নিলুফার ম্যাডাম
ধবধবে ফর্সা, ঈষৎ পৃথুলা নিলুফার ম্যাডাম প্রায়শঃ নীল শাড়ি আর স্লিভলেস ব্লাউজ পরে আমাদের ইংরেজী পড়াতে আসতেন। ম্যাডাম আমাদের পার্ট টাইম শিক্ষক। তিনি ময়মনসিংহের স্হানীয় বাসিন্দা। আমাদের কলেজের শিক্ষকেরা প্রায় সকলেই বড় বেশী সাদামাটা সাজপোশাক করতেন, ঠোঁটে আলতো লিপস্টিক কি চোখে কাজলের সামান্য রেখা ছাড়া কেউ বাড়তি কোন প্রসাধন করতেন না। নিলুফার ম্যাডাম আমাদের একঘেয়ে কলেজ জীবনে ঝলমলে গ্ল্যামার নিয়ে এলেন!
ম্যাডাম আমাদের শাসন করতেন না। তিনি হাসিখুশি টাইপের মানুষ, ক্লাসে ক্যাডেটদের পাঠদানের ফাঁকে ফাঁকে তাঁকে জগৎসংসারের নানাবিধ জটিল সমস্যার কথা শুনতে হতো মন দিয়ে। এই যেমন, তিনি কেন সুতি শাড়ি পরতে সচ্ছন্দ বোধ করেন না অথবা মেয়ে রুনার সাথে তার এতোটুকু মিল নেই কেন ইত্যাদি ইত্যাদি! ক্যাডেটদের পড়ানোর ব্যাপারটি ম্যাডাম উপভোগ করতেন খুব কিন্তু আমাদের মন পড়াশোনার চাইতে তাঁর শাড়িতে, আঁচলে, সুগন্ধি আর চোখের পাতায় ফিরে ফিরে আসতো!
অন্যান্য শিক্ষকদের মতো ভোরবেলার পিটি কিংবা প্যারেডে ম্যাডামকে আসতে হতোনা ডিউটি মাস্টার হিসেবে। ডাইনিং হলে কিংবা প্রেপে অথবা বিকালে খেলার মাঠেও ঘামঝরা শরীরে হাজিরা দিতে হতোনা তাঁকে। মোটের ওপর কলেজের কোন হ্যাপাই তাঁকে পোহাতে হতো না। সপ্তাহে দিন দুই তিনি বাড়ি থেকে আয়েস করে ঘুম থেকে উঠে গোসল টোসল সেরে আমাদের ক্লাস নিতে আসতেন। ম্যাডামের মাঝে বেশ একটা আমুদে ভাব ছিল, তিনি ক্লাসে পা দেয়া মাত্র মনেহতো আমরা যেন সুগন্ধি হাস্নুহেনার বাগানে বেড়াতে এসেছি! কী যেন ফুলেল একটা পারফিউম ব্যবহার করতেন ম্যাডাম, তারই সুগন্ধ ছড়িয়ে পরতো আমাদের বর্ণগন্ধহীন ক্লাস রুমে! তিনি সাজতে ভালবাসতেন। শিফন কিংবা জর্জেট শাড়ির সাথে মিল করে হাতাবিহীন সরু ফিতের ব্লাউজটি তাঁর পরা চাই। আই লাইনারে চোখ এঁকে ম্যাডাম গাঢ় রঙের শেড পরতেন। তিনি যখন হাসিমুখে আমাদের ক্লাস রুমে এসে দাঁড়াতেন আমরা খানিক নড়েচড়ে বসে তাঁকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতাম। একদিন গোলাপী শাড়ির সাথে কেন তিনি সাদা রঙের ব্লাউজ পরলেন জানতে চেয়েছিল হিনু। ম্যাডাম ফিক করে হেসে বললেন, গোলাপী ব্লাউজটা আজ খুঁজে পেলাম না যে!
