প্রবীণ ললাটে, কোরান মলাটে, বন্দী যে মহাকাল
রোদপোড়া দেহে তামাটে ভাঁজের বয়স আজ বারো সাল।
লাউয়ের মাচার তলেতে বিছানো হাতবোনা লাল পাটি,
বয়সী দু হাতে লেপে ছিমছাম প্রাচীন এই ভিটা মাটি।
দহল ছাড়ায়ে ছোট ডোবাখানি, ভরিছে কচুরিপানা
ধারে ওল কচু হাটেই বিকিয়ে সের-এ মেলে তেরো আনা।
চাননী রাইতে শিয়ালেরা মিলি রসুই ঘরেতে ঢুকে
এটা ওটা ছানে, নাক ঘষে ঘষে, ছালুনের হাঁড়ি শুকে।
বাড়ীতে খালি আর একজনই থাকে,বিড়াল,সে জাতে শিকারি
এ ঘরে ও ঘরে মেরে ফেলে থোয় তেলচুরা,চিকা, বাতারি।
কোনো কোনো দিন সখিনাও আসে, চালতা খাবার আশে
“দাদাজান” ডাকি ফাল দিতে দিতে চৌকিতে আসি বসে।
যুবতী মেয়ের অবুঝ আল্লাদে কলিজাতে মারে টান
যদিও আমার ঘোর দুশমন ওর দাদা হাজি চান।
আমারও এ ঘরে ছিল একজন,সখিনার মত মেয়ে
নিদ্রা যাইত মার লগে, পাড়া জুরানির গান গেয়ে।
ষোলতে পড়িয়া হাজিরই পোলার লাগি করি বিষপান
দুইদিন ভরে তরপায়ে মরে আদরের সন্তান।
উঁচার শিকাতে সানকি ঝুলেনা,হইয়াছে বহুদিন
বয়সের ভার,কোমর আর ঘাড়,বানাইছে বলহীন।
কুলায়না গায়ে তবু রোজদিন মুছি,লেপি,দেই ঝাট
হারাইছি যে কত! সাক্ষী শুধুই এ ঘরের চৌকাঠ।
অথচ এ ঘরে এমনও গিয়াছে উঠানে পাতিয়া কাথা
পূবের কুঠায় দশজন শুয়ে, বিয়ানে গতর ব্যাথা।
মেমানে ভরিয়া যাইত এ বাড়ী কোন ফুরসৎ এলে,
বন্দেবস্তে ব্যাস্ত হইতাম, আমি আর তিন ছেলে।
বড় ছেলেখান,আড়তেই বসে,তদারকি করে চাষ,
মেঝোটা তুখাড়, পুরা বংশেতে সেই খালি বিএ পাশ।
কয়দিন আগেই বড় বৌ-র পেটে আসিছে পয়লা নাতী
বেশতের ফুল ঝরিয়া হইবে এই বংশেরই বাতি।
সবার যে ছোট তারে নিয়া খালি রোজ হই পেরেশান
চারিদিক হইতে নালিশ শুনিয়া তব্দা গিয়াছে কান।
আদব কায়দা কিছুই মানেনা, পড়াতেও নাই মন
কারবারিতেও যাাবেনা এ জনমে এই করিয়াছে পণ।
তবু তিন ভায়ে এত মিলমিশ,দেখিয়াই সুখ পাই
যেই ঘর ভরা এত মব্বত,দুক্ষের নাই ঠঁাই।
কাচা পয়সায় সিন্দুক ভরা, ভরানি কলসী ঘটি
সামলায় রাখা, সুনার বাক্স , বাঘের ছালের চটি!
বিবি কেন তুমি বালাগুলি খুলি বাক্সেতে দিছো রাখি?
গাল টান দিয়া রঙ করে ডাকি, ”সোনার ময়না পাখি’।
এই দুই হাত মাটির গড়া না,তৈয়ার মাখনের
তুমি ঠঁাই দিলে খুশ-কিসমতি কারিগর কঁাকনের।
এই বয়সেও রংগ তামাশা, খাসিলত যায় নাই?
