ফেরিওয়ালা…

কিছু কিছু মুহুর্ত এমন আচমকা হৃদয়কে স্পন্দিত করে যায় যে তখন মনে হয় এ অনুরনন বুঝি কখনো থামার নয় । বাস্তবিক তাই হয় , আমার অন্তত তাই ধারনা । মনে হয় চাক্ষুস দৃস্টিতে পুকুরের ঢেউএর মত তা একসময় থেমে গেলেও শক্তির অবিনশ্যতাবাদ হিসেবে তা এই মহাশুন্যে সাইন কার্ভের এর উপর ভর করে ঠিকই ভেসে বেরাছ্ছে । সময়ের দুরত্ত আর নতুন নতুন তরঙ্গের কারনে তা শুধু নিজের কম্পাঙ্ক পরিবর্তন করে । ইদানিং আমার লেখা গুলো বোধহয় একটু বেশি ভারি ভারি হয়ে যাছ্ছে , বুঝছি না প্রসংটা সবাই কিভাবে নিছ্ছে ।

বই পরার প্রতি দুরন্ত আগ্রহটা আমার বেশ ছোট বেলা থেকেই । তখন প্রায়ই আপু আর ভাইয়ার বড় ক্লাসের বই গুলো লুকিয়ে লুকিয়ে পরতাম , আরো বেশি জ্ঞানী হওয়ার জন্য না , নিছক ভাল লাগত বলে । আর তারপর যখন গল্পের বই ধরলাম তখন তো মা র বকুনিতে তিনটার সময় লাঞ্চ আর অফিস শেষে পাচটার সময় বাবার স্কুল ইউনিফর্ম পরা আমাকে টেনেটেনে বাসায় নিয়ে আসা একটা সাধারন ঘটনা । তখন আমরা দিনাজপুরে ছিলাম । আমার এই সল্প বইজীবনের একটা বড় অংশ দিনাজপুর পাবলিক লাইব্রেরিতে কেটেছে । তবে ভালো্লাগার এই বই পরার জন্যেও যে রাজনী্তি্র মারপ্যাচ আর সুযোগি দৃস্টির প্রয়োজন তা ক্যাডেট কলেজে আসার আগে জানতাম না । কলেজে লাইব্রেরি ক্লাশের আগে তো প্রায় ই ঘনিষ্ঠ চার পাচজন আমরা অগ্রিম সিরিয়াল দিয়ে রাখতাম , দোস্ত আমাদের মধ্যে যেই কোন বই ইস্যু করবে তারপর আমরা বাকি চারজনকে অটো সিরিয়াল দিয়ে দিব , ঠিক আছে ?

তবে এত হাজারো বই এর ভিতরে প্রথম ধাক্কা দেয়া বইটার কথা আজো মনে আছে । এরিক মারিয়া রেমার্কের ” অল কোয়াইট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট ” । বাংলায় , পস্চিম রনাংগন সম্পুর্ন শান্ত । ক্লাস এইটে কোন এক ছুটির বিকেলে বইটা পরছিলাম । এখনো স্পস্ট দেখতে পাই , পরার সময় আমি শুধু বারবার এদিক ওদিক তাকাছ্ছিলাম , চোখের কোনায় জমা হওয়া পানি কেউ দেখে ফেললে ভীষন লজ্জা পাব । বিরতিহী্ন বুলেট আর অনবরত আর্টিলারি শেলিং এর মাঝে একজন মানুষের ভিতরটা এত সছ্ছ করে বোধহয় আর কেউ আকতে পারত না । সারাদিন আমার প্রচন্ড মন খারাপ ছিল । বারবার মনে হছ্ছিল প্রথম মহাযুধ্যের সেই বীভিষিকায় আমিও ছিলাম , কোন এক টাইম মেশিনে করে পালিয়ে এসেছি , বই এর প্রতিটা চরিত্রের মৃত্যু এত বাস্তব মনে হছ্ছিল । তারপর একে একে যখন ” দি রোড ব্যাক , এ টাইম টু লি্ভ এন্ড এ টাইম টু ডাই আর থ্রি কমরেডস্ ” শেষ করলাম তখন দুই বিশ্বযুদ্বের ই প্রতিটি বুলেট যেন আমি অনুভব করেছি । ” সম্ভবত এই বই টি লেখকের লিখা সবচেয়ে কোমল বই…” ভেজা ভেজা চোখে থ্রি কমরেডস পরা শেষে অনুবাদকের মুখবন্ধ পরে হাসছিলাম ।