ইয়ং কিং
ঢাকার বন্ধুদের কেউ কেউ ছুটি থেকে ফিরে এসে চিনে রেঁস্তোরায় খাবার গল্প বলে। চিনে দোকানে খাবারের ব্যাপারটি নিয়ে অতি উচ্ছাসের ব্যাপারটি আমার ঠিক মাথায় ঢোকেনা। কলেজের প্রায় উল্টো দিকে তখন সবে ইয়ং কিং নামের একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট খুলেছে, ছুটিতে আমরা ভাইবোনেরা বাবা মায়ের হাত ধরে সেখানে খেতেও গিয়েছিলাম; কিন্তু সেটি আমার খুব যে ভাল লেগেছিল তা হলফ করে বলতে পারি না। খানাপিনার ব্যাপারটি আমার কাছে নিত্যদিন দাঁত মাজার মতো একটা আবশ্যকীয় কাজ মনে হয়, এটি উপভোগের কিছু নাই, নিতান্তই করতে হয় বলে করা! চিনে রেঁস্তোরার নিভু নিভু আলো আমার কাছে পীড়াদায়ক মনে হয়েছিল। আমি শেয়াল পন্ডিতের মত পাওয়ার ওয়ালা ফটোক্রমিক লেন্স পরতাম। খরখরে দুপুরে রোদ মাথায় নিয়ে ইয়াং কিং এ চশমা পরে ঢোকা মাত্র আলো আঁধারের তেলেসমাতিতে আমি কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম! আমরা বাড়িতে শোবার ঘরে নীল রঙের ডিম লাইট জ্বেলে ঘুমাতাম। চিনে দোকানে দেখি লোকজন ডিম লাইট জ্বেলে খানাপিনা করে! সব সামলে সুমলে খেতে বসে ময়দায় ভাজা লিকলিকে মুরগীর রান ভাল লাগলেও অন্য কিছু তেমন জুতের বলে মনেহলো না। পেঁপে-শসার মিশেলে ‘লসলসা’ একখানা সব্জীর গল্প শুনতাম বন্ধুদের কাছে। কলেজের সব্জী মুখে না রুচলেও অনেকেই দেখি চিনে স্টার ফ্রাইড ভেজি আগ্রহ নিয়ে খেতো। ভাতের মাড়ের মতো ঘন ঝোল ঝোল পেঁপে-শসার সব্জীর যতো মনভুলানো নাম থাকুক না কেন সেটি আমার গলা দিয়ে নামে নাই। আমি খেলাম লাল লাল চিংড়ির একটা কিছু; তার একটা বাহারি নামও আছে, সুইট এ্যান্ড সাওয়ার প্রণ!
ইয়ং কিং এর খাবারের সুঘ্রাণ কলেজ অব্দি পৌঁছুতেই করিমউদ্দীন স্যার বললেন, পুরো ময়মনসিংহের মানুষ চিনে খাবার খাবে আর আমার ক্যাডেটরা তা খাবেনা এটি কেমন কথা! প্রিন্সিপ্যাল স্যারের নির্দেশে এ্যডজুটেন্ট স্যার নিজে গিয়ে জায়গাটি সরেজমিনে দেখে এসে জানালেন যে, ইয়ং কিং আকারে ছোট, সেখানে সব ক্যাডেটদের স্থান সংকুলান হবেনা। করিমউদ্দীন স্যার অগত্যা রেঁস্তোরার কর্ণধারদের কলেজে ডেকে পাঠালেন। সবার সাথে কথা বলে ঠিক হলো যে, ইয়ং কিং এর কিচেন ক্রু এসে আমাদের কিচেনে রান্নাবান্না করবে।
এক সপ্তাহ আগে ডাইনিং হলে আমাদের চিনে খাবারের ঘোষণা দেয়া হলো। স্যারের ঘোষণার সাথে সাথে আমরা উল্লাসে ফেটে পড়ি। তারপর পুরো সপ্তাহজুড়ে আমাদের আলোচনায় চিনে খাবারের প্রসংগ এসেছে নানা ছলছুতোয়। কলেজে বেশ একটা ঈদ ঈদ আমেজ চলে এলো। আমাদের কেউ একজন গল্প বললো, চাইনিজ খেতে গিয়ে কি করে ওদের গাঢ় লাল ন্যাপকিনটি গলায় নিয়েই বাড়ি ফিরে এসেছিল। অনেক জল্পনা কল্পনার পর অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। ঈষৎ পরিপাটি হয়ে ডাইনিং হলে গেলাম সেদিন। আমাদের অনেকেই তখনো চিনে খাবারের স্বাদ নেয় নি কখনো। প্রিন্সিপাল স্যার চলে এলেন আমাদের আগেই। আজকের রাতটি অন্য সব রাতের মতো নিরানন্দ নয়। রিপা আপা টেবিলে বসেই বললেন, ‘চাইনিজরা তো সাপ ভাজা খায়, আমাদেরও কি বাচ্চা ঢোঁড়ার ফ্রাই খেতে হবে সয়া সসে ডুবায়ে?’
