আমাদের দেশের মায়েদের তুলনায় অধিক স্নেহ-প্রবণ মা কি আছে আর কোথাও? সন্তানের সামান্য অসুখ করলেও আমাদের মায়েরা রাতের পর রাত পার করেন নির্ঘুম কাটিয়ে। আর ছেলেদের প্রতি তাদের পক্ষপাত তো বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। ছেলেদের বেলায় তারা যথার্থই স্নেহান্ধ। অথচ একাত্তরে এই দেশেরই মায়েদের আত্মত্যাগের কাহিনী আজ অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। মনে হয় হাজারবার পড়ি, মনে হয় সারাবিশ্বকে যদি জানিয়ে দিতে পারতাম যে আমাদের মায়েরাও পারে! এই দিনে শতবার পড়া ও জানা সেই মায়েদের গল্পই করবো।
সেলিনা হোসেন এর হাঙর নদী গ্রেনেড উপন্যাস থেকে নেয়া। এক মায়ের একমাত্র সন্তান প্রতিবন্ধী। স্বামী নেই তার। ওই সন্তানই তার যক্ষের ধন। যুদ্ধের ডামাডোলে একদিন তার ঘরে আশ্রয় নিলো দুজন মুক্তিযোদ্ধা। মা পরম মমতায় দেশের সূর্য সন্তানদের খাওয়ালেন, এরপর মাতৃস্নেহের আবেশে ঘুমিয়ে গেলেন মুক্তিযোদ্ধারা। রাজাকারদের সহায়তায় বাড়ি চিনে শেষ রাতে মায়ের জীর্ণ কুটিরটি ঘিরে ফেললো পাক হানাদাররা। ঘরে ঢুকেই মায়ের কাছে তারা জানতে চাইলো ”মুক্তি কাহা হ্যাঁয়?” মা দেখলেন এদেশের সোনার ছেলেদের বাঁচাবার আর কোনো পথই নেই। তখন আমার সেই মা, আমাদের মা, স্নেহান্ধ(?) মা হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন তার বুকের মানিক যক্ষের ধন প্রতিবন্ধী ছেলেটিকে। মুহূর্তের মধ্যে ছেলেটিকে বাড়ির পাশের গাছের সাথে বেঁধে গুলি করে মেরে ফেললো হানাদাররা। বেচে গেলো মুক্তিযোদ্ধারা। মৃত ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আমার মায়ের সেই কান্নার জলে পবিত্র আমাদের এই স্বাধীনতা।
মাগো তুমি কি করে পারলে?
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। টগবগে যুবক ছেলে রুমী, যার দিকে তাকিয়েই বুক ভরে যায় মায়ের, তুখোড় ছাত্র রুমী, তুখোড় বক্তা রুমী, স্কলারশিপ নিয়ে কয়েকদিনের মাঝেই বিদেশে যাবে যে আদরের ধন, সেই ছেলেই মায়ের কাছে যুদ্ধে যাবার অনুমতি চেয়ে বসলো!! পুরো জীবনটাই তো ওর সামনে পড়ে আছে ! মায়ের বাধ্য ছেলে মায়ের বিনানুমতিতে যুদ্ধে যাবেনা। কি করবেন স্নেহময়ী মা?? কি করে ঠেলে দেবেন বুকের মানিককে ওই মৃত্যুর হাতছানির মাঝে? মা বাকরুদ্ধ। অবশেষে দেশের টানে অনুমতি দিলেন আমার সেই স্নেহময়ী মা, যেই মা ছেলেকে না দেখে দুদণ্ড থাকতে পারেন না সেই মা! মা বলেছিলেন ”যা, তোকে দেশের জন্যে কুরবানি করলাম”…………!!! রুমী ফিরে আসেনি যুদ্ধ শেষে…………মাগো তুমি কি করে পারলে?
আজাদের মা। বিখ্যাত ও বিত্তশালী স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে না পেরে এক কাপড়ে একমাত্র ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে এলেন ঘর ছেড়ে, বলা ভালো রাজপ্রাসাদ ছেড়ে, যে ঘরে তিনি ছিলেন রাজেন্দ্রাণীর মত, এমনকি স্বামীর দ্বিতীয় দ্বার পরিগ্রহণের পরেও। কিন্তু আমার মায়ের আত্মসম্মানবোধ এতো ঠুনকো নয়। এক কথায় বিসর্জন দিলেন সকল বিলাস ব্যসন। একমাত্র ছেলে, বুকের মানিক সাত রাজার ধন আজাদকে পড়াশোনা করালেন নিজ পরিশ্রমে, নিজ সঞ্চয় থেকে ব্যয় করে। ছেলে যখন লেখাপড়া প্রায় শেষ করে ফেলেছে, যখন আমার মা একটু সুখের স্বপ্ন দেখছেন তখনই দেশ মায়ের বুক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো হায়েনার ছোবলে। সোনার ছেলে আজাদ, মায়ের চোখের মনি আজাদ মায়ের অনুমতি নিয়েই যুদ্ধে গেলো। যুদ্ধের দিনগুলিতে মা পরম মমতায় তার মুক্তিযোদ্ধা ছেলে আর তার সহযোদ্ধাদের খাওয়াতেন, বিপদ উপেক্ষা করে নিজ বাড়িতেই তাদের যক্ষের ধনের মত আগলে রাখতেন।
কিন্তু মা আর তার ছেলেদের ধরে রাখতে পারলেন না। একদিন ঘৃণ্য রাজাকাররা পাক সেনাদের দেখিয়ে দিলো বাড়িটি, মায়ের চোখের সামনে দিয়ে তারা ধরে নিয়ে গেলো তার বুকের মানিক সহ সব মুক্তিযোদ্ধাকে।
এরপর দিন যায়, মায়ের পৃথিবী আঁধার হতে থাকে। অবশেষে একদিন ছেলেদের খোঁজ পাওয়া যায়। মা থানায় ছুটে যান। আহারে, বুকের মানিকের কি হাল! সারারাত মেরেছে সবাইকে। ছেলে উঁহ করলে যে মায়ের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় সেই মা কি করে ছেলেকে এই অবস্থায় দেখেন! কি করে সহ্য করেন! এটাই শেষ নয়, এরপরই আর এক অগ্নিপরীক্ষার সামনে পড়েন আজাদের মা। তাকে বলা হয় তার ছেলে যদি সব মুক্তিযোদ্ধার নাম ধাম বলে দেয় তবেই সে মুক্তি পাবে। কিন্তু গোঁয়ার ছেলেকে শত অত্যাচারেও টলানো যাচ্ছেনা । তার এক কথা, শুধু মা যদি বলে তবেই সে বলবে সব । শুধু মা যদি বলতে বলে!! মুক্তি!! আহারে, তার বুকের মানিক ফিরে আসবে তার কোলে!! শুধু তিনি সম্মতি দিলেই!
পরক্ষণেই শক্ত হয়ে যান আজাদের মা। তার ছেলে দেশের সূর্য সন্তানদের সাথে বেইমানী করবেনা ।পাথরে বাঁধেন বুক। কোথায় পেলে সেই পাথর তুমি মা? তুমি কি বাংলাদেশের মা? তুমি কি আমারই মা!! তিনি ছেলের সামনে যান। ছেলে মায়ের সৌম্য মূর্তি দেখে বুকে বল পায়। “মা আমি কি করবো? বলে দেবো সব? তাহলেই নাকি ছেড়ে দিবে। তবে যদি শুধু তুমি বল মা, শুধু তুমি যদি বল”। শুধু মায়ের অনুমতি পেলেই ছেলের মুক্তি মিলবে এই নরকপুরী থেকে! মুহূর্তের জন্য কেঁপে ওঠে স্নেহময়ী মায়ের হৃদয়। মুহূর্তের জন্যেই। “শক্ত হয়ে থাক বাবা, কিচ্ছু বলবি না”( এই লাইনটি পড়ার সময় আমি কখনোই অশ্রু সংবরণ করতে পারিনা, লেখার সময়েও পারিনি) । মায়ের বুক তখন ছুরির ফলায় ক্ষতবিক্ষত। আজাদ কিছুই বলবে না। মা বলেছে।
“মা, ভাত খেতে ইচ্ছে করে, এরপরে আসলে ভাত নিয়ে এসো”। মা কথা দেয়। ভাত নিয়ে আসবে। বিচ্ছেদ ঘটে মাতা-পুত্রের। ছেলের সামনে মা চোখের জলটুকুও ফেলতে পারলেন না! কি করে পারলে তুমি মা? কী করে? বাড়িতে এসে তখন থেকেই মা রান্নার জোগাড় করতে লেগে যান। ছেলে ভাত খেতে চেয়েছে। সারারাত ধরে মা আমার রাঁধেন। ছেলেকে ভাত না খাইয়ে দেয়া পর্যন্ত তিনিও তো খেতে পারেননা। আহারে মা! পরের দিন জেলগেটে গিয়ে আর আজাদের দেখা পাননি । দিনের পর দিন তিনি ভাতের কেরিয়ার হাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন বিভিন্ন থানার সামনে। ছেলে তার ভাত খেতে পারেনি। তিনিও আর ভাত খান না । ছেলে তার কথায়ই মুক্তি পেতে পারতো। কিন্তু মা তো আমার সারা দেশের মা। তিনি তাঁর সাত রাজার ধন বুকের মানিককে উৎসর্গ করলেন।
আজীবন ভাত মুখে তোলেননি শহীদ আজাদের মা।পরবর্তী ১৪ বছর শোননি বিছানায় । শীত কিংবা গ্রীষ্ম, মাটিতে কেবল মাদুর পেতে ভূমিশয্যায় কাটিয়েছেন ১৪ টি বছর! ১৪ বছর পর ১৯৮৫ সালের ৩০ শে আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঠিক যেই দিনটিতে ধরা পড়েছিলো তার আজাদ।
মা তোমাদের লাখো সালাম…….।
:brick:
সি সি বি’র পোষ্টে ফার্ষ্ট ইটা ফেলাইল্লাম।
আনন্দে আরো দুইটা ফেলি। :party: :goragori: :goragori:
:brick: :brick:
এইবার যাই পইড়্যা আসি। 😀
যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ-তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।
জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি - ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে
- রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
চোখ ভিজে গেল......
