দাঁড়িয়ে আছি রান্নাঘরে। ধোয়ামোছার কাজটা শেষ করে এনেছি, এমন সময় দেখি তুষার পড়া শুরু হয়েছে। তুলার ন্যায় ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে শুভ্র তুষারকণা। আলোয় ঝলমল করছে রাস্তাটা। ক্রিসমাস ট্রিটা জানালার পাশে রেখেছে তারা, সোনালী আর লালে সুন্দর করে সাজানো। ম্যারিয়ানকে দেখতে পাচ্ছি। ক্রিসমাসের আলোয় এক মূহুর্তের জন্য যেন ঝলসে উঠল তার চেহারা। আমাকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়াল।
উপহারটার কথা এখনও জানে না সে।
এ বছর গাছ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাইনি। একা মানুষ, এসব করা শোভা পায় না। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে প্রতিটা ক্রিসমাস একাই পার করে আসছি। লারা, আমাদের বড় মেয়ে, এক নিউজিল্যান্ড নিবাসীকে বিয়ে করে সেখানেই স্থিতু হয়েছে। সেও প্রায় তিন বছর আগেরকার কথা। আর আমার ছেলে, ড্যানি; সে তো সবসময়ই কাজে ব্যস্ত থাকে।
এখন সয়ে গেছে। লোকে মনে করে, ক্রিসমাসের সময়টাতে একা থাকার চেয়ে কষ্টদায়ক আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু বছর জুড়ে একা থাকার চেয়ে কষ্টদায়ক বলে তো মনে হয় না আমার। আসলে একাকীত্বে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। প্রথম প্রথম গ্রেস ছাড়া জীবনটা অর্থহীন মনে হতো, অসহ্যকর ঠেকত সবকিছু। তারপর হঠাৎই একদিন জানালার বাইরে চোখ পড়লে দেখতে পেলাম ম্যারিয়ানকে। কেন যেন মনে হচ্ছিল, আমি আর একা নই। বিস্ময়কর একটা ব্যাপার ঘটে গেল তখন। সত্যিই ব্যাপারটা বিস্ময়কর-প্রেমে পড়ে গেলাম আমি।
গ্রেস বেঁচে থাকতে, প্রতি সন্ধ্যায় লিভিং রুমে বসে টিভি দেখতাম আমরা। ও আর নেই, আমারও একা একা সেখানে বসতে ইচ্ছে করে না। ওর হাতের উষ্ণতা এখন আমাকে ছুঁয়ে যায় না, আলতো করে আমার হাঁটুতে পড়ে থাকে না; রাশান বেজির টিভি বিজ্ঞাপনটা দেখে ও আর হাসতে হাসতে আমার গায়ে গড়িয়ে পড়ে না।
ডিনারের পর রান্নাঘরে বসে থাকি এখন। মাঝে মাঝে রেডিওটা ছেড়ে দেই। তবে এর চেয়ে প্রতিবেশীদের কাজকারবার দেখতেই বেশি ভাল লাগে। আজকালকার একঘেয়ে রিয়েলিটি শোগুলোর চেয়ে মানুষের কর্মকাণ্ড দেখতেইই বেশি মজা।
আর এভাবেই দেখা পাই ম্যারিয়ানের। আমার বাসার ঠিক বিপরীতেই থাকে সে। কতদিন ধরে থাকছে, নিশ্চিত নই; তবে বেশ কিছু দিন ধরেই বলে মনে হয়। আগে হয়তো দেখেছি তাকে। তবে সেটা শুধুই দেখার দেখা ছিল। বিপত্নীক হওয়ার আগে অন্য নারীর দিকে চোখ তুলে তাকাইনি কখনও। একাকীত্বই মানুষের প্রতি আমার আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে ম্যারিয়ানের প্রতি।
প্রতি সন্ধ্যায় মাথা নীচু করে রাস্তা থেকে কংক্রিটের পথটা ধরে হেঁটে আসতে দেখি তাকে, হাতে থাকে সেইন্সবেরির ব্যাগ (সেইন্সবেরি যুক্তরাস্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম সুপারমার্কেট)। গরমকালে ছুটির দিনগুলোতে বাসা থেকে বের হয়ে আসে সে আর বাসার সামনে বেড়ে ওঠা গোলাপঝাড়ের যত্ন নেয়। আমার রান্নাঘর থেকে স্পষ্ট দেখতে পাই তাকে। যখনই কেউ পাশ কাটিয়ে যায়, পরিচিত বা অপরিচিত সকলকেই একটা মিষ্টি হাসি উপহার দেয় সে। মাঝে মাঝে ‘শুভ সকাল’, ‘কেমন আছেন’ এধরনের কুশলাদিও বিনিময় করে। বয়স খুব বেশি নয় তার, এখনো চল্লিশও পার হয়নি। কিন্তু পুরানো দিনগুলো মনে করিয়ে দেওয়ার মত কিছু একটা আছে তার ভেতর, শান্তশিষ্ট কিছু যেটা সূদুর অতীত থেকে চলে এসেছে যেন।
কয়েক সপ্তাহ পর তার অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম নিজেকে। তাকে এক নজর দেখার আশায় মাঝে মাঝে পুরো দিন জানালার পাশে ঠাঁই বসে থাকতাম, ভুলে যেতাম নাওয়া-খাওয়া। আর যখনই তাকে দেখতে পেতাম, আমার পুরো মাথাটা ফাঁকা হয়ে যেত আর… আর মনটা আনন্দে ভরে উঠত।
গ্রেসের সাথে কোনও মিল নেই ম্যারিয়ানের। তাতেও তার প্রতি আমার আকর্ষণটা মোটেই কমেনি। গ্রেস ছিল অপরুপা, কালো আর একহারা গড়নের, পোশাক-আশাকে পরিপাটি। ওদিকে, ম্যারিয়ানের অবস্থা যাচ্ছে-তাই। স্বর্ণালি চুলগুলো পনিটেল করে বেঁধে রাখে, আঁচড়ানোর প্রয়োজন বোধ করে না সম্ভবত। কুঁচকে থাকা কাপড়গুলো সম্ভবত কখনই ইস্ত্রির মুখ দেখেনি। বিধ্বস্ত দেখায় তাকে।
কিন্তু নজর রেখেছি বিধায় আমার কাছে গোপন থাকেনি তার সৌন্দর্য। এক অদ্ভুত আভা ঘিরে থাকে তাকে, পরম মমতায় জড়িয়ে রয়েছে যেন ওম। এক দুর্নিবার আকর্ষণ সেই উষ্ণতায়। উষ্ণতাটুকু ছিল গ্রেসের মাঝেও। আর এখন ম্যারিয়ানের মাঝে তা অনুভব করতে পারি আমি। আমার দিন এখনও শেষ হয়নি হয়তো।
উষ্ণতায় শেষ রক্ষা হয়নি গ্রেসের। সময়ের পূর্বেই ক্যান্সার কেড়ে নেয় ওকে। ম্যারিয়ানেরও সেরকম ভগ্নদশা। বিনয় তার বয়স যেমন বাড়িয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনি বাড়িয়েছে তার চলাফেরাও। তার মন্থর গতি দেখলে মনে হয়, যেন কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে। অবশ্য সেটা সত্য হলেও হতে পারে। গত ছয় মাসে দুবার হাসপাতালে গেছে সে। একবার কব্জি আর কয়েকদিন আগে গালের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ায়। প্রথমবার, বাড়ি থেকে বের হতে গিয়ে বরফে পিছলে গিয়েছিল; আর দ্বিতীয়বার, পড়েছিল ছিনতাইকারীর কবলে। এই তো, মাত্র দু-এক সপ্তাহ আগের ঘটনা এটা। ছিনতাইকারীরা মুখোশ পরে ছিল বলে চিনতে পারেনি ম্যারিয়ান। ঘটনাটা জেনেছি ড্যানির কাছ থেকে-আমার ছেলে এককজন পুলিশ কন্সটেবল।
‘সিসিটিভি থেকে কিছু জানা যায়নি?’ জিজ্ঞেস করেছিলাম।
পুলিশ নাকি সেটা চেক করে দেখেছে, কিন্তু কিছুই পায়নি। ‘এরা খুব সেয়ানা’, বলেছিল ড্যানি, ‘জানে কোথায় কাজ সারতে হবে।’
পরদিন পাবে গিয়ে ম্যারিয়ানের বয়স্ক স্বামীর পাশে দাঁড়াই আমি আর দশ ডলারের একটা বিল টেনে নিতে দেখি তাকে। তার হাতের আঙ্গুলের কড়াগুলো ফোলা, চামড়া ফাটা।