আমাদের বাচ্চু
আফরিনকে আমি বাচ্চু বলে ডাকতাম। ওর ডাক নাম বাচ্চু ছিল নাকি বন্ধুদের দেয়া নাম ছিল বাচ্চু সেটি এখন আর মনে পড়ে না। তার ছোট করে ছাঁটা চুলে পালা পার্বণে তেল জলের ছোঁয়া লাগলেও বছরের বাকী সময় টুকু সে নিজের মত করেই থাকতো! বাচ্চু পড়াশোনায় চৌকশ ছিল যদিত্ত পড়াশোনার মত তুচ্ছ বিষয়ে ভাবনার মত ফুরসত তার কমই মিলতো। জগতসংসার উদ্ধারপ্রক্রিয়ার যাবতীয় গুরত্বপূর্ণ কাজে সে নিজেকে সদা ব্যস্ত রাখতো! তার বিচিত্র উদ্ভাবনশীলতা আর যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেবার কারণে বন্ধুদের কাছে সমীহের পাত্র ছিল সে। আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে ঠা ঠা শব্দে হাসতো বাচ্চু। টার্ম ফাইনাল কিংবা মাধ্যমিক যে পরীক্ষাই চলুক না কেন সবকিছুকে থোড়াই কেয়ার করে প্রচন্ড হট্টগোলের মাঝেও হাত পা ছড়িয়ে নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারতো সে। তারপর এক সময় পরীক্ষার দামামা বাজলে আমাদের বাচ্চু মিয়া খানিকটা বেকায়দায় পড়ে যেতো; তখন সে নাওয়া খাওয়া ভুলে দিনরাত প্রেয়ার রুমের কোণায় বসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়া তৈরী করতো। বাচ্চুর তখন অন্য চেহারা। সে তখন কাওকে চিনতে পারে না। এক মাথা ঝড়ো কাকের চুলে চিরুনি দেবার মত অবকাশ মেলে না তার; রাতজাগা চোখে কালিমা পরতো, ঠোঁট ফেটে চৌচির!
একবার আমার উথালপাথাল টাইপের মাথা ব্যাথা হলো। আমাদের সময়ে মাথা ব্যাথা কি পেটে ব্যাথার মতো মামুলী কারণে মুড়ি মুড়কির মতো ওষুধপথ্য খাবার চল ছিল না। মাথা ব্যাথা হলে বন্ধুদের কেউ একজন মাথা বা কপালে দুটো চারটে ঠোকাঠুকি মেরে দিলেই ব্যাথা পালিয়ে যেতো। এক ছুটির সন্ধ্যায় আমি মাথা ব্যাথায় কাতর হয়ে রুমে বসেছিলাম। বন্ধুরা চুপ করে শুয়ে থাক্ এর দাওয়াই দিয়ে নিজেরা টিভিতে এ সপ্তাহের নাটক দেখতে গেল সদলে। বন্ধুদের কোন দোষ দেয়া চলে না। আমাদের পুরো সপ্তাহের একমাত্র বিনোদন ছিল এই নাটক। আফজালের হাসিটা টানতো ভীষণভাবে। পেট খারাপ কি মাথা ব্যাথার মত তুচ্ছ অজুহাতে নাটক বাদ দেয়া চলে না! সবাই চলে গেলে আমি রুমের আলো নিভিয়ে একখানা চেয়ার টেনে জানালায় হেলান দিয়ে গোমরা মুখে বসে রইলাম। এমন সময় টিভি রুম থেকে কি মনে করে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজার মত বাচ্চু এলো আমার শুশ্রুষায়। ও এসেই বড় বাজারের হরেন নাপিতের মত ঘাড়ে গর্দানে সশব্দে গোটা দশেক চাটি মেরে আমার ঝিমোনো ভাবটি দূর করে দিল। খানিক পরে কোথা থেকে যেন লাল রঙের আধা ইন্চি আয়তনের গোল মত একটা কৌটো নিয়ে এলো; নাম টাইগার বাম। তারপর নিজে বাথরুমের পানিতে হাত ধুয়ে এলো। ঠান্ডা হাতে টাইগার বাম ঘসে সে সুনিপুণ কারিগরের মত কখনো কপালে, কখনো ঘাড়ে, কখনো বা ভুরুতে চক্রাকারে টাইগার বাম মালিশ করতে লাগলো। টাইগার বামের মৃদু ঝাঁজে আর বাচ্চুর মাসাজের যাদুতে আমার দু চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলো।
