ক্যাডেট কথিকাঃ পর্ব ৮

পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ

প্রিন্সিপাল স্যারের বাড়ির পেছনে ছিল জাম গাছটা। পাখিরা পাকা জাম ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে বিচি ফেলতো এদিক ওদিক। কপাল ভাল থাকলে বেইসবল গ্রাউন্ডে দুটো চারটে আস্ত জামও পাওয়া যেতো। দেলোয়ারা ক’দিন ধরেই ভাবছিল প্রিন্সিপাল স্যারের চোখ এড়িয়ে কি করে জামগুলো সাবাড় করা যায়। জাম বেশী দিন গাছে থাকে না, তাই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। সমস্যা হলো, ভাতঘুম শেষে বিকেলে স্যার বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়েন। এতো বড় বাড়ি থাকতে স্যারকে কেন বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়তে হবে? পর্দাটি টেনে বিছানায় আরাম করে শুয়েও তো বিশ্ব জগতের সংবাদ পড়া যায়, নাকি? নচ্ছার পাখীগুলা সব জাম খেয়ে নিচ্ছে। আহা! একদিন জানা গেল প্রিন্সিপাল স্যার তাঁর কন্যা মিন্টি আপাকে নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন কি একটা জরুরী কাজে। খোদা এইবার বুঝি চোখ মেলে তাকিয়েছেন! আর দেরী করা চলে না। কালই গেমস শেষ হলে এ্যাডজুটেন্ট স্যার বাসায় চলে যাবার পর অপারেশনে নামতে হবে!

নদী নালার দেশ থেকে এসেছিল দেলোয়ারা। সাঁতারে সে ছিল চৌকশ; দৌড়ঝাপ, পাখির বাসা খুঁজে বের করা কিংবা গাছে চড়ার মত কাজগুলো তার জন্য ছিল নস্যি! দেলোয়ারার দস্যিপনার গল্পগুলো আমাদের কাছে রুপকথার গল্পের মত শোনাতো। ছোটবেলায় নানুর বাড়িতে টিয়া পাখির বাচ্চা এনে দিয়েছিল ওহিদ মামু। এই এতোটুকু একটা পাখি নিয়ে কী কান্ডটাই না করেছিলাম আমরা! ওহিদ মামুকে আমাদের ভিন জগতের মানুষ মনে হতো। আমরা টিয়া পাখির বাচ্চার নাম দিলাম টুনটুনি! পাখির বাচ্চারা লাল মরিচ খেয়ে নাকি বড় হয়। মামু তাদের বাড়ি থেকে শুকনো লাল মরিচ নিয়ে আসতো প্রতিদিন বিকালবেলা!

গেমসে সেদিন দেলোয়ারার মন নাই। ঘুরেফিরে সে বেইসবল গ্রাউন্ডে গিয়ে বার কয়েক রেকি করে আসে। মনে মনে ছক কাটে, হাউস থেকে সবার অগোচরে বের হয়ে গার্ডের চোখ এড়িয়ে গাছে উঠতে হবে। কান্তি কাপড়ের একটা ব্যাগ এনে দিয়েছে জাম আনার জন্য। যা থাকে কপালে! হাউসে ফিরে জামাকাপড় বদলে সবার মত সাদা সালোয়ার কামিজ আর ক্যানভাস জুতো পরে ঝটপট তৈরী হয়ে নেয় সে। কান্তি গার্ডের সাথে খেজুরে গল্প জুড়ে দিল। এই ফাঁকে দেলোয়ারা মুহূর্তের মাঝে চম্পট দেয়। ওর জন্য আম জাম গাছে ওঠা কষ্টের কিছু নয়। এখন বৃষ্টি নেই বলে শুকনো খড়খড়ে গাছ বেয়ে দেলোয়ারা মগ ডালে উঠে গেল। কান্তির ব্যাগে পরে জাম রাখা যাবে, আগে মন ভরে খেয়ে নেয়া যাক। রসে টইটম্বুর জাম কতদিন খাওয়া হয়না! গাছের ডালে পা দুলিয়ে বসে আশ মিটিয়ে জাম খায় দেলোয়ারা। ওপর থেকে বেইসবল গ্রাউন্ডকে বিশাল দেখায়। দূরে কে জানি হাঁটছে। বাইরের মানুষজন কত স্বাধীন! ইচ্ছা হলে তারা আজ মোগলাই পরোটা তো কাল কদবেল ভর্তা খেতে পারে! আবার ইচ্ছা হলে তারা এমন ভর সন্ধ্যায় হাঁটাহাটিও করতে পারে। শেষ বিকেলের আলো আঁধারিতে জাম গাছের মগ ডালে বসে বহুমুখী দার্শনিকতায় পেয়ে বসে তাকে। হঠাৎ কার গলা শোনা যায় যেন! এ্যাডজুটেন্ট স্যার নয়তো? দেলোয়ারা খানিক ধন্দে পড়ে যায়। পা নাচানো বন্ধ করে সে চুপচাপ বসে থাকে। ততোক্ষণে এ্যাডজুটেন্ট স্যার গাছের নীচে এসে উচ্চস্বরে বলছেন, জাম গাছে কে? জাম গাছে কে রে?

