শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলাম মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, টাংগাইল থেকে। টেক্সচুয়ালি ভাল থাকলেও, বাহ্যিক সাধারন জ্ঞান কম থাকার কারনে সবাই একটু বাঁকা চোখেই দেখত। আমার জেঠাত ভাই মলয় বেশ চালাকচতুর ছোটবেলা থেকেই। তাই যৌথ পরিবারে ওর দাপট ছিল খুব বেশি। মাছের মাথাটা দুপুরে স্কুল থেকে আসার পর মলয়ের পাতেই যেত। আজ সেই মলয়কে খুব মনে পড়ছে। তাই হঠাৎ ভাবলাম ওর কথাই লিখবো । ওর কিছু কিছু ঘটনা আজো আমার মনে পড়ে। ভাবলাম সবার সঙ্গে শেয়ার করি।
মলয় যেকোন ব্যাপারে খুব কিউরিয়াস ছিল। আমরা তখন খুব ছোট। এতই ছোট যে ইস্ত্রি কি জিনিস তাই চিনি না। একদিন আমাদের নিমু কাকার ঘরে একটা ইস্ত্রি দেখতে পেল মলয়। ওকে সবাই নিমু কাকার ঘরে যেতে মানা করত। কিন্তু ও নাছোড়বান্ধা। ও দেখেই ছাড়বে রুপলি চকচকে এত সুন্দর জিনিসটা কি। দুপুরবেলা সবাই যখন ঘুমে অচেতন ও লুকিয়ে লুকিয়ে নিমু কাকার ঘরে গেল। ইস্ত্রিটা দাঁড় করিয়ে রাখা। কেউ যেনো ইউজ করছিল। রুপোলি মসৃন রঙ দেখে মলয় হাত দিয়ে না দেখে ইস্ত্রি’র মসৃন পিঠে নাক দিয়ে ঘসা দিল। নাকের ডগায় সঙ্গে সঙ্গে ঠোসা পরে গেল। প্রচন্ড জ্বালা নিয়ে ও বেরিয়ে এলো এবং নাক থেকে হাত সরালো না বেশ কিছুদিন।
আরেকদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছি। খুব গরম পড়েছিল সেদিন। মলয় বললো, ‘চল তোর বাবার দোকান থেকে জল খেয়ে যাই।’ বাবা আমাদের দেখে প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে দোকান থেকে উঠে গিয়ে জলের সঙ্গে একটা সন্দেশও খাইয়ে বিদায় করলো। পরদিন আবার স্কুল থেকে ফেরার পথে মলয় আমাকে বললো, ‘সুব্রত, চল তোর বাবার দোকান থেকে জল খেয়ে যাই’ (আসলে সন্দেশের লোভে)।
বাবার কাছে জল খেতে চাইলাম। প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে বাবা বললো, বাসায় গিয়ে খা। আশেপাশের দোকানিরা হাসতে হাসতে শেষ।। আমি এতই বোকা ছিলাম যে তাদের হাসির কারন ওইদিন বুজতে পারিনি। মলয় আমাকে পরে বুঝিয়ে দিয়েছিলো।
এতো গেলো টুকটাক। একবার জেঠিমার (মলয়ের মা) একটা দামি ঘড়ি হারানো গেলো। যৌথ পরিবারে জিনিস হারানো গেলে খুব সমস্যা হয়। অনেক ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। জেঠিমা স্থির করলেন বাটিচালান হবে। কোথাকার কোন এমএসসি পাস একটা ছেলে নাকি বাটিচালান জানে। আমরা সবাই আতংকিত। কে ঘড়ি চুরি করছে সেটা জানা যাবে। যথারীতি সেই ছেলেকে ডাকা হল। সে এসে একটা বাটীতে কিছু চিনি নিল। নিয়ে কিছুক্ষণ ধ্যান করল। তারপর হঠাৎ বুক চাপড়াতে চাপড়াতে হাউ হাউ করে উঠল এবং মাটিতে পরে গেল আর বলতে লাগলো, ‘এই ঘড়ি খেলাছলে এমন এক জায়গায় গেছে সেখান থেকে আর কোনোদিন ফিরে পাওয়া যাবে না। ব্যস,তার বাটিচালান শেষ। তাকে টাকা দিয়ে বিদেয় করা হল। পরদিন সকাল বেলা মলয় ওর ঘরের বুক সেলফের পেছন থেকে ঘড়ি বের করে জেঠিমার হাতে দিল।
এই হল আমার এবং মলয়ের শৈশব।
এবার একটা মন খারাপ করা গল্প বলি। এবার দেশে যাবার পর একদিন বিকেল বেলা ঘুরতে বেরিয়েছি টাংগাইলে। একটা রিক্সা ডাকলাম। রিক্সাটা সামনে এসে দাঁড়ানোর পর রিক্সাওলার চেহারাটা ভাল করে দেখলাম। রিক্সায় ওঠার পর জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই তোমার নাম কি বোরহান?’ সে বললো, ‘হ্যা।’ আমি ওকে বলাম, ‘তুমি কি জানো যে তুমি আমার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে পড়েছি মডেল প্রাইমারি স্কুলে।’
ও বললো, ‘না, আমার মনে নাই। আমি আর বেশি কিছু বলি নাই। রিক্সাটা এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দুজনে চা, সিগারেট খেলাম। বাসায় একদিন নিমন্ত্রন করেছিলাম। কিন্তু আমার নিমন্ত্রন নিতে আপত্তি করল। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।
ক্ষণিকের ভালবাসা, ক্ষণিকের আবেগ মনের মাঝে কালবৈশাখী ঝড়ের সৃষ্টি করলেও, সামাজিক নিয়মগুলো তার গতি ভুল করে না। আমার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে সামজের এসব নিয়মের বেড়াজাল ভেঙ্গে ফেলতে, ছেলেবেলার বন্ধু বোরহানকে নিয়ে ঘুরতে , ঘন্টার পর ঘন্টা বসে তার সাথে আড্ডা দিতে।
কিন্তু পরক্ষণেই সম্বিত ফিরে পাই। যেতে হবে আরো অনেকদুর।
সাবলীল লেখা। :clap:
২য় 😀 😀
চমৎকার লেখা, শেষের টুকু মন খারাপ করে দেয় 🙁 🙁
ঐ। :no: :no: :no:
There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx
ঐ 🙁 🙁 🙁
ঐ...
খুব সুন্দর একটা লেখা। কিভাবে মিস করে গেলাম!
কঠিন বাস্তব 🙁
সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!
ভালো কইছেন।
🙁
আসলেই! 🙁 🙁