একাদশ শ্রেণীর বিশেষ ব্যাচ
উনিশশো তিরাশির মাঝামাঝি সময়ে একাদশ শ্রেণীর বিশেষ একটি ব্যাচ আমাদের কলেজে আসে। এতোদিন আমরা আমরাই কলেজের হর্তাকর্তা বিধাতা গোত্রের ছিলাম। এবার নতুন ক্লাসটি এলে আমরা পুরনোরা ঈষৎ কোনঠাসা হয়ে পড়লাম। শেয়াল বনে এতোদিন শেয়াল রাজাই ছিল; এবার বাদা বনে বাঘ আসার সংবাদে আমরা ঈষৎ সংকুচিত হয়ে পড়ি।
নবাগত ব্যাচে মোটে ত্রিশজন ক্যাডেট, হারাধনের ছেলের মত কমতে কমতে পরে তাদের সর্বমোট সংখ্যা দাঁড়ালো ছাব্বিশ জনে! নবাগত আপাদের তুলনায় আমরা খানিকটা অভিজ্ঞ ছিলাম ক্যাডেট কলেজ বিষয়ে, কিন্তু সিনিয়রদের তো আর সবক দেবার চল নেই কলেজে; তাই আলম স্যার আপাদের কলেজের কায়দাকানুন শেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এতোদিন আশরাফ আলী স্যারের কন্যা সাবরিনা ইশরাত আপা ক্যাডেট নম্বর এক হওয়ার সুবাদে আমাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন; এখন বড় ক্লাস এসেছে মাথার ওপর, তাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। সাবরিনা আপা স্বল্পভাষী, নির্বিরোধী মানুষ; ক্যাডেটদের নেতৃত্ব দেবার মত উটকো ঝামেলার হাত থেকে রেহাই পেয়ে তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। কলেজ প্রশাসনের ইচ্ছাতে মারিয়াম বেগম আপা আমাদের প্রথম কলেজ প্রিফেক্ট হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।
টুকটুকির মন ভাল নেই
পড়াশোনায় টুকটুকির মন ছিল না, সে খেলাধুলায় ভাল ছিল। কলেজ বাস্কেট বল টিমে খেলতো সে। টুকিটুকি শান্ত শিষ্ট, লক্ষীমন্ত মেয়ে। কারো সাতে পাঁচে নাক গলাবার শিল্পটি সে আয়ত্ব করতে পারেনি কখনো। বাবা সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন বলে এ্যাডজুটেন্ট স্যারের অফিসে তার অবাধ যাতায়াত ছিল। মন চাইলেই সে বাড়িতে ফোন কল করতে পারতো। ওর এই যথেচ্ছ ফোন করার স্বাধীনতার ব্যাপারটি আমাদের মত বেসামরিক ক্যাডেটদের কিন্চিত মনোকষ্টের কারণ ছিল। একবার ঢাকা, ময়মনসিংহ সহ আশেপাশের কয়েকটি শহরে প্রচন্ড ঝড় হলো। দমকা হাওয়ায় বড় বড় গাছপালা উল্টে পড়লো এখানে সেখানে। বিদ্যুত চলে গেল আচমকা। ঘরবাড়ির টিনের চাল উড়ে গিয়ে পড়লো অনেক দূর। বিকেলবেলা ঝড় থেমে গেলে আমাদের খবর জানতে চেয়ে অনেকেরই কল এসেছিল বাড়ি থেকে। কলেজে কারণে অকারণে ফোন করার বিধিনিষেধ থাকলেও সামরিক অফিসারদের কন্যাদের ঠিকই ডেকে দেয়া হয়েছিল কথা বলার জন্য। টুকটুকি রুমে এসে মাথা