ছি ছি ছি দেলোয়ারা!

আমরা ছুটি থেকে কলেজে ফেরার সময় প্রতিবার গাছের চারা নিয়ে আসতাম। সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলেজ তখন প্রায় বিরানভূমি ছিল। করিমউদ্দীন স্যার প্রথম আমাদের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুরু করেন। আমরা স্যারের নির্দেশ মতো মূলতঃ ফলের চারা নিয়ে আসতাম কলেজে। কলেজে ফেরার পরদিন ব্রেকফাস্ট সেরে নিজ নিজ গাছ হাতে আমরা বাগানে যেতাম। গভীর মনোযোগ আর ভালবাসার সাথে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা হতো। প্রতি শুক্রবার আমাদের গার্ডেনিং আওয়ার ছিল। আমরা ছোটরা আগাছা পরিস্কার করতাম বেলচা হাতে। গাছে পানি দিতাম। আমাদের সাথে সাথে আমাদের লাগানো গাছেরাও যত্ন পেয়ে বড় হতে লাগলো।

আমরা তখন টুয়েলভে পড়ি। দেলোয়ারা আমাদের হাউস গেমস প্রিফেক্ট। নিজে শাসনকর্তা হয়েছে তো কি হয়েছে; রক্তে তার মাছরাঙারা আগের মতই পাখনা মেলে উড়েঘুরে বেড়ায়! তিনতলার বারান্দা থেকে গাছের ডাঁসা পেয়ারাগুলো দেখে নিজেকে কাঁহাতক আর ধরে রাখা যায়! লানচে্র পর সবাই রুমে চলে গেলে নাজুকে সাথে নিয়ে বাইরে চলে আসে ও।

নাজু গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ছিল, দেলোয়ারা তরতরিয়ে গাছে উঠে গেছে। হঠাৎ ভোজবাজির মত কোথা থেকে নীরদ বরণ চৌধুরী স্যারকে দেখা গেল ওদের দিকেই আসছেন। নাজু-দেলোয়ারার কী যেন কথা হয় চোখে চোখে। স্যার সেদিন ডিউটি মাস্টার। অতি দ্রুত লম্বা লম্বা পা ফেলে তিনি পেয়ারা তলায় উপস্থিত হলেন। দেলোয়ারাকে গাছের ডালে দেখে তিনি উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন, ছি ছি ছি দেলোয়ারা, তোমাকে তো এমন ভাবি নাই। ছিহ্! ছি ছি ছি! স্যারের ক্রমাগত ছি ছি’ র মাঝে গাছের নীচে দাঁড়ানো নাজুর ব্যাগটি পেয়ারায় ভরে উঠছিল! দেলোয়ারা নির্বিকার। স্যারের চলে যাবার কোন লক্ষণ নাই; তাঁর ছি ছি চলছিল তখনো। নাজু স্যারের দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত, ওর চোখ গাছের ডালে। কিছুক্ষণ পর দেলোয়ারা লাফ দিয়ে ধুপ করে স্যারের একটু সামনে নামলো। স্যার ভুরু কুঁচকে তাকালেন ওর দিকে। ছি ছি ছি! দেলোয়ারা খানিক অপরাধীর কন্ঠে বলতে চেয়েছিল, স্যার এই পেয়ারাগুলা নিয়ে হাউসে যাই? তার বদলে তোতলাতে তোতলাতে বললো, স্যার এই ছি ছি গুলা নিয়া হাউসে যাই?

