মেডিটেশন
নবম শ্রেনীর কোন এক টার্মে, আমাদের মাহ্দী বিদ্যুৎ মিত্রের বই নিয়ে হাজির। মেডিটেশনের উপকারিতা বর্ননা করতে করতে অস্থির। ইতিমধ্যে খায়ের মেডিটেশনে পুরোপুরি উস্তাদ বনে গেল। সে নাকি চোখের ইশারায় চামচ বাকা করে ফেলেছে। চোখ না যেন হাতের ইশারায় বেডের উপর হতে তালা বন্ধ রুমের চাবি উদ্ধার করেছে। মাহ্দীর কাছে জানলাম, মেডিটেশন করে নাকি দেহের ওজন শূন্য করে বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। পুরো ব্যাপারটাতে আমারো একটু আগ্রহ জন্মালো।
বৃহঃস্পতিবারের রাত, মাহ্দীকে অনেক বলে কয়ে বইটা কিছু সময়ের জন্য ধার দিতে রাজী করালাম। পড়ার পর কয়েকটি বিষয় অবগত হলাম যেমন মনের দরজা, মনের বাড়ী, চিন্তার সিড়ি, তবে এইসবের সামান্যটুকুও আমার অনুর্বর মস্তিষ্কে বোধগম্য হল না। অতঃপর মনে হল উক্ত বিষয় একাএকা পাঠ মোটেই ফলপ্রসু হবার নয়। গেলাম কামালের নিকট, তাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝানোর চেষ্টা করলাম। এবং শেষ পর্যন্ত তাকে রাজি করালাম পুরো ব্যাপারটা তার উপরই এপ্লাই করা হবে।
রুমে আমি আর কামাল, দরজা ভালো করে বন্ধ করে দেয়া হল। লাইট এর উপর রঙিন কাগজ লাগিয়ে একটা আবছা আলোর পরিবেশ তৈরী করা হল। কামালকে বিছানায় মৃতের মত সোজা করে শোয়ানো হল। আবছা আলোয় আমি বই দেখে দেখে পড়ে যেতে লাগলাম কিভাবে মনের বাড়ীতে যেতে হবে। কিভাবে ধীরে ধীরে মনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে সিড়ি বেয়ে অনেক গভীরে নেমে যেতে হবে। কিভাবে দেহের ভর শূন্য করতে হবে। আমি পড়ে যাচ্ছিলাম, “এখন তোমার শরীরের কোন ওজন নেই, তুমি চাইলে বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারো, দেখো তোমার শরীর হালকা হয়ে যাচ্ছে, তোমার গায়ের শক্তি লোপ পাচ্ছে, তোমার গায়ে কোন শক্তি নেই……”।
আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই তড়াক করে কামাল বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠল। তারপর আমার উপর হামলা, কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পর যেভাবে পাড়ছে আমাকে মারছে। আর বলছে, “আমার গায়ে শক্তি নাই, নাহ্! এবার দেখ, শক্তি আছে কি নাই।”
মাইর খাইয়া আমার মেডিটেশনের ভূত পালাইছে আর কোনদিন মেডিটেশনের কথা ভুলেও মনে আনি নাই।
ড্রাকুলা
অষ্টম শ্রেনীর ঘটনা। সম্ভবত আসিফ ভাই রকিব হাসানের “কাউন্ট ড্রাকুলা” বইটা এনেছিল। সিরিয়াল পাইতে পাইতে অনেক দেরী হলেও শেষ পর্যন্ত আমার হাতে আসলো। বিকালের প্রেপে নিয়ে গেলাম, টেক্সট বইয়ের ভিতরে রেখে পড়া শুরু করলাম। বইয়ের যত গভীরে যেতে লাগলাম ধীরে ধীরে ভয় তত বাড়তে লাগলো। গেমস টাইমে খেলায় খুব একটা মন দিতে পারলাম না। ঘুরে ফিরে ড্রাকুলার কাহিনী মনের ভিতর আওড়াতে লাগলো। টি ব্রেক, মাগরিবের নামাজ শেষে আবার প্রেপ। সাহস করে নিয়ে গেলাম আবারো প্রেপে, যদিও আসিফ ভাইয়ের কট্টর নিষেধ ছিল যেন প্রেপে না নিয়ে যাই। কিন্তু কিছুতেই বই শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিলাম না। স্যারদের আর বড় ভাইয়াদের নজরদারিতে প্রেপে খুব একটা পড়তে পাড়লাম না। ভয় যেন প্রচন্ড রকম জাপ্টে ধরল। এখন একটাই উপায় ড্রাকুলা না মারা যাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই ভয় দূর হবে না। লাইটস অফের আগে যেটুকু সময় পাওয়া গেল সব কাজ ফেলে রেখে পড়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু শেষ করতে পারলাম না। আরো ঘন্টা দুই লাগবে শেষ করতে। কি আর করা, অগত্যা যেতে হল টয়লেটে।
