আজকের এই ব্লগটি আমি লিখবো ঠিক করেছিলাম খুব অদ্ভূত একটা মুহুর্তে। ১২/১২/১২ দিনটি নিয়ে সারা বিশ্ববাসী অনেক মাতামাতি করলো। এটি আমার জন্যও বিশেষ একটি দিন ছিল। আমার আমেরিকান সিটিজেনশীপের শপথ অনুষ্ঠান ছিল এই দিনে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি নিউইয়র্কে এসে খুঁটি গেড়েছিলাম। তখন আমি কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের প্রথম বর্ষে পড়ি। ইস, এখনো মনে করলে অবাক লাগে! স্বপ্নের মতো মনে হয় দিনগুলো। প্লেনের জানালা দিয়ে চোখের সামনে নিউইয়র্কের মাটি স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল। সুন্দর, সাজানো-গোছানো নিউইয়র্ক শহর। প্রথম internationally flying-এর অভিজ্ঞতা, তাও আবার সাত সমুদ্র, তের নদী পাড়ি দিয়ে। সব কিছু এতো দ্রুত ঘটেছিল যে আমার মনের আনন্দের চেয়ে চোখের বিষ্ময়টাই যেন বেশি ছিল।
অনেকেই হয়তো ইতোমধ্যেই ভাবছেন মাহমুদকে ছাড়া একা কিভাবে আমেরিকায় এসেছি, কি করতেই বা এসেছি। তাই নানা রকম ভণিতা না করে আমার আমেরিকায় আসার গল্পটা বলেই ফেলি- ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ে ভির্তির কিছু জরুরী কাগজপত্র ফটোকপি করতে গিয়েছিলাম নীলক্ষেতে এক ফটোকপির দোকানে। সেখানে দোকানী মামা জিজ্ঞেস করলেন ডিভি ফরম কখনো পাঠিয়েছি কি না। সত্যি বলতে কি, ডিভি লটারী ব্যাপারটা সম্পর্কে আমার কোন স্পষ্ট ধারণাই তখন ছিল না। শুধু জানতাম লোকজন ডিভি নিয়ে আমেরিকায় যেত। আমাকে ইতস্ততঃ করতে দেখে দোকানীমামা উৎসাহ দিতে বললেন যে, এটা খুব সামান্য ব্যাপার। শুধুমাত্র পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি আর ২০ টাকা লাগবে। আর একবার লটারী লেগে গেলেই স্বপ্নের দেশ আমেরিকা!ভাগ্যক্রমে পাসপোর্ট সাইজ ছবি সাথেই ছিল। দোকানীমামা নিজেই অনলাইনে আমার জন্য একটা ফর্ম ফিলআপ করে দিল মাত্র ২০টাকার বিনিময়ে। এরপর অনেকদিন পার হয়ে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা আর দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততার মাঝে ভুলেও গেছি এই ঘটনা। কিন্তু কিছু সাধারণ ঘটনা মানুষের জীবনে অসাধারণ হয়ে দেখা দেয়। আমার জীবন থেকেই আমি এই ফিলোসফী আবিষ্কার করেছি। ডিভি ফরমের কথা আমি ভুলে গেলেও সেই ফরম আমাকে ভোলেনি। প্রায় নয় মাস পর আমি কি যেন একটা ছুটিতে বাড়ি গেছি যশোরে। ভালো কথা, আমার বাড়ি যশোরে। সহজ ঠিকানা হলো- এক সময়কার দেশবিখ্যাত ‘মনিহার সিনেমা’ হলের উল্টো দিকে। সিসিবিতে যশোরের বা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কেউ থাকলে আওয়াজ দিবেন, প্লিজ। যাই হোক, আসল কথায় আসি।- প্রায় নয়মাস পর একদিন ডাক পিয়ন হঠাৎ একদিন আমাদের বাড়ি এসে কলিং বেল টিপে সুখবরটা দিল যে, আমার এক পা’ আমেরিকায়।- খুব সাধারণ একটা গল্প, কিন্তু যতদিন আমেরিকায় আছি, থাকবো, সব সময়ই মনে পড়বে।
বকবক করতে গিয়ে আমার নিউইয়র্কের গল্পের কথা ভুলেই গেছি। এখনো মনে আছে- সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখ। প্লেন মাটিতে নেমে আসছে, আমি প্লেনের জানালা দিয়ে মুগ্ধ হয়ে ম্যানহাটান সিটির দিকে তাকিয়ে আছি। দূর আকাশ থেকে দেখতে অনেকটা বাচ্চাদের লেগো খেলনা দিয়ে বানানো ঘরবাড়ির মতো মনে হয়। মনে মনে ভেবেছি, ইস, কয়দিন আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার আগে পড়েছি ম্যানহাটান হাডসন নদীর তীরে