জেনিদের নতুন বাড়ি

সাইক্লোস্টাইল মেশিনে কলেজের দাপ্তরিক কাজ করা হতো। করিমউদ্দীন স্যার বললেন, এবারে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ম্যাগাজিন ছাপা হবে। আমরা যারা লেখা দিতে ইচ্ছুক তারা যেন হাউস কালচারাল প্রিফেক্টের কাছে লেখা জমা দেই। প্রথমে মাসিক পত্রিকাটির নাম মালবিকা রাখা হলেও পরে মালবিকার নাম বদলে মুকুর রাখা হয়। এতোদিন যারা লুকিয়ে লুকিয়ে ডায়েরীর পাতায় সাহিত্যচর্চা করতো, তারা এবার প্রকাশ্যে আসবার পথ পেলো। কিন্তু সাহস করে কেউ এগিয়ে লেখা দেয় না। লেখা দেবার আগেই প্রত্যাখ্যানের ভাবনা চলে এলো মাথায়। কেউ ভাবলো, লেখা দিবো কিন্তু যদি ছাপা না হয়! কেউ আবার ভাবলো, আমার লেখাটি নিয়ে যদি আপারা হাসাহাসি করে! আমাদের কলেজ কালচারাল প্রিফেক্ট ছিলেন সুফিয়া ইয়াসমিন আপা। আপা অতি ভাল মানুষ; কাওকে বকা দেয়া তো দূরের কথা, কড়া করে দুটো কথাও বলতে পারেন না। আপা নিজে কবিতা লিখতেন। কারো থেকে লেখা না পেয়ে তিনি নিজেই কয়েকটি লেখা দিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে শাজাহান আলী স্যারকে দায়িত্ব দেয়া হলো প্রত্যেক ক্লাস থেকে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যত রত্ন খুঁজে বের করার! স্যার প্রজ্ঞাবান মানুষ। তিনি ক্লাসে এসে জনে জনে নাম ধরে লেখা জমা দিতে বললেন। আমাদের ক্লাসে লেখার ব্যাপারে কারো কোন উৎসাহ দেখা গেল না। আমরা বাংলা ব্যাকরণের নিপাতনে সিদ্ধ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকলাম। দিন দুই পরে আমি সাহস করে ছোট একটি গল্প দিয়েছিলাম স্যারের হাতে। নাম জেনিদের নতুন বাড়ি।

জেনির বাবা আসগর সাহেব বদলীর চাকুরি করেন। বাবা রাঙামাটিতে বদলী হয়ে এলে জেনি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হলো নতুন স্কুলে। ওরা এক ভাই এক বোন। জেনির বাবা কাজ পাগল মানুষ। মা ওর ছোটভাই শান্তকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। স্কুল থেকে ফেরার পর জেনির বন্ধু মলি খেলতে আসতো ওদের বাড়ি। একদিন দুই বন্ধু মিলে বাড়ির পেছনের বনে হারিয়ে গিয়েছিল। জেনি আর মলির বাড়ি ফিরে আসার গল্প ছিল জেনিদের নতুন বাড়ি।

শাজাহান আলী স্যার জেনিদের নতুন বাড়ি গল্পটি পছন্দ করলেন এবং একদিন ক্লাসে এসে আমার সামান্য লেখাটির প্রসংগে কিছু কথা বললেন। এর আগে আমি যে কিছু লিখিনি তা নয়, কিন্তু ক্লাসে সবার সামনে বাংলার শিক্ষকের অকুণ্ঠ প্রশংসায় আমি লজ্জায় অধোবদন হয়ে রইলাম। এক মাথা ঝাঁকড়া চুলের জন্য এমনিতেই বন্ধুরা কাজী নজরুল বলে ডাকতো, এবার স্যারের অতি প্রশংসার কারণে নামটা পাকাপাকি হলো বলে! ফলাফল হিসেবে আমি নতুন একটি চাকুরি পেলাম। মানপত্র লেখার পাকাপোক্ত চাকুরি!