চারদিক সুনসান নিরব, আমি একমনে পড়ে যাচ্ছি টয়লেটে। রাত তখন বারোটার মত, কেউ হয়ত পাশের টয়লেটে এসেছে। দরজা ঠাস করে বন্ধ করতেই প্রচন্ড আঁতকে উঠলাম। এভাবে আরো কয়েক বার ভয় পেলাম কারো পায়ের আওয়াজে, কমোডে ফ্লাসের আওয়াজে, গার্ডের বাঁশির আওয়াজে। রাত একটা দেড়টার দিকে আমার বই পড়া শেষ হল। সূর্য ডোবার আগে গজাল ঢুকিয়ে দেয়া হল ড্রাকুলার বুকে। আহ শান্তি, আর কোন ভয় নেই।
সেই গা ছমছমে, শীতল অনুভূতি আর কভু পাওয়া হয়নি, মারাত্মক হরর ফিল্ম দেখেও নয়।
বৃষ্টির রাত
নবম শ্রেনীর শেষের দিকের ঘটনা, তখন ৩২৬ নম্বর রুমে থাকি। আমরা চারজনই একই ব্যাচের, সোহেল, মঈন, সুমন আর আমি। রাত দুইটার দিকে, সুমন আমাকে ডেকে তুললো। বাইরে প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে। শোঁ শোঁ বাতাসের আওয়াজ। সুমন থাকে একদম পূর্বদিকে জানালার পাশের বেডে, তারপর আমি, তারপর মঈন, তারপর সোহেল কিন্তু সোহেল সেদিন ছিল হাসপাতালে।
সুমন ভয়ে কাঁপছে, তার অভিযোগ বাইরে কে যেন হি হি করে হাসছে। আমিও ঘুম ভেঙ্গে পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। চারদিক অদ্ধকার, বিদ্যুৎ নেই। সম্ভবত জেনারেটরও চালানো হয়নি। বিদ্যুৎ ঝলকানিতে মাঝে মাঝে চারদিক খুবই ক্ষীন সময়ের জন্য আলোকিত হচ্ছে, তীব্র না হলেও বজ্রপাতের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
আমি কান পেতে আওয়াজ শোনার চেষ্টা করলাম, হুম ধরতে পারলাম, থেমে থেমে এক বৃদ্ধ মহিলার রূঢ় হাসি যেন কোন একদিক হতে আসছে। আওয়াজটা ঠিক এই রকম “হু হু হুহ… হুম; হু হু হুহ…. হুম”। দুই একবার হওয়ার পর আবার থেমে যায়, আবার দুই এক মিনিট পর হয়। এবার ভয় আমাকেও প্রচন্ড রকমে আকড়ে ধরল। এদিকে আরেক মসিবত, প্রচন্ড টয়লেট চেপেছে কিছুতে ধরে রাখতে পারছিলাম না। এভাবে বোধ করি, পনের বিশ মিনিট অতিক্রম হল। কিন্তু কিছুতেই শব্দের উৎস বের করতে পারলাম না। আমি আমার সমস্যার কথা সুমন কে বললাম। “বন্ধু আরতো ধরে রাখতে পারছি না”। যদিও টয়লেট খুবই কাছে, তবুও এই অন্ধকারে সুমন যেতে রাজি নয়। শেষপর্যন্ত রাজী করালাম সুমন দরজা খুলে দরজায় দাড়াবে, আমি বারান্দা রেলিং দিয়ে কাজ সাড়বো।
যাইহোক কাজ শেষ করে, এবার রহস্য উৎঘাটনে নামলাম। সাহস করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। সুমন আমার পাশে, আরেকজন গভীর ঘুমে তাকে আর ডাকলাম না। এই দিক ঐ দিক চারদিক দেখে নিলাম। নাহ্ কোন কিছুই পেলাম না, না ভুত, না মানুষ। সুমন আমার কানের কাছে ফিস ফিস করে বলছে, “পুবের বড় পুকুরটাতে নাকি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীরা প্রচুর লোককে হত্যা করেছে”। ভয়ে দুজন দুজনের হাত শক্ত করে ধরে খোজে যেতে থাকলাম।
এমন সময় আমাদের কে উৎফুল্ল করে চারদিক আলোকিত হয়ে উঠল। বিদ্যুৎ এসেছে। পুকুর পাড়ের লাইট পোস্ট গুলো জ্বলে উঠল। আর একটা প্যাঁচা আমাদের জানালার নিচের সানসেট থেকে উড়ে গিয়ে লাইট পোস্টের টিউব লাইটের কভারের উপর বসল। আমরা দম ফেলে আস্বস্ত হলাম, এখানে ভয়ের কোন ব্যাপার নেই।
এই অতি চমৎকার লেখার জন্য আপনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি ( :thumbup: :thumbup: ) দেখান হইল! 😀 😀
\"why does the weasel go pop? does it matter?