প্রশ্ন করিয়া মিছামিছি রাগে, বিবিজান চলে যায়।
চাষিরা যেমন দেখে হাসি উঠে ভরা সুতিয়ার পানি,
পীরিতে,সোহাগে,জ্বলে রোশনাই, ছোট্ট এ ঘরখানি।
কলবেতে ঢুকে ইব্লিশ ঠিকই খেলিলো নিঠুর খেলা
যার নিয়ামত,যে দিয়াছে সব, তাকে করে অবহেলা
কত জুমাবার আসি ফিরে গেছে শুকর গুজার ছাড়া,
মাগরেব হতে ফজর অক্ত ঘুমায়াই দিশাহারা।
সস্তা পীড়ানে ”ওলা বিবি” আসি দাম লয়ে গেলো চরা
চখের সামনে ঝরে পড়ে গেলো আমার আসমানী তারা।
শিয়রে ডাকিয়া বিবিজান কয়, সময় আর নাই বাকী,
দুই চউখের জ্যুতি যে গো ছিলো,নিভা দিয়া গেলো ফাকি।
সকলে বলিলো, শুকর খোদার মাগরেবে গেছে প্রাণ,
এ অক্তে শুধু আল্লারে পায় পাক্কা মুসলমান।
যারে সাথে দেখে, পাশে পাশে থেকে, বিতায়েছি এতকাল
আমার হাতেই করা বাগানেতে ঘুমায় সে নয় সাল।
শরম দেখায়ে জংলী ছাপার পাতলা আচল তুলি,
মুখ ঢাকেনা সে, কথার জবাবে বলেনা চালাকী বুলি।
সেইদিন থেকে আজিকা অব্দি মাগরেব ছুটে নাই,
সিজদা রুকুতে সালামে কাতারে ময়নার দেখা পাই।
বড় বউ জানি ছেলেরে আমার দিলো কি কুমন্ত্রণা
ভাইয়েরা হইলো তার কাছে বিষ,বুড়া বাপ যন্ত্রণা।
বাজানের লাগি এত যার মায়া সেই আমার বড় পোলা,
ভাইদের বলে বাটোয়ারা কর, জমিন,ধানের গোলা।
বউ-নাতী নিয়া আলাদা হইয়া বাজানেরে গেছে ভুলে,
যে বাজান তারে হুচট খাইলে এক হাতে নিতো তুলে।
আর দুইজনই সংগ্রামে গেলো সেবার জষ্ঠি মাসে
পঁাচ বচ্ছর কাটে তারপর,খোকারা আর না আসে!
“মুক্তি কা বাপ” ডাকিয়া আমার,আড়ত করিল ছাই
যত সোনা,রূপা,দামী জহরত একখানও আর নাই।
তবু রোজ করে আল্লার ঘরে পাচ বেলা ঠিকই যাই
আর একবার যাতে সবাইরে দেখি খালি এই ভিখ চাই।
খোয়াবে সেদিন বিবিজান এলো,মালাকুল মওত বামে
নিদ ভাঙ্গি দেখি চৌকি ভিজেছে,পেচ্ছাবে, নুনা ঘামে।
মাগরেব অক্তে গুছলের ঘরে, কলবেতে টের পাই
ফুরাইয়া গেছে আমার জীবন,বেশী সময় আর নাই!
মসজিদ হতে আজানের ধ্বনি ভেসে আসে সুমধুর
সাঁঝের শীতল বাতাসের গায়ে মেখে থাকে মৃদু সুর।
শুধু একজন শুনবেনা আর বেহেশতি সেই গান
অজুরত থেকে পরকালগামী বিরহী বর্ষীয়ান।
অনবদ্য হয়েছে। গর্ব হচ্ছে। এত্ত ভালো লিখো তুমি!
থ্যাঙ্কস, হান! নোটিফিকেশন দেখে বুঝিনাই অতিথি যে আমার ঘরের কর্ত্রী 😡 😡 😡
অনবদ্য। এতো ভালো কবিতা আমি হয়ত আমার সারা জীবনেই খুব কম পড়েছি। তোমার লেখায় জসীমউদ্দিন কে যেন নতুন করে খুঁজে পেলাম।
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া! 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂
এ কবিতা পড়ে একটা নতুন শব্দ শিখলাম, রসুই ঘর= রান্না ঘর। ধন্যবাদ।
কবিতা খুবই চমৎকার হয়েছে।
🙂 🙂 🙂 🙂 ধন্যবাদ ভাইয়া!
🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া!
🙂 🙂 🙂 🙂 অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া!
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া! 🙂 🙂
অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া! 🙂 🙂 🙂 🙂
অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া!
লেখাটির আভাসমাত্র দেখেছিলাম।
ব্যস্ততার কারণে দেখতে পারিনি। এত গ্রাম্য অনুষঙ্গ -- এত তরতাজা প্রকাশভঙ্গি। দীর্ঘ একহারা লেখাটিতে তবু পুনরাবৃত্তির প্রকোপ নেই।
মুগ্ধ বললে কম বলা হয়!
অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া! 🙂 🙂 🙂 🙂
:clap: :clap: :clap: :clap: :clap: :clap:
তুমি সিসিবির সম্পদ না সম্পত্তি সে আলোচনায় না গিয়ে শুধু বলি, তোমার আজান এর ধ্বনি তের নদীর ওপার থেকেও শুনতে পেয়েছি!
একসেলেন্টো, ভাইয়া!
ধন্য হয়ে গেলাম আপু! 🙂 🙂
প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত অন্তত সাতবার পড়েছি আর ভেবেছি, লেখাটা এই ঢঙ্গে কেন হলো?
যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান
কালিবাজাইল নামের এক অজপাড়া গ্রামের এক বৃদ্ধের জীবন কাহিনী এটা। তাই ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতাটা আনার চেষ্টা করেছি। 🙂 🙂 🙂 🙂