অবস্থিত। অথচ কে জানতো একদিন সত্যি সত্যি আমি হাডসন নদীর উপর দিয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসবো। অতঃপর Jfk এয়ারপোর্টে নামলাম। পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এবং ব্যস্ত এয়ারপোর্ট। সব কিছুই একটু একটু করে আমার বিষ্ময়কে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে, আর আমি শুধুই মুগ্ধ হচ্ছি। আমার সেই মুগ্ধতা আজও কাটেনি। আজ প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল এই প্রবাস জীবনে। পূব আর পশ্চিম মিলিয়ে অনেকগুলো ষ্টেট ঘুরে দেখেছি। প্রতিদিনই নতুন নতুন জিনিস দেখি, নতুন ভাষা শিখি, নতুন নতুন ভাবে মুগ্ধ হই।
আমি জানি, অনেকেই হয়তো ইতোমধ্যে ভাবতে শুরু করেছেন- তাহলে আমি কি বাংলাদেশে কোন কিছুই জানার সুযোগ হয়নি?বাংলাদেশের কোনকিছুই কি আমাকে মুগ্ধ করেনি? আসলে ব্যাপারটি ভিন্ন। বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি। এই দেশেই আমি বড় হয়েছি, পড়ালেখা শিখেছি, স্বপ্ন দেখা শুরু করেছি। আর আমেরিকায় এসে আমি সেইসব স্বপ্ন পূরণ করার রাস্তা খুঁজে পেয়েছি। তাই দুটো দেশ আমার মধ্যে ভিন্ন ভাবে জায়গা করে আছে। তাই আমি আমার বন্ধুদেরকে সব সময়ই বলি যে, বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি আর আমেরিকা আমার স্বপ্নভূমি। যাই হোক, অনেক গল্পের ভিড়ে আমার আসল গল্পটাই চাপা পড়ে গেছে। আজকে আমি বলতে চেয়েছি আমার আমেরিকান সিটিজেন হওয়ার গল্প। শপথ নেওয়ার গল্প। সিসিবিতে যারা আমেরিকাবাসী আছেন, তারা সকলেই মোটামুটি আমেরিকান সিটিজেনশীপ নেওয়ার প্রসেসটা জানেন। কিন্তু যারা জানেননা, তাদের জন্য বলে রাখি- আমেরিকান সিটিজেনশীপ ৩/৪টা উপায়ে পাওয়া যায়, ডিভি লটারী ছাড়াও ফ্যামিলির মাধ্যমেও পাওয়া যায়। যে ক্যাটাগড়িতেই কেউ আসুক, আমেরিকাতে প্রথমে গ্রীন কার্ড নিয়ে তাকে পাঁচ বছরের মতো থাকতে হয়। এরপর সিটিজেনশীপ এবং পাসপোর্টের জন্য আবেদন করা যায়। আবেদনের প্রক্রিয়ায় প্রায় ৭/৮ মাস সময় লেগে যায়। যেমন, আমি আবেদন করেছিলাম জুলাইয়ে, আর সিটিজেনশীপের সার্টিফিকেট হাতে পেলাম ডিসেম্বরে। পাসপোর্ট হাতে পেতে আরো মাস খানেক সময় লাগবে। প্রত্যেক গ্রীনকার্ডধারীকে আমেরিকার ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, সংবিধান, আইনকানুন, ইত্যাদি বিষয়ের উপর একটা ম্পূখিক পরীক্ষা দিয়ে পাশ করতে হয়। এরপর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অধিদপ্তর থেকে ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর তাকে শপথ অনুষ্ঠানের জন্য একটা দিন ধার্য করে চিঠি দেয়। ১২/১২/১২ তারিখ ছিল আমার জন্য এই দিন। এই দিনে আমার সাথে Monteclair District Court-এ আরো প্রায় তিন হাজার অভিবাসী আমেরিকান সিটিজেন হিসেবে শপথ নিয়েছে।
পুরো শপথ আনুষ্ঠানটি ছিল সুন্দর করে সাজানো। এতোগুলো মানুষোকে একসাথে শপথ করানো এবং সার্টিফিকেট প্রদানের কাজটা বেশ ঝামেলাপূর্ণ, যেকোন সময় কারো না কারো ভুল হতে পারতো। কিন্তু আগে যেমন বলেছিল যে, আমেরিকায় আমি প্রতিদিনই নতুন কিছু দেখ, শিখি, শপথ গ্রহন করতে গিয়েও এর অন্যথা হয়নি। এখানেও ওদের নির্ভূল, সাজানো-গোছানো ম্যানেজমেন্ট দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এতো বেশি সিষ্টেম্যাটিক এবং সচেতন ওরা যে, ভুল হওয়ার কোন সম্ভাবনাই রাখেনি। আমাদের সকলকে একটা বিশাল কনভেনশন রুমে