নেড়ে নেড়ে বলছিল ঝড়ের সময় ওর বাবা কি করছিল, মা কতটা ভয় পেয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। মিলি আপা এক ধমকে টুকটুকিকে থামিয়ে দিয়েছিলেন গল্পের মাঝে! বড় হওয়ার পরও বাড়ির জন্য টুকটুকি কান্নাকাটি করতো খুব, রুমে বেচারা মুখ অন্ধকার করে চুপচাপ বসে থাকতো। দিনের পর দিন তার কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করেও আমরা কখনো তার সদুত্তর পাইনি।
আমাদের সিনিয়র একজন আপা অন্য হাউস থেকে এসে নানা কায়দায় ওর মন ভাল করতে চাইতো। আপা তাদের ব্যাচের নেতা গোছের মানুষ। লিকলিকে সাপের মত লম্বা বিনুনিতে ছন্দ তুলে চলাফেরা করতেন; আমি তাকে ভীষণ ভয় পেতাম। কদাচিৎ যদি তার সামনে পরে যেতাম তবে কোন পথে পালানো যায় সেটি নিয়ে ভাবনার অন্ত ছিল না। আপা আমাদের রুমে এসে আমাকে রুমের দক্ষিণের জানালা ঘেঁসে সাবধানে দাঁড় করিয়ে রেখে টুকটুকির চুলে হিমকবরী তেল মেখে দিতেন, যত্ন করে নখ কেটে দিতেন। রিপা আপা ঈষৎ বিদ্রোহী মানুষ ছিলেন, তিনি পেট কামড়াচ্ছে বলে দুই হাতে বুক পিঠ চেপে ধরে বাথরুমে যাবার নাম করে রুম থেকে লাপাত্তা হয়ে যেতেন!
বাপ-বেটির সময়
ঘুম থেকে উঠবার জন্য আমার বাবার এলার্ম ঘড়ির দরকার পড়ে নাই কখনো। তিনি মস্তিষ্কঘড়ির কাটা মেনে চলা মানুষ। কখনো কোথাও দেরী করে যাবার রেকর্ড নাই তাঁর। দুপুর দুইটার দাওয়াতে তিনি পৌঁছে যান পাক্কা পনের মিনিট আগে। নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল গৃহকর্তা সালাদের জন্য স্বদেশী বাজারে শসা খরিদ করতে গেছেন, সাথে লেটুস পাতা পেলে ভাল, না পেলে ক্ষতি নাই! ফিরতি পথে ঠান্ডা কোকাকোলা কিনে আনবার কথা তার!
ফজরের নামাজ পড়ে বাবা দোতলার বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে কোরান তেলাওয়াত করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর দশেক আগে দাদার তৈরী করা গোটা দুই স্কুল নিয়ে তাঁর মাতামাতি ছিল দেখবার মত। উত্তরাধিকার সূত্রে আমার বাবা স্কুল বোর্ডের সভাপতি। সভাপতির কাজ বলতে তেমন কিছু নাই। ছয় মাস অন্তর অন্তর স্কুল বোর্ডের একটা মিটিং হয়। বাবা এই মিটিঙে সভাপতিত্ব করেন। মিটিং শেষে প্রধান শিক্ষকের বাড়িতে সামান্য ‘ডাল ভাতের’ নিমন্ত্রণ থাকে তাঁর। তিনি এবছর স্কুল চত্বরে পুকুর কাটিয়ে মাছ চাষ করালে পরের বছর নিজের উদ্যোগে সেগুন বাগিচা বানানোর প্রকল্প হাতে নেন। ছেলেমেয়েদের কথা বলার জড়তা ভাঙাতে গ্রামের হাই স্কুলে বাবা নিজের খরচে একখানা অডিটোরিয়াম বানিয়ে ফেললেন। এবার বাবার ছাত্ররা ডায়াসে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেবে, দেবতার গ্রাস আবৃত্তি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে!
