পরদিন ভোর বেলায় উঠে সবাই গেলাম কাঞ্চনজঙ্গা’য় সূর্যোদয় দেখতে। ‘টাইগার হিল’ থেকে সবচেয়ে ভালো ভাবে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্গা’র চূড়া। মাইনাস ৪/৫ তাপমাত্রায় ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠে টাইগার হিল যাওয়ায় সময় মনে হচ্ছিলো এবস্যালুটলি রঙ ডিসিশান। আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে একটা জীপ নিয়ে সবাই পৌছে গেলাম ‘টাইগার হিল’। আমাদের মতো আরো অনেক ট্যুরিস্ট অপেক্ষা করছে সেখানে। প্রচন্ড শীতে অনেকেই কাহিল। আগুন গরম চা খাচ্ছি একের পর এক, কিন্তু লাভ হচ্ছে না। এদিকে মাফলার ছাড়া কামরুলের অবস্থা খুব খারাপ। সমানে সবাইকে গালাগালি করছে। কিন্তু যখন ভোরের কুয়াশা আর মেঘের চাদর সরিয়ে আস্তে আস্তে কাঞ্চনজঙ্গার পিছন থেকে সূর্য উকি দিলো তখন মনে হলো এই দৃশ্য দেখার জন্য এমন কষ্ট কিছুই না। পুরো পাহাড়টা একটু একটু করে চোখের সামনে সোনালী হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে যেন আসলেই পুরো পাহাড়টা স্বর্ণের। তখন বুঝলাম কেন এর নাম কাঞ্চনজঙ্গা।
ফটাফট ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলতে লাগলো। নানান পোজে, নানা এঙ্গেলে। একবাক্যে সবাই স্বীকার করলো এখন মরে গেলেও কারো কোন আফসোস থাকবে না। অবসাদ আর ক্লান্তি সরে গিয়ে সবার মধ্যে একটা চনমনে ভাব চলে এলো। আরো কয়েকদফা চা শেষ করে ঠিক করলাম বাকি কিছু জায়গা ঘুরে দেখা।
প্রথমেই ‘গঙ্গামায়া’ পার্ক। তারপর যাবো ‘রক গার্ডেন’ ‘বাতাসিয়া লুপ’ আর ‘ঘুম মন্সট্রি’। সঙ্গে আনা সিগারেটের স্টক ফুরিয়ে গিয়েছিলো। বাংলাদেশ থেকে কয়েক কার্টুন বেনসন নিয়ে গিয়েছিলাম। এতোদিন এটাই চলছিলো। এবার দার্জিলিংয়ের একটা দোকান থেকে উইলস ফিল্টার কেনা হলো। দাম প্রতিটা চার রুপি করে কিন্তু কোয়ালিটি বেনসনের ধারে কাছেও না। কিন্তু এখন সেটাই খেতে হবে, কিছু করার নেই। কলকাতায় দেখেছি বেনসন আছে প্রায় সব দোকানে। কিন্তু দার্জিলিংয়ে বেশ কয়েকটা দোকান খুঁজেও বেনসন পেলাম না।গঙ্গামায়া হচ্ছে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা একটা ঝরনা আর তার চারপাশের বিশাল বিশাল পাথর নিয়ে সাজানো একটা পার্ক। এ জায়গাটা নিয়ে একটা হিন্দু মিথ আছে, লোকমুখে শুনলাম। শিব ঠাকুর মহাদেব নাকি পার্বতীর অপমান সহ্য করতে না পেরে তার দেহ ব্যবচ্ছেদ করে মর্ত্যলোকে ছিটিয়ে দিয়েছিলেন।