আমরা যখন বাসায় ছিলাম ( ক্লাস সেভেনের আগে ) তখন ভিসিআরে মুভি দেখার চল খুব বেশি ছিলনা । বিশেষ করে ইংরেজি মুভি তো না ই । তবে এ নতুন আগ্রহ এর সন্ধান দিয়েছিলেন আমাদেরই এ্যাডজুট্যান্ট ( তখন আমরা ক্লাস এইটে ) । অবাক করে তখন বৃহঃস্পতি বারের সাথে সারা শুক্রবারও মুভি চলতো । সে আবার যেনতেন মুভি না ইন্ডিয়ানা জোন্স , ব্রেভহার্টস , গোল্ডেন আই মার্কা মুভি । তবে ব্রেভহার্টস মুভিটা দেখার সময় আবার এদিক ওদিক তাকাতে হল , তাকিয়ে অবশ্য সবাইকেই বারবার এদিকসেদিক তাকাতে দেখেছি । কলেজে একবাক্যে মেল গিবসন এর আধিপত্ত মেনে নিলেও টম হ্যাংকস এর জাদু দেখার সৌভাগ্য হয় বের হওয়ার পর । ফরেস্ট গাম্প , গ্রিনমাইল , কাস্ট অ্যাওয়ে… দেখার পর প্রতিবার ই নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়েছে , অদ্ভুত অদ্ভুত । তবে তার মধ্যেও ফরেস্ট গাম্প মুভিটা অনবদ্য । এতো নিখুত ভাবে কিভাবে আমাদের চারপাশের সবচেয়ে অবহেলায় দেখা চরিত্র মেলে ধরা সম্ভব……। সবশেষে জেনির মৃত্যুতে প্রচন্ড কস্ট পেয়েছি । সারাজীবনের ভালো্বাসাও মৃত্যুকে একটু দেরি করিয়ে দিতে পারেনা । তাই টম হ্যাংকস এর মত আমিও কনফিউসড , জীবনটা কি সত্যিই উদ্দেশ্যহীন ভাবে ভেসে বেরানো পালকের মত নাকি সব জীবনই একটি নির্দিস্ট দিকে এগিয়ে যায় ।

অনেক সময় অলস দুপুরে এই সব নিয়েই ভাবি । কেন যেন এদের সবাইকেই আমার ফেরিওয়ালার মত লাগে । ভাল লাগলে কাছে ডেকে একেকটা স্যুভেনির তুলে নেই । সাদা , স্বছ্ছ স্যুভেনির গুলো যখন আলোতে ধরি তখন বর্নালির একগাদা বর্নছ্ছটা নিয়ে হাজির হয় । ” কোন রঙটা দিয়ে গেলেন ? ” কিন্তু ততক্ষনে সে দিগন্তের শেষ মাথায় , অনেকটাই অস্পস্ট……।

২,২৯১ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “ফেরিওয়ালা…”

  1. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    "স্বপ্ন, মৃত্যু, ভালোবাসা"
    "অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট"
    "দ্যা রোড ব্যাক"
    "থ্রি কমরেডস"
    "দ্যা ব্ল্যাক অবিলিস্ক"
    সেবা প্রকাশনীর বদৌলতে এরিক মারিয়া রেমার্কের এই বইগুলোর মতোন যুদ্ধ বিষয়ক আর কোন বই মনের ভিতর এতটা আলোড়ন তুলতে পারেনি। যুদ্ধ চলছে-যুদ্ধ থামল-যুদ্ধের পর ফিরে এসে সভ্য সমাজে মানিয়ে নিতে না পারা-যুদ্ধের পর জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার অবর্ণনীয় কষ্ট সব একাধারে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক অসামান্য দক্ষতায়। তুলনা করলে মাঝে মাঝে থৈ খুঁজে পাই না। নিজের দিকে তাকালে মনে হয় আমি বুঝিবা Wrong person in the wrong place.
    তৌহিদ, দারুণ অনুভূতি ফুটিয়ে তুলেছ ভাই। আরও প্রকাশের অপেক্ষায় থাকলাম।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    টম হ্যাংকস এর রোমান্টিক ছবি গুলো দেখার সময় খুব ইচ্ছা করে কাউকে খুব ভালবাসতে...আফসোস, এখন পর্যন্ত কোন মেগ রায়ান পাইলাম না... :bash:

