এই পর্বে আমি আগের পোস্টের ধারাবাহিকতায় ‘জীবনাচরণ’ নিয়ে কিছু বলব। তবে আমার মনে হয়েছে তার আগে একটা কথা বলে নেয়া দরকার- আমার এই লেখাটার সাথে(আগের পর্ব সহ) সবাই স্বাভাবিকভাবেই বাস্তবকে মিলিয়ে উদাহরণ খোঁজার চেষ্টা করবেন। এইখানে আমার অনুরোধ- উদাহরণ অন্যের মধ্যে খোঁজার আগে, নিজের মধ্যে খোঁজাটাই মনে হয় ভাল হবে।
জীবনাচরণ এর অর্থ সোজা ভাষায় আমরা যা যা করি, সেটাই। আমাদের সমস্ত কার্যকলাপ মিলেই হল জীবনাচরণ। তবে এর একেকটা আচরণ আমাদের ব্যক্তিধর্মের একেক উপাদান থেকে এসেছে। অবশ্য কখনও একাধিক উপাদান থেকেও আসতে পারে। এখানে আমি বলব প্রত্যেক উপাদানেরই নির্দেশিত বিশেষ ধরণের জীবনাচরণ রয়েছে। খুব সাধারণভাবে দেখলে আমাদের এই আচরণগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক/সম্মিলিত। তবে আমি অবশ্য এখানে এই ভাগটাকে মূল ধরব না। তবে এটাকে বিবেচনায় রেখেই ভাগটা অন্যভাবে করার চেষ্টা করব।
প্রথম যে ভাগটার কথা আমি বলব, সেটা হল আচার-অনুষ্ঠান। প্রচলিত ধর্মগুলোর ক্ষেত্রে যেটাকে হয়ত বলা যায় উপাসনা বা আরাধনা। আমি ঠিক কোন কাজগুলোকে এই আচার-অনুষ্ঠান এর মধ্যে ফেলতে চাচ্ছি? একদিক থেকে ধরলে, যেসব কাজ আমরা সরাসরি পার্থিব বা বস্তুগত কোন কিছু পাওয়ার জন্য করি না সেগুলোই আচার-অনুষ্ঠান। (এখানে অবশ্য অন্যদের প্রাপ্য/অধিকারগুলোর কথা উহ্য থাকবে। সেকথা পরে আসছে) সাধারণত এসব আচার-আনুষ্ঠান দিন-ক্ষণ মেনে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট নিয়মে পালন করা হয়। কখনও সময়টা নির্দিষ্ট নাও থাকতে পারে। ধর্মীয় বিভিন্ন আচার এবং উৎসবকে আমি যেমন এর মধ্যে ফেলছি, তেমনি এর মধ্যে ফেলছি বিভিন্ন সামাজিক আচার-উৎসবকেও। একইভাবে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় ভাবেও আমরা এমন কিছু অনুষ্ঠান-উৎসব পালন করি। বিভিন্ন দল বা মতাদর্শ বা খেয়াল করলে দেখা যাবে যেসবকে আগে ব্যাক্তিধর্মের উপাদান বলা হয়েছিল, সেসবগুলোরই মোটামুটি এমন কিছু আচার-অনুষ্ঠান পাওয়া যাবে। এর অনেকগুলোই এমন কোন দিন বা ঘটনাকে স্মরণ করে করা হয় যেটা ঐ উপাদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এসব আচার-অনুষ্ঠানে আবার প্রধানত তিন ধরণের অংশ থাকে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে- একেবারে নির্দিষ্ট নিয়মে কিছু করা, ঐ বিশেষ উপাদান(ধর্ম/মতাদর্শ/অন্যান্য) নিয়ে আলোচনা(ব্যক্তিগত পর্যায়ে সেটা পড়াশোনা বা চিন্তাও হতে পারে) এবং বিনোদন। আগের পোস্টে মানসিকতা এবং জীবনাচরণের মধ্যকার পারষ্পারিক নির্ভরশীলতার একটা চক্রের কথা বলেছিলাম। যেমন একদিক থেকে দেখলে আমাদের মানসিকতাই নির্ধারণ করে দেয় আমাদের জীবনাচরণ। বিশেষ ধরণের মানসিকতা থেকে বিশেষ ধরণের আচরণ আমাদের মধ্যে আসে। অর্থাৎ আমাদের জীবনাচরণ মানসিকতার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু উল্টোটা কিভাবে হচ্ছে? চক্রের হিসেব করলে মানসিকতা কিভাবে জীবনাচরণের উপর নির্ভরশীল হল?