তখন পৃথিবীতে ব্যাপক ভু-আলোড়নের সৃষ্টি হয়। ঠিক তখন একটা পাথর গড়িয়ে আসে এইখানে , গঙ্গামায়া’য়। ঝর্নাটা নাকি সৃষ্টি হয়েছিলো সেই পাথর গড়িয়ে আসার সময়। পাথরটা দেখে অবাক হলাম। প্রায় দশতলার সমান উঁচু। সেখানে গাছের গুড়িতে ছোট এক মন্দিরে এখনো মহাদেবের পুজো হয়। মিশেল আর কামরুল সেখানে দশরুপি দক্ষিণা দিয়ে পুজো দিলো, তারপর মাথায় সিঁদুর চরালো।‘গঙ্গামায়া’তেই ট্যুরিস্টদের জন্যে গুরখা আদিবাসীদের নাচ দেখার ব্যাবস্থা আছে। আমরা গেলাম সেই গুরখা নাচ দেখতে। গানের তালে তালে নানান রঙ্গে সেজে নাচ করছে একদল আদিবাসী ছেলেমেয়ে। দারুণ মনোমুগ্ধকর। দূর থেকে ইশারা করে কামরুল একটা গুরখা মেয়ে কে দেখালো।
বুঝলাম, বরাবরের মতো ও এই মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছে। বারবার ঘুরে ফিরে সেই মেয়ের ছবি তুলছে। নাচ শেষ হবার পর গেলো সেই মেয়ের সাথে কথা বলতে , কিন্তু আফসোস, সেই মেয়ে বাংলা-ইংরেজি জানেনা, আর কামরুলও গুরখা ভাষা বুঝে না। বিরস মুখে ফিরে এসে দেখি বারবার ক্যামেরায় সেই মেয়ের ছবি দেখছে।সেখান থেকে ‘রক গার্ডেন’ গেলাম। শিবের সর্প আস্তানা। এ গুহাতে নাকি শিব ঠাকুর গায়ে সাপ পেচিয়ে বসবাস করতেন। সেই গুহা এখনো এখনো দেখলে ভয় লাগে। তারপর জীপে করে ‘সেন্ট জোসেফ কলেজ’ যেখানে শাহরুখ খানের ‘ম্যায় হু না’ সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিলো।
তবে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে ‘বাতাসিয়া লুপ’। ঠিক এই রাস্তায় রাজেশ খান্না আর শর্মিলা ঠাকুরের ‘মেরি স্বাপ্নো কি রানী কাব আয়েগি তু’ গানের পিকচারাইজেশন হয়েছিলো। কতবার যে এই গান দেখে মনে মনে নিজেকে রাজেশ খান্না ভেবেছি আর মনে মনে আমার শর্মিলাকে বলেছি ‘মেরি স্বাপ্নো কি রানী কাব আয়েগি তু’। অবশ্য বছর তিনেক পরে ঠিকই শর্মিলাকে পেয়েছি ।সেখান থেকে ‘ঘুম মন্সট্রি’ । তারপাশেই এক বোদ্ধ মন্দির আছে, সেখানে এক বিশাল ঘন্টা। মন্দিরের আশেপাশের লোকজনের দাবি সেই ঘন্টা বাজিয়ে মনে মনে কিছু প্রার্থনা করলে তার সে ইচ্ছা পূরণ হয়। শুনে জাকারিয়া গেলো সেই মন্দিরে ঘন্টা বাজাতে। ফিরে আসার পর মনে মনে কি চাইলো জিজ্ঞেস করাতে ও কিছু বলে না। কিন্তু বছর না যেতেই সেনাকুঞ্জে বিয়ের দাওয়াত আর তারপর আবার বছর না ঘুরতেই ফুটফুটে ভাস্তির মুখ দেখার পর জাকারিয়ার সেদিনের প্রার্থনা বুঝতে আমাদের একটুও কষ্ট হয় না।
সারাদিন ঘুরেই কাটলো। মাঝে শুধু লাঞ্চ সেরে নিয়েছিলাম একটা হোটেলে। বিকেলে চৌরাস্তায় ফিরে আরো একদফা কিং ফিশার। সন্ধ্যায় নাইটিঙ্গেল পার্ক বলে একটা জায়গা আছে সেখানে আবারো নেপালি গুরখা নাচ দেখতে গেলাম। এবারের নাচটা শিব ঠাকুরকে উৎসর্গ করে। অপুর্ব দৃশ্য। মালভুমির একটা জায়গায় পার্কটা বানানো। সেখানে খোলা জায়গায় একটা নাচের বেদি আর দর্শকদের বাসার জায়গা ঠিক শিব মন্দিরের সামনে। সিংহাসনের মতো। অন্ধকার ঘনিয়ে আসা লাল-নীল আলোয় সেই নাঁচ দেখতে দেখতে নিজেকে কিছুক্ষণের জন্যে যেন শিবঠাকুর মনে হচ্ছিলো। তখনই ঠিক করে ফেললাম পার্বতীকে নিয়ে এ নাঁচ আবার দেখতে হবে।
তারপর প্ল্যান হলো সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখা হবে। সঞ্জয় দত্তের ‘জিন্দা’। সিনেমার পর্দা দেখে টাশকি মেরে গেলাম। বিশাল পর্দা। সিনেমা হলটাও দারুণ। সিটগুলি এমন, বলতে গেলে একেবারে শুয়ে শুয়ে সিনেমা দেখা যায়। ছবিটা ফালতু ছিলো, কিন্তু তাতে আমাদের কোন আফসোস নেই। আমরা সিনেমা হল দেখেই মুগ্ধ হয়ে ফিরে এলাম।
রাতে হোটেলে ফিরে জম্পেশ আড্ডা হলো। কোরিয়ান ছেলেগুলো আমাদের হোটেলে আসলো। এবার আমাদের আপ্যায়নের পালা। প্রচুর ঘুরাঘুরি করে আমাদের বাজেট প্রায় শেষের দিকে। তাও সাধ্যের মধ্যে যা ছিলো তা দিয়েই বিয়ার কেনা হলো। ভাগাভাগি করে সেই বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে যখন ওরা শুনলো আমরা আগামীকাল চলে যাবো , তখন ওদের খুব মন খারাপ হলো। দু’দিনের পরিচয়েই ওদের সাথে বেশ জমে গিয়েছিলো। আমাদেরও ফিরে আসতে ইচ্ছে করছিলো না। কিন্তু সাধ আর সাধ্য সব সময় মানুষের অনুকূলে থাকে না। আমাদের কাছে তখন শুধু ঢাকা পর্যন্ত ফেরার খরচটুকু আছে।
সুতরাং এ যাত্রায় বিদায় দার্জিলিং।
দুইটা ক্যামেরায় প্রায় হাজারখানেক ছবি, মনের মধ্যে অগুনতি স্মৃতি নিয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম।
:awesome:
:awesome: এই টা দেখলেই আমার খালি হাসি আসে।
২য়
দার্জিলিং ভ্রমন আসাধারন হলো, এরপর আমরা কোথায় যাচ্ছি সুব্রত ভাই?
আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷
কই যাওয়া যায়,বলতো।
সুব্রত ভাই শর্মিলার ছবি চাই! :shy: :
তোমার বউদি আমারে ঠ্যাংগাইবো।মাইর খাওনের পায়তারা
আমিও দার্জিলিং যাপো 🙁 🙁 🙁
অসাধারণ ভ্রমন কাহিনী। আমি বেশ ঘরকুনো এখন এই কাহিনী পড়ে মনে হয় দার্জিলিং না যেয়েই সবাইকে দার্জিলিং গিয়েছিলাম বলে গল্প শুনাতে পারব ।
😮 😮 😮
সামি তুমি ঘরকুনো?!