    দোস্ত, তোর লেখা দৌড়াইতেছে... :clap:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. সামিয়া (৯৯-০৫)

    এরিক মারিয়া রেমার্ক একজন অসাধারণ লেখক, থ্রী কমরেডস পড়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবছিলাম এইরকম বন্ধু কখনো পাব কি?...বা এরকম কোন মানুষ?
    অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ণ ফ্রন্ট...নিয়ে বলার মত যোগ্যতাও কখনো হবে না আমার...এই বইগুলো আমাকে সুখী হতে সাহায্য করেছিল ভীষণ...কারণ আমি তখন জানতাম যে দুঃখের তীব্রতা কতটা তীব্র হতে পারে, যার পাশে আমাদর জীবনটা সুখের সাগর প্রায়।
    তৌহিদ ভাই আপনি ব্ল্যাক ওবেলিস্ক না পড়লে পড়ে নিয়েন, এটাও সেরকম একটা বই।

    জবাব দিন
  4. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)
    ....টম হ্যাংকস এর জাদু দেখার সৌভাগ্য হয় বের হওয়ার পর । ফরেস্ট গাম্প , গ্রিনমাইল , কাস্ট অ্যাওয়ে… দেখার পর প্রতিবার ই নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়েছে , অদ্ভুত অদ্ভুত । তবে তার মধ্যেও ফরেস্ট গাম্প মুভিটা অনবদ্য । এতো নিখুত ভাবে কিভাবে আমাদের চারপাশের সবচেয়ে অবহেলায় দেখা চরিত্র মেলে ধরা সম্ভব……। সবশেষে জেনির মৃত্যুতে প্রচন্ড কস্ট পেয়েছি। সারাজীবনের ভালো্বাসাও মৃত্যুকে একটু দেরি করিয়ে দিতে পারেনা। তাই টম হ্যাংকস এর মত আমিও কনফিউসড, জীবনটা কি সত্যিই উদ্দেশ্যহীন ভাবে ভেসে বেরানো পালকের মত নাকি সব জীবনই একটি নির্দিস্ট দিকে এগিয়ে যায় ।

    দারুণ বলেছ। "ফরেস্ট গাম্প" নিয়ে আমার ভালোলাগা নিজের কাছেই বিস্ময় সৃষ্টি করে। ফরেস্ট গাম্প আমার সবচেয়ে প্রিয় মুভি আর টম হ্যাংকস প্রিয় অভিনেতা। "রোড টু পারডিশন", "দি টার্মিনাল", "সেভিং প্রাইভেট রায়ান" থেকে শুরু করে "ইউ হ্যাভ গট মেইল", "স্লিপলেস ইন সিয়াটল" প্রতিটাতেই ভালোলাগা উত্তরোত্তর বেড়েছেই।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  5. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    আমি আরো দুইটা বই এর নাম বলব। এক হল ইস্পাত আর হল মা। দুটাই প্রথম ধরেছিলাম কম বয়সে। আমি ছোট বেলা থেকেই বই হাতে নিলেই পড়ি। কিন্তু কিছু বই পড়তে যে আসলেই বড় হতে হয় তা পরে বুঝেছি। মা আর ইস্পাত দুটাই রেখে দিয়েছিলাম কিছু না বুঝে। পরে বড় হয়ে দুটাই পড়েছি। সেইরকম দুটা বই।

    জবাব দিন
  6. হাসনাইন (৯৯-০৫)

    জীবনে যে অল্প কয়টা বই পড়ছি ক্যাডেট কলেজে না গেলে তাও পড়তাম না 🙁 ।
    একটু আগে কামরুল ভাইয়ের full metal jacket দেখলুম।
    সেইরকম... পুরা :gulli:
    দুইটা লাইন দিতাসি,
    "this is my rifle
    this is my gun
    .............."
    বাকি লাইন দুইটা দিলাম না। জানতে চাইলে দেইখখা নিয়েন। 😉

    forrest gump আমার খুবি প্রিয়। টম হ্যাংস এর প্রায় সব সিনেমাই ভাল লাগছে।

    তৌহিদ ভাই,
    আপনার লেখা পড়লে মাঝেমাঝে ভুলে যাই আপনি সামরিকবাহিনীতে
    আছেন। অনেক সাবলীলভাবে লিখেন ভাইজান। :clap: 🙂

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তৌহিদ (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।