আমি মানসিকতার মধ্যে যে দুটো ভাগ দেখিয়েছিলাম- আদর্শ এবং লক্ষ্য, এর দুটোকেই বারবার আলোচনায় আসতে হয়। আদর্শের চর্চা না হলে, আলোচনায় না আসলে ধীরে ধীরে ব্যক্তির উপর এর প্রভাব কমে আসে। উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের ব্যাপারেও একই কথা। যারা এই লক্ষ্য পূরণ করবে, তাদেরকে যদি বারবার বা অন্তত কখনো কখনো ঐ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া না হয়, সেটা ফিকে হয়ে যায়। আর আমাদের এসব বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানগুলোর(ব্যক্তিগত অথবা সম্মিলিত) মাধ্যমেই এই আলোচনা, চর্চা বা স্মরণ করার কাজটা হয়। সুতরাং মানসিকতাও ঠিক থাকে। অর্থাৎ পুরো চক্রটাই ঠিকঠাক মত চলে আর কি। আচার-অনুষ্ঠানের যে তিন ধরণের অংশের কথা বলছিলাম, এর মধ্যে নির্দিষ্ট নিয়মে করা আচারগুলো অনেকটা পরোক্ষভাবে এই মানসিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। এর দ্বারা ভিতর থেকে হয়ত এমন একটা অনুভূতি আসে যেটা ব্যক্তিকে ঐ বিশেষ ধরণের মানসিকতার জন্য অনুপ্রাণিত করে। অপরদিকে আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে আদর্শ বা লক্ষ্য উঠে আসে প্রত্যক্ষভাবে। এতে মানসিকতার কাঠামোটাও মজবুত হয়। আর বিনোদন যোগ হয় এর সাথে কিছুটা বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে। মানসিকতাকে একটা গাছের সাথে তুলনা করলে, আচার তৈরি করে শিকড়, আলোচনা অনুষ্ঠানে এটার কান্ড ডালপালা ছড়ায় আর বিনোদনের অংশটুকু অনেকটা ফুল-পাতার সৌন্দর্য। যদিও এসব বেশীর ভাগ সময়ই সম্মিলিতভাবে পালন করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই এর ব্যক্তিগত রূপও রয়েছে।
এখন আরো কিছু কথা বলেই এ পর্ব শেষ করব। সেটা হল, অনেক আচার-অনুষ্ঠান আছে, যেটা কোন বিশেষ কোন মানসিকতা বা একটু স্পষ্ট করে বললে কোন মূল্যবোধ বা আদর্শ ছাড়াই পালন করা হয়ে থাকে। বা হয়ত ঠিকমত চর্চার অভাবে ঐ বিশেষ মানসিকতাটা আর তেমন জোরাল নয়। এটা কেন হয়? উত্তরটা অনেকটা প্রশ্নের ভিতরেই লুকিয়ে আছে। যখন মূল্যবোধ/আদর্শের আলোচনা বা চর্চা কম হয়, তখন কি ঘটে? বিনোদনের অংশ থাকলে, সেটা অনেক সময় প্রথায় পরিণত হয়। সেই আচার-অনুষ্ঠান থেকে মানসিকতা/আদর্শ নতুনভাবে কোন প্রাণ পায় না। আচার বা অনুষ্ঠানটা হয়ে যায় সুন্দর ফুল-পাতায় সজ্জিত পরগাছার মত। আর যদি বিনোদনের অংশ কম থাকে বা একেবারেই না থাকে, তাহলে সেটা নির্জীব হতে হতে এক সময় বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে। এজন্যই অনেক অনুষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার জন্য এর মধ্যে বিনোদন আমদানী করা হয়। আমরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে উদাহরণ খোঁজার চেষ্টা করি। আশা করি সবাই পেয়ে যাব।
আমার জীবনাচরণ বিষয়ক কথাবার্তা কিন্তু শেষ হয়নি। বাকীটা থাক পরের পর্বের জন্য।
ইটা B-)
d-(^_^)-b
ভাল। অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ ভাইয়া
খুবই মনযোগ দিয়ে এই পর্ব প্রথম পর্ব আর প্রথ পর্বে দেয়া স্বজাত্যবোধ জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ক লেখাটা পড়লাম। এনালোজিগুলো বেশ সুন্দর হয়েছে। বক্তব্য গুলোও বেশ পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। আর আমার ব্যাক্তিক ও আমার পার্শ্বের মানুষের মাঝ দিয়ে তত্ত্বগুলো প্রয়োগ করার চেষ্টা করলাম। তারপরে এই আলোচনাকে অনেকাংশে সফল মনে হয়েছে। ছোট ছোট জিনিসের ভালো বিশ্লেষণ। কিছু কিছু জায়গায় দ্বিমত আছে । সেগুলো পুরো লেখা শেষ হলে বলা যাবে। আপাতত চমৎকার বিশ্লেষণধর্মী লেখার জন্য অভিনন্দন।
ঐ
(সম্পুর্ণ মন্তব্যের সাথে)
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
পুরো লেখা শেষ হলে আপনাদের মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকব...