২০০২, জুন…সারপ্রাইজ

সিরিয়াল ১১
২০০২, জুন…সারপ্রাইজ

আমি খুবি চিন্তায় পড়ে গেছি। আমার হাতে লিখা ” A”। এই ব্যক্তির নাম আরিফ। তার মানে…না না, কিছুতেই না। আমার পছন্দের নাম রায়হান হবে। তাছাড়া জ্যাকেটওয়ালার দেখা না মিলা পর্যন্ত কিছুই ভাবতে চাই না। আমার কত আশা, পুরনিমার রাত হবে, গলায় শিউলিমালা পড়ব, তবে না কিছু ভাবব।ধুর! এইসব পাজী লোক কে পাত্তা দেয়া যাবে না। পণ মানতেই হবে।
আব্বুকে রাজী করিয়ে যাওয়া থামানো গেল। কিন্তু পাত্রকে ফিরতেই হবে ঢাকায়। তার প্রিন্টিং কাজ বলে কথা! সবাই মন খারাপ করে বসে আছে। আমি ভাবছি পাত্র কি তাহলে ফলেন হয়ে গেল নাকি সত্যি সত্যি? তাহলে তো ভালোই বিপদে পড়েছি। কাল যা হল।
পাত্র ব্যাগ গুছিয়ে দুপুরে খেয়ে চলে গেল। যাবার আগে হাতের মুঠোয় আমার ছিড়ে যাওয়া চুল দেখিয়ে দিল, লুকিয়ে। সবাই আছে, কিন্তু আমার কাছে বাড়ী ফাকা লাগছে। বুঝতে পারছি না। আমার চারিত্রিক দুরবলতা দেখা দিচ্ছে মনে হয়। পাজী লোকটার কথা মনে পড়ছে বার বার।
সারাদিন না কোথাও গেলাম, আর না কোন মজা হল। সবাই কেমন উদাস। বিশেষত পাত্রীরা। কারণ পাত্র যাবার আগে কিছুই বলে যায় নি। কেবল বলে গেছে আরো ৫ বছর পর বিয়ে করবে। খালামনিরা সবাই বিবাহ যোগ্যা। তাহলে ৫ বছর কেন? অবশেষে জিনিয়াস খালামনিরা হিসাব করে দেখল, ৫ বছর কেবল আমার সাথেই মিলে যায়। সুতরাং আমি কোপে পড়ে গেছি। যাবার আগে পাত্র এভাবে আমাকে সকলের মাঝে কোপানোর জন্য রেখে গেল!
সন্ধ্যা হয়ে গেল। একা একা হাটছিলাম। নানাবাড়ীর সামনে রাস্তায় অন্ধকার। একটা রিকশা এসে থামল। আমি তাই পিছন ফিরে বাড়িতে ঢুকছি। কে না কে এল। হঠাত দেখি সামনে পাত্র দাঁড়িয়ে। সপ্ন দেখছি না তো!
আরিফঃ ওইরকম হা করে তাকায় আছো কেন?
আমিঃ না মানে, আপনি কি সত্যি নাকি বুঝতে পারছি না
আরিফঃ এই দ্যাখো সত্যি ( আমার গায়ে চিমটি মারল)
আমিঃ উফ, আপনি চিমটি মারলেন কেন?
আরিফঃ এত মিস করবা বললেই হত, যেতাম না
আমিঃ আমি মিস করেছি? জীবনেও না
আরিফঃ মিস না করলে আমার জন্য রাস্তায় দাঁড়ায় ছিলা কেন?
আমিঃ আমি হাওয়া খাচ্ছিলাম
আরিফঃ হাওয়া, এখানে, কোথাও কোন পাতা পর্যন্ত নড়ে না, আর হাওয়া…।হাহাহাহা
বড়মামাঃ কে আসলো মামা?
আমিঃ আরিফ সাহেব ফিরে এসেছে মামা
বড়মামাঃ সেকি! দাড় করিয়ে রেখেছো কেন? জলদি ঘরে আনো
আরিফঃ আমিও তাই বলি। খালি জেরা “কেন আসলেন?” যে খিধা লেগেছে। যাও যাও খাবার আনো।
আমি উজবুক বনে গেলাম। খেতে খেতে সবার সাথে পুনরায় বাক্যে মশগুল তিনি।
আব্বুঃ তুমি ফিরে এলে যে!
আরিফঃ বাস পাইনি
কিছু বোঝার আগেই আমি আর খালামনিরা খেক খেক করে কাসি হাসি মিলে কি যে দিলাম! আমার বিষম লেগে গেল।
আব্বুঃ কি হল? যাই হোক, নাটোর থেকে তো ৫ মিনিট পর পর বাস ছাড়ে।
আরিফঃ আগে বলবেন না, আমিতো ৫ মিনিট দেখেই ফেরত আসছি
আব্বুঃ তাহলে বাস স্ট্যান্ড থেকে সন্ধ্যায় আসলে যে!
আরিফ তার ব্যাগ থেকে আমার মামাদের দুই মেয়ের জন্য জামা বের করল।
আরিফঃ বাচ্চা দুইটার জন্য।