........................
যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ-তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।
জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি - ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে
- রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
অসাধারন একটা লেখা ভাই, স্যালুট :salute: :salute: :salute:
আহা......
অসাধারণ লেখা ... ::salute:: (সম্পাদিত)
"Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
- A Concerto Is a Conversation
অসাধারণ একটা লেখা ::salute::
অসাধারণ লেখা।ভালো লাগলো পুরনো বই গুলোর কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য। একেকটি বই একেকটি জীবন্ত ইতিহাস।
::salute:: ::salute::
তাহসিন..............
দোস্ত তর লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করার মত দুঃসাহস আমি দেখাব না............
আমরা জানি তোর লেখা সম্পর্কে..........এবং বরাবরের মতই অসাধারণ ::salute::
একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার
ধন্যবাদ দোস্ত...
ধন্যবাদ দোস্ত...।।
এই ধরনের লেখা গুলো পড়লে চোঁখের পানি ধরে রাখা যায় না।
ভাই তুমি এটা কি লিখেছ? অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখেছি।
দোস্ত সেই ক্যাডেট কলেজ থেকেই তোর লেখার ফ্যান ছিলাম। তোকে সিসিবি তে পেয়ে অনেক ভাল লাগছে। আর আগে আসলে তোর আর ভাল ভাল লেখা গুলি পেতাম...।
কাদায় দিলি তো দোস্ত। অনেক দিন পর আম্মুর জন্য কাদলাম। যেই ভাবে ক্যাডেট কলেজে বেড কাভার মুড়ি দিয়ে আম্মুর জন্য ,বাসার জন্য চোখের পানি ফেলতাম সেই ভাবে।
মাগো অনেক ভালবাসি তোমায়......।।
জানি সত্য নয়,শুধু কল্পনায়...ইচ্ছের ঘুড়ি আমরা ওড়াই...স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে তারি অপেক্ষায়
“শক্ত হয়ে থাক বাবা, কিচ্ছু বলবি না”
জানি সত্য নয়,শুধু কল্পনায়...ইচ্ছের ঘুড়ি আমরা ওড়াই...স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে তারি অপেক্ষায়
::salute::
জানি সত্য নয়,শুধু কল্পনায়...ইচ্ছের ঘুড়ি আমরা ওড়াই...স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে তারি অপেক্ষায়
আহারে মা! পরের দিন জেলগেটে গিয়ে আর আজাদের দেখা পাননি । দিনের পর দিন তিনি ভাতের কেরিয়ার হাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন বিভিন্ন থানার সামনে। ছেলে তার ভাত খেতে পারেনি। তিনিও আর ভাত খান না । ছেলে তার কথায়ই মুক্তি পেতে পারতো। কিন্তু মা তো আমার সারা দেশের মা।
জানি সত্য নয়,শুধু কল্পনায়...ইচ্ছের ঘুড়ি আমরা ওড়াই...স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে তারি অপেক্ষায়
মৃত ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আমার মায়ের সেই কান্নার জলে পবিত্র আমাদের এই স্বাধীনতা।
::salute::
জানি সত্য নয়,শুধু কল্পনায়...ইচ্ছের ঘুড়ি আমরা ওড়াই...স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে তারি অপেক্ষায়