আমাদের সময়ে কলেজের শিক্ষকদের বিদায় অনুষ্ঠানে ডিনারের পর মানপত্র পড়বার চল ছিল। শিক্ষকদের আমরা আপনি সম্বোধনে ডাকলেও কী এক অদ্ভুত কারণে মানপত্রে তাঁদের তুমি বলে সম্বোধন করা হতো। মানপত্রে হে শিক্ষাগুরু, হে মহিয়সী, হে জ্ঞানরত্ন তুমি এই ছিলে, তুমি সেই ছিলে বলে আমরা তাঁদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলতাম। শিক্ষকদের তুমি বলতে লজ্জা পাবার কথা, কিন্তু আমাদের ব্যাকরণ বইয়ের পাতায় তো তাঁদের তুমি বলেই সম্বোধন করা হয়। কেউ আমাদের তুমিটি শুধরে আপনি করে দিলেন না। আমরাও কাগজে কলমে তুমিতে থিতু হয়ে গেলাম।

আমাদের আজিজ স্যার

আজিজ স্যারের বিদায়কালীন সময়ে লুবনা স্যারের মানপত্র লিখতে চাইলো। ক্যাডেটরা নিজেরা যেচে কোন কাজ করতে চায় না সচরাচর। লুবনা বাংলায় ভাল বটে কিন্তু মানপত্র লেখার মত বিরক্তিকর কাজটি সে কেন করতে চাইছে আপাতত সেটি গবেষণার বিষয়। লুবনা স্যারের অতি প্রিয় ক্যাডেট বটে কিন্তু ওর যা স্বভাব, ওকে দিয়ে কাজ করানো আর গন্ধমাদন পর্বত বয়ে আনা প্রায় একই রকম বটে!

আজিজ স্যার আমাদের অংক শেখান। সদাহাস্যমুখ ভাল মানুষ এবং ভাল শিক্ষকের প্রতিচ্ছায়া হলেন আমাদের অতি প্রিয় আজিজ স্যার। লম্বা, ক্ষীণকায় আজিজ স্যার যেদিন ডিউটি মাস্টার থাকতেন সেদিন আমাদের ঈদ। স্যার নিজে স্বল্পাহারী মানুষ। আমরা সেদিন সব্জী না খেলেও তাই ক্ষতি নাই। তরুণ শিক্ষক আমাদের ছেলেমানুষি দুষ্টুমিগুলি হাসিমুখে সহ্য করতেন। চশমার আড়ালে তার বুদ্ধিদীপ্ত গভীর চোখে জগৎসংসারের সকলের জন্য মমতা উপচে পড়তো। ক্লাসে আমরা স্বভাবসিদ্ধ নিয়মে স্যারকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে যন্ত্রনা দিতাম। সবচাইতে সহজ অংকটিও তিনবারে বুঝতে চাইতাম না। স্যার বিরক্ত হওয়ার বদলে মৃদু হাসতেন, বুঝতে চেষ্টা করতেন কোন এ্যাংগেলে তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রেপ টাইমে স্যারের ডিউটি থাকলে সেই একই অবস্থা। আগামীকাল ধর্ম পরীক্ষা আছে; কিন্তু তাতে কি? আজিজ স্যারের কাছে আজ অংক করতে হবে!

স্যারের বদলীর খবরে আমাদের সদামুখর ক্লাসে শ্মশানের নিরবতা নেমে এলো। আমরা বলবার মত কোন কথা খুঁজে পাইনা। অগত্যা স্যার নিজেই বলতে শুরু করলেন। স্যার বলছেন এমজিসিসি কি করে তার আত্মায় স্হান করে নিয়েছে সেই গল্প। তিনি যখন একা থাকেন আমাদের এক এক জনের কথা কিংবা আমাদের ফাঁকিবাজির কাহিনী তার কেমন মনেপড়ে সেই গল্প বলেন। শেষের দিকে স্যারের কন্ঠস্বর কি আদ্র হয়ে এসেছিল? নাকি আমাদের মনের ভুল? কলেজে এতো এতো মানুষ থাকতে আজিজ স্যারকেই কেন চলে যেতে হবে? আমাদের মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে; আমাদের চোখ সজল হয়ে আসে, আমাদের যাচ্ছেতাই রকমের বিচ্ছিরী লাগতে থাকে। আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবার কেউ নেই!