কী ঘটেছে বুঝতে বাকি রইল না। বাইরে গিয়ে শান্ত করি নিজেকে, একটা বেঞ্চে বসি আর পুরো পৃথিবীটা সাদা হয়ে না আসা পর্যন্ত নিজের চোখে ঘুষি মারতে থাকি। এরপর ফিরে আসি বাসায়। ঢোঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছিল, যেন গলা টিপে ধরেছিল কেউ। বাতি নিভিয়ে বসে ছিলাম রান্নাঘরে; চাইছিলাম না গ্রেস আমাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলুক, আমার মনের কথাগুলো পড়ে ফেলুক আর জেনে ফেলুক, কী করতে চাইছি আমি।
পিতা-কন্যার মধ্যে সম্পর্ক যেমনটা, ম্যারিয়ানের প্রতিও আমার তেমনটাই অনুভব করা উচিত হয়তো। কিন্তু তা হয়নি, এটা আরও বেশি কিছু। তার দিকে তাকালে দেখতে পাই এক ক্লান্ত তরুণীকে। তার কচিভাব আমাকে উল্লাসিত করে, ইচ্ছে করে তার নরম সোনালি চুলে হাত বুলিয়ে দিতে। তার সকল ক্লান্তি দূর করে দিতে চাই আমি, উপহার দিতে চাই তার ভুবনভুলানো হাসির জন্য।
সেই রাতেই ম্যারিয়ানকে একটা উপহার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই, এমন কিছু যা তার কাছে সাত রাজার ধন সমতুল্য মনে হবে। কখনই জানবে না সে, উপহারটা কার কাছে থেকে এসেছে। কিন্তু তা কোন ব্যাপারই না। আমাকে কোনদিনই ভালবাসবে না সে, ভাল করেই জানি। সাতষট্টি বছরের এক ঘাটের মরার কথা কল্পনাতেও আনবে না।
বয়স নারীকে অদৃশ্য করে, আর পুরুষকে করে অক্ষম। এই তো চিরায়ত নিয়ম। তারপরও, বিস্ময়কর শোনাবে হয়তো, অক্ষমতার কিছু সুবিধেও আছে। একজন অক্ষমকে নিরীহ আর নিরুপদ্রব মনে করে সবাই, তার থেকে কোন ঝুঁটঝামেলা কল্লনাও করে না কেউ।
অভ্যাসের দাস বলতে যা বোঝায়, ম্যারিয়ানের স্বামী ঠিক তাই। প্রত্যেক রাতে রোজ এন্ড ক্রাউন বন্ধ হওয়া পর্যন্ত গিলতে থাকে সে। তারপর খালের পাশের রাস্তাটা ধরে বাড়ি ফেরে। গতকাল রাতে পানশালাটার বাইরে অপেক্ষা করছিলাম আমি। সে বের হয়ে এলে আমার ভ্যানে লিফট নেয়ার আমন্ত্রণ জানাই তাকে।
“চিয়ার্স, এলেক,” বলেছিল সে আর ঘুমিয়ে পড়ে সাথে সাথেই। নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। জোরে জোরে নাক ডাকছিল সে। তবে সেটা রোহ্যাম্পটন ভ্যালের কাছে এসে গাড়ি থামানোর আগ পর্যন্ত। তাকে যখন বলি, তার সাহায্য প্রয়োজন আমার, কোন প্রশ্ন করেনি; একটা শিশুর ন্যায় আন্ডারপাস ধরে আমাকে অনুসরণ করতে থাকে। পেছন থেকে একটা মাত্র আঘাত, সাথে সাথে কলা গাছের ন্যায় পড়ে যায় সে। বেশি কিছু লাগেনি, একটা ইটই যথেষ্ট ছিল।
জানি, অনেক বড় একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তার সাথে তেমন কোন সম্পর্ক ছিল না আমার। প্রতিবেশী হওয়ায় ভদ্রতার খাতিরে মাঝে মাঝে হাই-হ্যালো হতো শুধু। ম্যারিয়ানের প্রতি আমার অনুভূতির ব্যাপারে কেউ জানে না। ইটটা এখন খালের তলায়, ম্যারিয়ানের স্বামীর ওয়ালেট আর ফোন বেডরুমে গ্রেসের বিয়ের পোশাকের নিচে বাক্সবন্দী।
আজ প্রায় সারাটা দিন রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছি। নজর রাখছি পার্কিং এরিয়ায়-পুলিশের গাড়ির আশায়। লোকে মিথ্যে বলে না, কাউকে উপহার দেয়ার সবচে আকর্ষণীয় দিকটা হলো, উপহার পাওয়ার পর তার মুখভঙ্গিটা।
আমার পালস বেড়ে যাচ্ছে দ্রুত, বুকের ভেতর ঢাক পেটাচ্ছে কে যেন।
তর সইছে না খবরটা শোনার পর ম্যারিয়ানের অনুভূতি দেখার জন্য।
মন্তব্য করুন