রাতের বেলা খাবার পর আমি বাধ্য মেয়ের মত পাত্রের জোড়া হয়ে ক্যারাম খেললাম। আবার ক্যাক্টাসের কাটা বাছবে কে! রাতে ঘুমানর আগে…
আমিঃ আপনি আসছেন কেন আবার? (ফিসফিস করে)
আরিফঃ এই চুলগুলো ফেরত দিতে। মেসের লোকজন কি বলবে মেয়েদের চুল দেখলে আমার হাতে, ছি!
আমিঃ আপনি চুল দিতে আসছেন?
আরিফঃ নাইলে আর কি!
মনের আনন্দে বান্দা তার নকিয়া মোবাইলে গেম খেলছে! নকিয়া! ব্লু নকিয়া! আমার মনে আলোড়ন হল। ইস জ্যাকেটওয়ালা এইরকম মোবাইল নিয়েই খেলছিল! কোথায় জাকেটওয়ালা আর কোথায় এই বদ লোক!

সিরিয়াল ১২
২০০২, জুন, ঢাকা…কিছুই রইল না ঢাকা

ছুটি শেষ করে আব্বু আর পাত্র ফিরে গেল। ২ দিন পর আমরাও ফিরলাম। নাটোরের সব কাহিনী মনে নিয়ে ঢাকায় ফিরলাম। খালামনিদের কারোই বিয়ের সানাই বাজল না। মামাদের মন খারাপ।আব্বু সাধ করে নিল। লাভ হল না। ঢাকায় ফিরে কাজে ব্যস্ত পাত্র। কেবল বৃহস্পতিবার আসে। ক্যারাম ম্যাচ হয়। কখনও শুক্রবা্রে আসে। আমি পড়া নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে খেলি। পাত্র মাঝে মাঝে ফোন করে সবার সাথে কথা বলে।একদিন রাত ১১ টা বাজে। কলিংবেল।আম্মু ভাত বাড়ছে। ভাই টিভি দেখে। আব্বু আসছে ভেবে আমি দরজায় গেলাম। কেউ নেই। নিচে তাকিয়ে দেখি আরিফ সাহেব দাঁড়িয়ে।
আমিঃ ওপরে আসেন
আরিফঃ না
আমিঃ কেন?
ইশারা করে বুজিয়ে দিলেন যে সময় নেই। কিছুই না বলে এক মিনিট পরই চলে গেলেন।
আম্মুঃ কে?
আমিঃ কি জানি, কেউ না। কি যেন মনে করে সত্যি বললাম না
রাতে ফোন এল। সবার সাথে কথা বলে আমাকে চাইলেন।
আরিফঃ আমি বললাম আসব না, আর জোরও করলা না?
আমিঃ আসার জন্য বলেছিলাম তো আপনি বললেন সময় নাই
আরিফঃ আমি ফকিরাপুল থেকে রাজাবাজার আসছিলাম একবার দেখতে, জানো?
আমিঃ কি?
আরিফঃ তোমার বারান্দার টবগুলা।আছে না চোরে নিয়ে গেছে
আমিঃ কি! টব!
আরিফঃ কেন তুমি কি ভাবছিলা?
আমি নিরবাক। এই লোকটা সবসময় আমাকে বাশ দেয়। এইরকম খারাপ কেন?

