেশ/ দেশের সাধারন মানুষের ইমোশন নিয়ে খেলা করার অধিকার তো কাউকে দেয়া হয় নাই ! মুহূর্তে নিউজ লুফে নিল ফেসবুক, শুরু হয়ে গেল অন লাইন প্রোপ্যাগান্ডা ! দেশে যা কিছু সবকিছুর পেছনেই নাকি কারো না কারো অদৃশ্য হাত থাকে, সেটা যত বড় বা ছোট ঘটনাই হোক না কেন ! মা একদিকে বুক চাপড়াচ্ছে ছেলের জন্য আর অন্যদিকে ছেলের বাবা-মামাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল পেটাতে! অথচ অকর্মণ্য ফায়ার ব্রিগেড অভিজান সমাপ্তি ঘোষণার ১৫ মিনিটের মাথায় উদ্ধার হল জিহাদের মরদেহ । কাকে দোষ দেয়া যায় এখন ? জিহাদের বাবা-মাকেই বা সান্তনা দেবে এখন কে ? জিহাদের দেহটা যদি শেষ পর্যন্ত পাওয়া না যেত, ইমিডিয়েট কনসিকোয়েন্স গুলা চিন্তা করতে কি খুব একটা বেগ পেতে হচ্ছে ? আমাদের সামনে তো উদাহরনের কোন অভাব নাই !! যেই নিক না কেন, যে কোন একটা ডিসিশানে পাবলিক ভারডিক্ট এর কিন্তু একটা বিশাল ইম্প্যাক্ট থাকে। আর পাবলিক ভারডিক্ট এখন অনেকাংশেই ই-মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর । কিন্তু এই নির্ভরতার কতোটুকু প্রতিদান মিডিয়া আমাদের দিতে পারছে ?? আমাদের মত হাইলি অপিনিওনেটেড জাতির জন্য তাহলে ‘মরাল কম্পাস’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে কে ??
ক্রাউড সোর্স কখনই জারনালিজমের কোন রুলস ফলো করবে না এটা নাহয় মেনেই নিলাম, কিন্তু দায়িত্বশীল একটা নির্ভরযোগ্য সংবাদ মাধ্যম চাওয়াটা কি আসলেই খুব বেশি ???
বাঙলাদেশের সংবাদ মাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিয়ে কথা বলা বন্ধ করেছি বেশ আগেই। আর ফেইসবুকের মহাজনদের কথা নতুন করে বলার দরকার নেই। মনুষ্য মহাজন, পেইজ ভিত্তিক মহাজন। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু বলার আছে। এবং সেটা আগাপাশতলা বিবেচনা ব্যাতিরেকেই হতে হবে। যেই কথাটা ঘুরে ফিরে বলি সেটা আবার বলবো। বললে মানুষজন চটে যায়। কিন্তু সত্য হলো আমরা হলাম গুজবপ্রিয়, আবেগপ্রিয়, অন্ধ বাঙালী। আমাদের ক্ষমতার বাইরের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আমাদের হাতে এসে পড়েছে এবং সেটা নিয়ে আমরা নাকানিচুবানি খাচ্ছি। শুধু প্রশাসন, শুধু সংবাদমাধ্যমকে গালি দিয়ে কি হবে। দোষ বড় দাগে আমাদের। এই আমজনতা নিয়েই তো সংবাদ মাধ্যম, প্রশাসন, তথা সমাজ। এখন হয়তো প্রশ্ন আসতে পারে, 'প্রযুক্তির আগমন তো ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। সেক্ষেত্রে দোষটা কি প্রযুক্তির নাকি প্রযুক্তির ব্যবহারকারীর?" কথা হলো এই ক্রাউড সোর্সিং এর খেসারত আগেও দিয়েছি, এই গতকাল দিলাম, সামনেও দিতে হবে। এটা চলবেই।
\\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\
:boss: :boss: :boss:
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