লুবনা মনের মাধুরী মিশিয়ে বিশাল এক মানপত্র লিখে নিয়ে এলো। লুবনার লেখা প্রতিটি অক্ষরে আমাদের সম্মিলিত আবেগ লুকানো ছিল। প্রথমে কথা ছিল ও নিজেই সেটি পাঠ করবে; কিন্তু মানপত্র পড়তে গিয়ে লুবনা চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেললো। বেচারা এমনিতেই মৃদুস্বরে কথা বলে, এখন ওর কন্ঠস্বর আর শুনতেই পারছি না। শেষ মুহূর্তে লুবনার বদলে অন্য একজন মানপত্র পড়লো। ফেয়ারওয়েল ডিনারে ইংরেজী কেতায় হি ওয়াজ আ জলি গুড ফেলো গাইবার রেওয়াজ ছিল কলেজে। আমরা শিক্ষকদের বিদায়কালীন সময়ে এটি গাইতে গাইতে পাক্কা গায়কপাখী হয়ে উঠেছিলাম। আজিজ স্যারের বিদায়বেলায় আমাদের কন্ঠে সুর বাজলো না; আমরা কান্না লুকাতে গিয়ে অনেকেই হেঁচকি তুলে বিচিত্র সুরে গাইলাম হি ওয়াজ আ জলি গুড ফেলো!

শহরের পথে

এ্যাডজুটেন্ট স্যারের মন মর্জি ভাল থাকলে আমরা সকালবেলা কলেজের বাইরে দৌড়াতে যেতাম। যেদিন ওস্তাদজী বাইরে যাবার ঘোষণা দিতেন সেদিন দৌড়াদৌড়ি করতে খারাপ লাগতো না। একাডেমিক ব্লক ছাড়িয়ে গেলেই স্টাফ কোয়ার্টার শুরু হয়ে যেতো। স্টাফ কোয়ার্টারের বাসিন্দাদের আমরা হিংসা করতাম মনে মনে! আহা! এই মানুষগুলো কত স্বাধীন! ওরা মন চাইলেই গুদারাঘাটে হাওয়া খেয়ে ফিরবার পথে ঝাল ঝাল চটপটি খেয়ে হু হু করতে করতে বাড়ি ফিরতে পারে! গাংগিনাড় পাড়ে হুডখোলা রিকশা থামিয়ে কলিজি সিংগারা কি ছানার পোলাউ খেতে পারে তারা! স্টাফ কোয়ার্টার পেরুলে কলেজের লাল বিশাল গেট চোখে পড়তো। ভোরের কোমল আলোয় আমার চিরচেনা ময়মনসিংহ শহরটিকে কেমন অচেনা লাগে! আমরা ছায়াবানী হল ছাড়িয়ে চরপাড়ার দিকে দৌড়াতে যেতাম। আমার আত্মীয় পরিজনেরা এদিকটায় কেউ থাকেন না, তবুত্ত ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাই। দু’ চারটে খালি রিকশা আমাদের দেখে রাস্তা থেকে নেমে ফুটপাতের দিকে চেপে যায়। ক্যাসেটে হাওয়ামে উড়তা যায়ে চাপিয়ে মোড়ের দোকানে চায়ের জল বসিয়েছেন বুড়ো চাচা। কলতলায় ছোট একটি ছেলে কাপ পিরিচ ধুচ্ছে সশব্দে। হাতে মেসওয়াক নিয়ে পথে বেড়িয়েছে দুটি ফিচেল ছোকরা। মা-খালাদের বয়েসী কেউ কেউ হাঁটতে বেড়িয়েছেন দল বেঁধে। আধভাঙা রাস্তায় বেটাছেলের মত ট্র্যাকস্যুট পরে তিনশো মেয়ের দৌড়ানোর দৃশ্যটি প্রাচীন এই শহরের মানুষদের জন্য নিত্যকার কোন ঘটনা নয়। রাস্তার সবাই ফিরে ফিরে দেখে আমাদের। প্রায় সকলের চোখেই সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টি। এ্যাডজুটেন্ট স্যার সবার পেছনে, কলেজ প্রিফেক্টের আগে ওস্তাদজীদের একজন থাকেন। কলেজ চত্বরে মন চাইলে তবু ঢিমেতেতালায় দৌড়ুনো চলে, কিন্তু কলেজের বাইরে সিনা উঁচা করে চলতেই হয় নইলে কলেজের মান থাকে না যে!