কই যেন থাক শুনছিলাম, তোমার বউ যেন কই থাকে............।। 😕
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
ফয়েজ ভাই এখন কানাডায় আছি কারণ বউ এখানে পড়তেছে, না আমি ঘরকুনো ঠিক না বরং আইলস্যা, এখন বউয়ের ধাক্কায় ঘুরাঘুরি অনেক করা লাগে।
@ সুব্রত যাবো রে ভাই দার্জিলিং একবার কিন্তু আপাততঃ তোমার কাহিনী আমার সম্বল
ভাবী রে নিয়া গুরখা নাচ দেইখেন সন্ধ্যার সময়।দারুন মজা পাইবেন।
তাও কস্ট করে বলবেন না যে একবার দারজিলিং যাবেন।আপ্নি তো ভাই মহা ডজার।
:))
ভ্রমনকাহিনীর শেষে আমার সবসময়ই মনটা খারাপ হয়ে যায়।
আমি দার্জিলিং গিয়া ছিলাম ২০ ঘন্টা মাত্র। তোরা কার্সিয়াং এ মনে হয় থাকোস নাই। ওইটাও জটিল একটা শহর। শিলিগুড়ি আর দার্জিলিং এর মাঝখানে। আমি এক রাত ওইখানে ছিলাম
রবিন,তুই তো যাস সব মাগুর মাছ লইয়া।২০ ঘন্টায় হিসাব কোনোমতে শেষ কইরা ্দে ছুট।
:khekz: :khekz:
বরাবরের মতই যেন পড়তে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া আর অজানা গুরখা মেয়ের মুখচ্ছবি। চমতকার ভাইয়া। :clap: :clap:
আমি তবু বলি:
এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..
সারাটা রাত পর তোমার এই কমেন্ট পেয়ে ভাল লাগছে।কমেন্ট দেখার জন্য জেগে রইলাম।
ইশ শেশ হোএ গেলো.......।
ইস, শেষ করে ফেল্লা? দূর, তুমি যে কিনা
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
আর তিন দিনের কাহিনি ছিল।সুইযারলান্ডে বড় ভাইরে ফোন করে টাকা আনিয়ে আমি,মাসুদ আর শোয়েব আরো তিনদিন থেকে আসছিলাম।মিরিক এর কাহিনি তো লিখিই নাই,বস।
এই গুলাও লিখে ফেল। আর অল্প কথায় অনেক কিছু বলে ফেল তুমি, এটা একদিক দিয়ে ঠিক আছে, কিন্তু তোমার বর্ননা পড়তে আরাম লাগে, একটু বড় করতে পার কিনা দেখ। 🙂 মজা করে পড়ি।
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না
লিখব ফয়েজ ভাই।
এইবার "চলবে নাকি?"
নাই বইলা সুব্রত-র
:frontroll: চলতে থাকুক।
:hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:
:frontroll: দিতেই আছি নুপুরদা।
অসম্ভব ভাল লিখসেন :boss: :boss: মনে হচ্ছে এখনই কোলকাতা, দার্জিলিং ঘুরে আসি :dreamy: :dreamy:
অসম্ভব ভাল লিখসেন :boss:
কাউরে যে গল্পটা বলবো তাও পারতেসিনা :(( :((
সবসময় ক্যাডেটদের সাথে থাকি গুল মারলেই ধরা 😛
আর সিভিল ফ্রেন্ড নাই 🙁
টাইগার হিলের উপরে ছবিটাতে দেখলাম প্রায় সবার ই মাফলার আছে 😀
হ ভাই।ঠীকী কইছ।
দোস্ত, খুবই সুন্দর হইছে তোর এই ভ্রমণ পর্ব! :boss: :boss:
পরের বার তোরা কোথাও গেলে আমারেও নিয়া যাইস্!
আহ! আবার যাইতে ইচ্ছা করতেছে। 😀
---------------------------------------------------------------------------
বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।
খুব ভালো লাগলো পরে.asha rakhchi দিতীয়বার হানিমুন এ দার্জিলিং যাব.কান্চন্ঝন্গ্ঘা না দখলে নাকি জীবন তাই অসম্পূর্ণ aথাকে যায়.সোনালী মুকুট পরা ওই পাহাড় যেন অপুরূপ মহিমায় ডাকছে.সেই সুধা obosyoi সবারই দৃষ্টিপান করা uichit.
ভাই আপনাদের ভ্রমনের দিন এবং খরচ কত ছিল জানালে উপকৃত হবো