সারি ধরে দাড় করিয়ে প্রথমে একজন জাজ আমেরিকান নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে কিছু ছবক দিল। অতঃপর অডিওতে ছেড়ে দিল আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত ‘Star spangled the banner’সকলেই বুকের বাম পাশে হাত রেখে দুলে দুলে গাইল সেই গান। সত্যি বলতে কি, এর আগে আমেরিকার জাতীয় সংগীত শোনা হয়নি। তাই মিনমিন করে ‘আমার সোনার বাংলা’ই গেয়ে দিলাম। এরপর স্ক্রীনে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওবামা’র বক্তৃতার ভিডিও ছেড়ে দিল। তিনিও আমাদেরকে আমেরিকার সিত্যিকার নাগরিক হওয়ার অর্থ বিষয়ে জ্ঞানদান করলেন। তার ভাষণ শেষ হলে জজ সাহেব আমাদেরকে নবজাত আমেরিকান হিসেবে অভিনন্দন জানালেন। আশেপাশে মানুষের সে কি উচ্ছ্বাস, মাতামাতি, হাততালি! মুহূর্তের মাঝেই কনভেনশন সেন্টার শোরগোল আর হাততালিতে ভরে উঠল আমাএরিকান হওয়ার আনন্দে।
তবে সত্য বলতে কি, আমেরিকান শব্দটায় আমার বিশেষ একটা আপত্তি আছে। যদিও মহান প্রেসিডেন্ট সাহেব বলেছেন যে, আমেরিকানরা জাতি হিসেবে পৃথীবির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, ‘আমেরিকান’ বলে কি আসলেই কোন এথনিক (Ethnic) গোষ্ঠি আছে? – আমি নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী। তাই যখনই ethnicity, nationality সম্পর্কিত কোন কিছু শুনি, আমার কান সতর্ক হয়ে শোনে। আমার মাথায় গিয়ে টিকটিক করে জানান দেয় শব্দটি কতখানি যুক্তিযুক্ত বা গ্রহনযোগ্য। আমেরিকান হওয়ার শপথ নেয়ার পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে একটু বেশি বেশি ভাবছি। যাই হোক,আজ আর এই নিয়ে প্যাচাল পাড়বো না। এই আলোচনা শিকেয় তুলে রাখলাম অন্য আরেকদিনের জন্য।
ঝরঝরে লেখা। :clap:
ধন্যবাদ ভাইয়া 🙂
🙂 🙂 :clap:
এইবার ডুয়াল ন্যাশনালিটি নিয়েনেন ... সুযোগ যখন আছে ...
ইফতেখার ভাই, আপনার মতো অনেকেই আমাকে এই বুদ্ধি দিয়েছে...ইচ্ছা আছে ,দেখা যাক!
দুই তারা কে দিলো?
তাও আবার অতিথির লেখায়!
দুঃখ পাইলাম।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
রাজীব ভাই,
এত দুখ পেয়ে লাভ কি..গত এক বছর ধরে সিসিবি তে লিখছি, আর সিসিবি তে লেখা পড়ি তারো অনেক আগ থেকে...কতো দিন আর আতিথির খাতায় নাম থাকে বলেন... 😛 😛 😛
:teacup:
চা খান তাইলে ভাবী।
এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ
🙂 🙂 🙂
ভাবী আমি ফাঁচ তারা দাগায়ালচি 😀
কিন্তু গড়ে চাইরখান অইয়া আছে 🙁
MH
মাজহার ভাই,
বেপার নাহ...ভুল করে মিস্টেক সবাই করে... 😛
😛
ভাবী, আমারো "ম্যারিখা" যাইতে মন চায় 😀
MH
চইলা আসেন...সিরিয়াসলি... 🙂
না ইয়ে মানে টিকিট টা 😀
MH
=)) =))
MH
🙂
অভিন্দন রইল - আরো বেশী এই কারনে যে তুমি যশোরের মেয়ে তাই।
ভাইয়া ও এলাকার ইজম করেন। 😛
ভাবী, লেখাটা ভাল লেগেছে। 🙂
শাহাদাত ভাই,
খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও এলাকাইজম করে আর আমরা তোহ নবজাত ছিঃটিজেন...হি...হি... 😛 (সম্পাদিত)
সাইফ ভাই,
যাক এতদিনে আমি একজন এলাকাবাসি খুঁজে পাইলাম... 🙂
অনেক ধন্যবাদ কমেণ্ট এর জন্য...।
পড়ে ভাল লাগল। গোছান লিখা।
What we do in life echos in eternity.
থ্যাংকু ভাই... 😀 😀 😀
আপু আপনার বাড়ির পাশের এলাকায় থাকি,যশোর ফায়ার ব্রিগেড এর কাছে,,,,,,,ইচ্ছা ছিল ডিভি ফর্ম ফিল আপ করব কিন্তু ডিভি এখন বন্ধ করে দিসে আমেরিকা বাংলাদেশি দের জন্য,,,,,,,,