অসময়ের ছুটিতে

আমার দাদুর মত ভেতরে বাহিরে সুন্দর মানুষের দেখা মেলে কম। রুপের সাথে নানা গুণের মিশেলে দাদু অপরুপা ছিলেন। সংসারে সবাই দাদাকে ডাকতো দাদু আর দাদুকে ডাকতো দাদী। আমরা কি করে যেন এর উল্টো ডাকটি শিখে গেলাম। কাঁচা হলুদের মত গায়ের রং ছিল দাদুর। টিকালো নাক আর গভীর চোখের মানুষটি স্বভাবে কোমল। তিনি কথা বলতেন কম। হাসতেন আরো মেপে। দাদা বিদ্বান মানুষ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করে দেশে ফেরার পর আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষ দাদাকে দেখতে এসেছিল। দেশে ফেরার পর সরকারী চাকুরীতে যোগ দেয়ার সাথে নানারকম সমাজকল্যাণ কাজে জড়িয়ে পড়েন তিনি। দাদু সংসারের দেখভাল করতেন কিন্তু অন্তঃপূরবাসিনী ছিলেন না। শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিতেন দাদু। সাদামাটা ঘিয়ে রঙা লাল পাড়ের তাঁতের শাড়িতে ঘোমটা দেয়া দাদুকে রাজেশ্বরীর মত দেখাতো। দাদা মারা যাওয়ার পর দাদু ভেঙে পড়েন ভেতরে ভেতরে। এমনিতেই মৃদুভাষী মানুষ তিনি; এবারে প্রয়োজন ছাড়া কথাবার্তা বলাও বন্ধ করে দিলেন। ছেলেরা সবাই শহরে থাকে, দাদু তবুত্ত পাকাপাকিভাবে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। ঘুম ভেঙে জানালা খুললেই স্বামীর কবর দেখতে পান তিনি। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততোদিন তাঁর দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী হয়ে রইল মার্বেল পাথরে বাঁধানো কবরটি।

গেমস থেকে হাউসে ফেরার পথে ডিউটি মাস্টার স্যার বললেন, তোমাকে নিতে বাবা এসেছেন, বাড়ি যেতে হবে। বন্ধুদের অনেকেই এর আগে অসময়ে বাড়ি গেছে; তাদের সেই যাওয়া আনন্দের চাইতে বিষাদের খবর নিয়ে এসেছে বলেই হয়তো অজানা আশংকায় আমার বুক ধুকধুক করতে লাগলো। হাউসে ফিরে জামাকাপড় বদলে মিলি আপাকে বলে দ্রুত নীচে নেমে আসি। সন্ধ্যা নামছে তখন; শীতের হিমহিম সন্ধ্যা। সবুজ একটা জ্যাকেট পরে আছি; তবুত্ত আমার ঠান্ডা লাগছে বেশ। আসিয়া বুয়া আমার সাথে একাডেমিক ব্লক পর্যন্ত আসে। বুয়া এটা সেটা কিসব বলছে; আমার কানে কিছুই যায় না। আধো অন্ধকারে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাবা। বহুদূরে তার দৃষ্টি; চোখের পাতায় ক্লান্তির ছাপ। আমাকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিলেন। একাডেমিক ব্লকের করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে ঠান্ডা হয়ে আছে করতল। আমরা কেউ কোন কথা বলিনা।

আমার দাদু মারা গেলেন সেই রাতে।

চলবে….

৭,৮০৭ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “ক্যাডেট কথিকাঃ পর্ব ৮”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ক্লাস ইলেভেনের শেষের দিকে আমি বিশাল একটা ঝামেলায় পড়েছিলাম। ক্লাস টুয়েল্ভের মধ্যে হাউজ হাউজ গ্যাঞ্জাম লেগেছিল, কোন এক কারণে ক্রসফায়ারে পড়ে গেছিলাম। তদন্ত কমিটি গঠন, সাক্ষ্য, প্রমাণ...হুলস্থূল ব্যাপার! কলেজ থেকে আউট হব হব ভাব!