২০০২ ১৯ সেপ্টেম্বর

দেখতে দেখতে সেপ্টেম্বর এসে গেল।আজ আমাদের কোচিং এর ফাইনাল রেজাল্ট। আমি পুরষ্কার পাব। কিন্তু অনুষ্ঠান টি এস সি তে। আমি চিনি না এই জায়গা। ভাইয়ের পরীক্ষা। আব্বুর অফিস। আম্মু আব্বু যখন চিন্তায় কে যাবে আমাকে দিতে আর নিতে, তখন আরিফ সাহেব বলল তিনি এই দায়িত্ত নিবেন। সবাই নিশ্চিন্ত হল। আমি চিন্তিত হলাম। আমি একা এই মানুষের সাথে যাব? আজকে আমার খবর আছে। অনুষ্ঠান শেষে বের হয়েছি।
সাড়ে সাতটা বাজে। এই অন্ধকারে কোথায় খুজব, এই মানুষটাকে। দেখি চাদের আলোয় ভরা চারপাশ। আজকে ভরা পুরনিমা। আস্তে আস্তে হেটে ল্যাম্প পোষ্ট এর নিচে দাড়িয়েছি। আকাশ দেখছি। কোথা থেকেই হঠাত করে এলেন আরিফ সাহেব।
আমিঃ এত তাড়াতাড়ি এলেন, আমি ভেবেছিলাম অপেক্ষা করতে হবে
আরিফঃ আমিতো যাই ই নি
আমিঃ আপনি না বললেন আব্বুকে আপনার টি এস সি তে কাজ আছে?
আরিফঃ হাহাহা, মিথ্যা বলেছি।আমি এখানেই বসেছিলাম। কি দ্যাখো?
আমিঃ চাদ দেখি। সুন্দর না?
আরিফঃ কই? দেখি না তো
আমিঃ কি বলে!
আরিফঃ তোমাকে দেখে আর কিছু দেখার টাইম কই?
আশেপাশে এত্তগুলা পিচ্চি মালা বেচতেছে। “আপু নেন নেন, শিউলি ফুল”।আমি শিউলি দেখেই খুশি হয়ে গেলাম। আমার প্রিয় ফুল। মনে মনে ভাবছি একদিন কেউ যদি আমাকে এটা গলায় পড়াতো!
আরিফঃ ফুল নিবা?
আমিঃ না
আরিফঃ কেন? নাও না, বলছে এত করে। হাতে ধরায় দিল
আমিঃ ধুর, লাগবে না। (মনে মনে ভয় পাচ্ছি)

আমি উদাস হয়ে জ্যাকেটওয়ালার কথা ভাবছিলাম আর হাটছিলাম রিকশার জন্য। কিছু বুঝার আগেই আরিফ নামক গাধা এই লোক আমার গলায় পড়িয়ে দিল একটা শিউলি ফুলের মালা। আমি হা করে একবার লোকটার দিকে আরেকবার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি এইভাবে ধরা খেয়ে গেলাম! আমার এইরকম একটা ভয়ংকর পণও আল্লাহ পূরণ করল! আজকে যে ভরা পুর্ণিমা!

৪৭৫ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “২০০২, জুন…সারপ্রাইজ”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।