if life is enjoyable, does it have to make sense?\"
অনেক ধন্যবাদ
🙂 🙂 :thumbup: :thumbup:
Life is Mad.
সায়েদ ভাই, আপনার মন্তব্য পাওয়া বড়ই উৎসাহের ব্যাপার।
😀
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
রাজীব ভাই খালি দাঁত দেখাইলে হইল, কিছু মন্তব্য করেন। একটু উৎসাহ পাই।
বললে তো অনেক কিছুই তো বলতে হয় মহিউদ্দিন।
ঐ বয়সে (৯ম) তে আমরাও বিদ্যুৎ মিত্র, মহাজাতক, কিরোর বই পড়তাম।
শরী হাল্কা হয়ে হয়ে যাচ্ছে, বেলুনের মতো ভাসছে।
আমাদের ক্লাসের একজনের হাতে সলোমন রিং ছিলো,
একজনের হাতে আত্মহত্যার প্রবণতা ছিলো,
আমার হাতেরই তর্জনী আর মধ্যমা প্রায় সমান,
আমার হাতে যে হার্ট লাইন আছে তা আমি এখনো কারো হাতে দেখি নাই।
আর ড্রাকুলা না, আমি বা আমরা আতঙ্কিত হইছিলাম ওমেনের সেবার অনুবাদ পইড়া। লাইটস আউটের পর বাথরুমে বই পড়ার চিন্তা মাথায় আসে নাই। আর আমার চেহারা তো দেখছিস; মাশাল্লাহ। আর ঐ বয়সে নাটক ও করতাম। অবধারিত ভাবে মেয়ের ক্যারেক্টার। তার মধ্যে একটা ছিলো রেপড মেয়ের ক্যারেক্টার। সো রেষ্ট টাইমে আর লাইটস আউটের পর সেভেন আর এইটে থাকতে রুমমেট রে নিয়া যাইতাম। এই বুদ্ধি আর ঐ রুমমেটই দিছিলো। হাউস বেয়ারা থিকা শুরু কইরা ভি পি পর্যন্ত আমারে জিজ্ঞাসা করতো কেউ টিজ করে কিনা? সিনিওররা গল্প করতে ডাকে কিনা? ঐ বয়সে সত্যি নাদান ছিলাম না হইলে কিভাবে স্টেজে উইঠা বলি, আমাকে খুব্লে খেয়েছে ঐ শয়তান। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, আমাদের সময়ে কলেজের পরিবেশ খুব ভালো ছিলো এ ব্যাপারে।
আর সময়ে এক জুনিওর ছেলে ছিলো ঘোর কৃষ্ণবর্ণের। সে এক রাতে করিডোর দিয়ে হেটে বাথরুমে যাচ্ছে; খালি গায়, হাফ প্যান্ট পরা। আমাদের এক ব্যাচমেট তো দেখে একটা হাফ প্যান্ট হাইটা আসতেছে; বিশাল ভয় পাইছে। এরপর ঐ পোলার উপর সমন জারি হইছিলো যাতে সে শার্ট ও পরে বের হয় রাতে।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
একটা হাফ প্যান্ট হাইটা আসতেছে 😀 😀 😀
একটা হাফ প্যান্ট হাইটা আসতেছে;
\"why does the weasel go pop? does it matter?
if life is enjoyable, does it have to make sense?\"
=)) =))
এই কাহিনী আগেও একবার শুনছিলাম।
কাজী আনোয়ার হোসেনের আরেক নাম যে বিদ্যুৎ মিত্র তা কি সবাই জানি?
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
অতি চমৎকার লেখা :clap: :clap: :clap: =)) =)) =))
মাহদী ভাইয়ের মেডিটেশন! আমাদের উপরে দু'একবার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন... প্রতিবারই আমি বেশ শান্তির একটা ঘুম দিছিলাম 😛
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
😀 😀