    তো এই রকম পরিস্থিতিতে আমাদের হাউজের সামনের গাছের আম পেকে টসটসে হয়ে গেছে। এক দুপুর বেলা আমি আর কাইয়ূম গাছে চড়লাম। আমি মগডালে উঠে আম ছিঁড়ে নিচে ফেলছি, কাইয়ূম উঠেছে একেবারে গুঁড়ির কাছে। এমন সময় কোথা থেকে হাউজ মাস্টার ফজলুল করিম (ইতিহাস) স্যার উপস্থিত। স্যার সাইকেল থেকে নেমেই যথারীতি নাটকীয় ভঙ্গীতে শুরু করলেন, ''সে কী! এদিকে ঝড় হল কখন? নিচে এত আম পড়ে আছে কেন?''
    এ কথা শুনে কাইয়ূম লাফ দিয়ে নিচে নামল।
    'কাইয়ূম, তুমি? তোমার তো হাইটেবিলের খাওয়ার সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল!!'

    নিচের কথোপকথন শুনে আমি উপরে যতটা পারি ডালের সাথে মিশে রইলাম। কেননা, এই পরিস্থিতিতে আমাকে দেখলে সাথে সাথে বাড়ির পথ ধরতে হবে। স্যার কাইয়ূমকে নিয়ে হাউজ মাস্টাররের রুমে এগিয়ে যেতেই আমি চট করে নিচে নেমে হাওয়া হয়ে গেলাম! মনে মনে ভাবলাম, ''ভাগ্যিশ স্যার দেখেন নি!!'

    সেদিন রাতে হাউজ ডিউটি মাস্টার ছিলেন রকিমুন্নেসা (ভূগোল) ম্যাডাম। তিনি শুরু থেকেই আমার জন্য ফাইট করে যাচ্ছিলেন! আমাকে ডেকে বললেন,
    ''তুমি এরমাঝে আবার গাছে আমও পেড়েছো! তোমাকে নিয়ে আমি কী যে করি!!!!''

    বুঝলাম, স্যার আমাকে দেখেও স্মার্টলি না দেখার ভান করে ছিলেন...তা না হলে হয়ত আমার শেষ বছরটা কলেজে কাটানো হত না!

    দেলোয়ারা আপার কথা পড়ে নিজের কথা মনে পড়ল! 🙂


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂

    কী দুষ্টু ছিলি তুই! সাহস তো কম ছিলনা অইটুকুন বয়েসে তোর! আমি কিন্তু লেজবিহীন লক্ষীমন্ত মানুষ ছিলাম। মুখচোরা ছিলাম ছোটবেলায়, পরে যদিত্ত বড় হয়ে কলেজের ডায়াসে দাঁড়িয়ে আগডুম বাগডুম বহু কথা বলেছি। আমার নিজের একটা পৃথিবী ছিল কলেজে। সেই পৃথিবীতে আমি বরাবর একাই ছিলাম, জানিস! বছরের প্রথম দিন বাবা ডায়েরী কিনে দিতো, আমি সেই ডায়েরীতে কুটুরকুটুর করে নানা গল্প লিখতাম। হাবিজাবি কবিতাও। মনেমনে কথা বলতাম।
    রকিমুন্নেসা ম্যাডামকে আমরাও পেয়েছিলাম এমজিসিসিতে। আমাদের ভূগোল পড়াতেন।

    আশাকরি ভাল আছিস, জুনা ভাইটি।

    জবাব দিন
  3. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    এক মাথা ঝাঁকড়া চুলের জন্য এমনিতেই বন্ধুরা কাজী নজরুল বলে ডাকতো, এবার স্যারের অতি প্রশংসার কারণে নামটা পাকাপাকি হলো বলে! ফলাফল হিসেবে আমি নতুন একটি চাকুরি পেলাম। মানপত্র লেখার পাকাপোক্ত চাকুরি! -- বাহ! 🙂
    শিক্ষকদের বিদায়ের সময় মানপত্র রচনা আগে একটি প্রথার মতই ছিল। এখন সে চল বিলুপ্তপ্রায়। আমার মনে আছে, আমার ছোটবেলায় আব্বা আমাকে তাঁর একজন প্রিয় শিক্ষকের অবসরগ্রহণ উপলক্ষে তাঁর রচিত একটি মানপত্র আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। ভাষার অলংকরণে সেই ছোটবেলাতেই না বুঝেই বোধ হয় মুগ্ধ হয়েছিলাম।
    অংক স্যাররা দেখতে একটু বোকাটে ভাবের হলেও প্রকৃতপক্ষে তারা বুদ্ধিমানই হয়ে থাকেন। আর বুদ্ধিমানদের হৃদয়ে মমতা একটু বেশীই থাকে।
    যতদিন বেঁচে ছিলেন ততোদিন তাঁর দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী হয়ে রইল মার্বেল পাথরে বাঁধানো কবরটি -- 🙁
    বরাবরের মতই প্রাণবন্ত পোস্ট। ভাল লেগেছে।

    জবাব দিন
    • সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

      🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂

      প্রিয় অরপিয়া, আমার ব্যাচ মেট দেলোয়ারা বেগম এমজিসিসিতে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ও সদাচার হাউসের হাউস গেমস প্রিফেক্ট ছিল। তোমাদের দেলোয়ারা ম্যাডাম আমাদের ব্যাচের শ্রেষ্ঠ দৌড়বিদ ছিল। ও আমাদের প্রথম স্পোর্টস কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। দেলোয়ারার এই গল্পগুলো পর্যায়ক্রমে আসবে আমার লেখায়। অপেক্ষায় থেকো।

      জবাব দিন
  4. জিয়া হায়দার সোহেল (৮৯-৯৫)

    দেলোয়ারা আপা এখন কোথায় জানি না, উনি এই লিখা পড়লে নিশ্চয়ই অনেক নস্টালজিক হতেন। উনাকে অনেক শ্রদ্ধা। এরকম দুই-একটা মানুষের জন্য ক্যাডেট কলেজ জীবন বিস্বাদ হবার বদলে পূর্ণ স্বাদ হয়ে যায়। এরকম চুরির ঘটনা ছেলেদের কলেজগুলোর আনাচে কানাচে আছে কিন্তু তোমারা তো দেখি লিজেন্ড। কোন অংশেই কম না।

    লুবনা আপুর কাহিনীটা আরও ভালো করে আপুর থেকে জেনে নিবো। জানার অনেক কিছু আছে।

    এ্যাডজুটেন্ট স্যারের এরকম কাজ অনেক ভালো লাগে, আমাদেরও হতো। একবার আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলাম। সব পত্র-পত্রিকায় আমাদের খবর ছাপা হল। শেষ হোটেল শেরাটনে গ্র্যান্ড রিসিপশন, অসাধারন ছিল।

    ইদানিং কারো বিদায় শুনলে আমার চোখে পানি এসে যায়। শেষে আমার চোখে সত্যি পানি নিয়ে এসেছে। আর তুমিও এমন ভাবে লিখছ যে চোখে পানি না আসার উপায় নাই।

    একটা গোছালো এবং অসাধারন লিখা হয়েছে আপু। কথিকা চলুক এবং চলুক। ভালো থেকো :clap:

    জবাব দিন
    • সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

      🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂

      দেলোয়ারা এখন এমজিসিসির শিক্ষিকা। আমাদের পন্চাশ জন সহপাঠীর মাঝে একমাত্র দেলোয়ারাই শিক্ষকতার পেশা বেছে নিয়েছে, তাও আবার ক্যাডেট কলেজে! ওর ভীষণ মমতা আর ভালবাসা ক্যাডেটদের জন্য।

      জিয়া, আমি জানি তোমার মন আদ্র হয়ে আছে তাই আমার এলেবেলে লেখাটি তোমাকে সজল করেছে। দেবার মত কোন সান্ত্বনা নাই জানি, তবুত্ত বলি, সময়ের মত বড় হিলার আর কিছু নেই জানো। একমাত্র সময়ই পারে ক্ষতচিহ্নের গায়ে প্রলেপক দিতে।

      তোমার ভ্রমণ কাহিনী পড়বার জন্য বুকিং দিয়ে রাখলাম। আমার ভালবাসা জেনো।

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।