ছুটিতে এসে বাবার হাত ধরে আমাদের বড় স্কুলটিতে যাই। মুক্তাগাছায় গাড়ি থেকে নেমে ছাত্রদের জন্য কখনো মন্ডা, কখনো জিলাপি কিনি। আমার বয়স তের হলে কি হবে, প্রধান শিক্ষক নুরুল হক সাহেব অতি বিনয়ের সাথে কথা বলেন। ‘আম্মা, যাত্রায় কুন কষ্ট হয় নাই তো? মুখটা মলিন দেখাইতেছে’ বলেই দপ্তরী হারুনকে টিউকলের ঠান্ডা পানি আনতে পাঠান। সভাপতি সাহেব কন্যা সমেত আজ স্কুলে আসবেন এটি তার জানা উচিত ছিল। শহরের গন্য মান্য অতিথিদের এখন তিনি কি দিয়ে আদর আপ্যায়ন করবেন! একটায় টিফিনের সময় হয়ে এলে ছেলেপিলেদের মাঝে মিষ্টি বিলাই। গল্প বলি। এই সামান্য কাজটি করতে পিতা-পুত্রীর বিমলানন্দ হয়। হারুন চাচা এর মাঝে হাতে ডাব ধরিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলেন, ‘ভিতরে সর আছে। আপনে চাইলে কাইটা দিমুনে!’ বাবা মা সবাইকে ছেড়ে একা একা ক্যাডেট কলেজে থাকি বলে ছাত্রদের বিস্ময়ের শেষ নাই। মুখ আলগা একজন বলে বসলো, ‘আফনেরে দ্যাখলে তো ভালা মানুষই লাগে; কি করছিলাইন যে এক্কেরে হুস্টেলে দিয়া দিল?’
অসাধারন ছোট বেলা কাটিয়েছ আপু। লিখাটাও অসাধারন হয়েছে। নিলুফার ম্যাডাম এই বর্ণনা পড়লে খুশী হয়ে যেতেন। :clap:
🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂
নিলুফার ম্যাডামের সাথে আমার যোগাযোগ নাই। ম্যাডামের কন্যা একদা আমার রুমমেট ছিল। বলা তো যায় না, এমেকের পাতা থেকে কন্যার হাত ঘুরে আমার সামান্য এই লেখাটি ম্যাডামের কাছে পৌঁছে গেলেও যেতে পারে!
পড়ে এসে মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ, প্রিয় জিয়া। আশাকরি ভাল আছো।
নিলুফার ম্যাডাম এর কল্পিত সৌন্দর্যে যতটা না, তার সৌ্নদর্য সম্পর্কে তোমার এ্যাপ্রিশিয়েটিভ বর্ণনায় তার চেয়ে বেশী মুগ্ধ হ'লাম।
পৃথুলা -- ভাল শব্দচয়ন, নতুন শিখলাম এবং আমার বাঙলা শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হলো।
আমাদের কেউ একজন গল্প বললো, চাইনিজ খেতে গিয়ে কি করে ওদের গাঢ় লাল ন্যাপকিনটি গলায় নিয়েই বাড়ি ফিরে এসেছিল -- 🙂
‘আফনেরে দ্যাখলে তো ভালা মানুষই লাগে; কি করছিলাইন যে এক্কেরে হুস্টেলে দিয়া দিল?’ - 🙂
ক্যাডেট কথিকা নামটা গ্রহণ করার জন্য ধন্যবাদ।
বাচনশৈলী (লিখনশৈলী) বরাবরের মত চমৎকার। উন্ম্যখ শ্রোতারা মুগ্ধ হবে, সন্দেহ নেই।
🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂
নিলুফার ম্যাডাম অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন। ক্যাডেট কলেজের বৈচিত্রহীন একঘেয়ে জীবনে নিলুফার ম্যাডাম ছিলেন খরতপ্ত দিনের শেষে এক পশলা বৃষ্টির মত! আমাদের আবদার আর আহ্লাদীপনার শেষ ছিল না তাঁর কাছে। তবুত্ত ম্যাডাম মুখে হাসি লেগেই থাকতো!
পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ, কবি। আপনাদের প্রশ্রয় আর ভালবাসার কাছে সতত ঋণঝুঁকি থেকেই যায়!
:boss:
আপা সবসময়ের মতো খুব সাবলীল আর প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর একটা লেখা. আপনার স্মৃতির ট্রেনে চেপে পুরোনো সময়ে ঘুরে আসতে খুব ভালো লাগে.
🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂
কিকি, আমাদের গল্পগুলো তোমাদের থেকে খানিকটা আলাদা হলেও গল্পের মূল সুর তো অভিন্ন। পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ, ছোট বোন। আশাকরি ভাল আছো।
অনেক সুন্দর বর্নানা ছিল আপা,
টুকটুকি আপার মন খারাপ পড়ে আমারো কিছু স্মৃতি মনে পরে গেল,সেসব কথা থাক না গোপন...
আর এমজিসিসির ক্যাডেট নাম্বার এবং ব্যাচের হিসাবে আমার গোলমাল লাগত,
আজকে পরিষ্কার হল। (সম্পাদিত)
🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂
ছোটভাই, কিছু কথা গোপন করবারই বা কী দরকার? মনের কথাগুলো লিখে ফেল আমাদের জন্য। ভাল মন্দ মিলিয়েই তো মানুষ। আমরা নিয়ত ঈশ্বর খুঁজে বেড়াই যাঁর কোন দোষ নেই। মানুষকে কেউ চায় না। সবাই ঈশ্বর চায়! ঈশ্বর খুঁজতে গিয়ে আমরা তো জীবনে শয়তানের দেখাও পাই, তাইনা?
ক্লাস ইলেভেনের এক ছুটিতে আমরা কয়েকজন নন-খুলনা পার্টি খুলনায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। খুলনার স্ট্যান্ড করা পার্টি আমাদের চাইনিজ খাওয়াবে- এজন্য অনেক আগে থেকেই এটার প্ল্যান করা ছিল। যাই হোক, আমরা প্রায় ২০-২৫ জন নামকরা এক রেস্টুরেন্টে গেলাম। অর্ডার করা থেকেই শুরু হল বিপত্তি! ওয়েটার আমাদেরকে মেন্যুর স্পেশাল ভেজিটেবলের কথা বলতেই শুরু হল আক্রমণ- ''সারা জীবন কলেজে ভেজিটেবল স্পয়েল করে আসলাম, আর আপনি কী না ভেজিটেবল খাইতে কন! ভাজা-পোড়া টাইপ কী আছে বলেন!''
সবচেয়ে মজা হয়েছিল খাওয়ার সময়। এখনকার ওয়েটাররা অনেক স্মার্ট, যে কোন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু সেই সময়ে, বিশেষ করে খুলনার মত শহরে চাইনিজের ওয়েটাররা খুব সিরিয়াস ছিল। ''মামা, টক (সস) আর নাই? আরও দিয়ে যান!'' কথাটাকে তারা কোনমতেই হাল্কাভাবে নিতে পারে নি! পুরোটা সময় মুখ ভার করে ছিল...
আপা, তোমার লেখা পড়ে খুলনার চাইনিজ খাওয়ার সেই মজার স্মৃতি মনে পড়ল!
লেখা গোগ্রাসে গিলছি... 🙂
ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ
🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂
সিলেটের লোকজন টক কে ট্যাংগা বলে। ট্যাংগার উচ্চারণ স্থান ভেদে ঠ্যাংগা অব্দি গড়ায় জানিস তো? তো, এক সিলেটি এসেছে আমাদের মুমিসিঙে। তোদের মতই খানিক ফিচেল সে। রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে বললে, ঠ্যাংগা আছে নি বা? ইট্টু ঠ্যাংগা আনুইন নি বা ঠেংরি (চিকেন লেগ) দিয়া খাইতাম!
অনেক ধন্যবাদ পড়বার জন্য, ছোটভাই। ভাল আছিস আশাকরি।
সাবিনা আমার ডাইরেক্ট ছাএী। ওর কথা আমার খুব মনে আছে। ওর লিখাগুলো আমি গভীর আগ্রহে পড়ি এবং খুব উপভোগ করি। অসাধারণ ওর প্রতিটি লিখনি। তবে, এবারে ওর লিখার একটু শুধরে না দিয়ে পারছি না। মেয়েদের কলেজ বলে আমি অনেক কিছুই নিয়মের বাইরে করতাম এ্যাডজুটেন্ট হিসেবে। আমি জানতাম, বাবা মায়েরা তাদের কন্যাদের কলেজে পাঠিয়ে কত টেনশনে থাকতেন। তাই কেউ কখনো কল করে তার মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইলে, আমি কখনো নিষেধ করেছি বলে মনে পড়েনা। হতে পারে তার বাবা সামরিক কিবা বেসামরিক সেটা আমি কোনদিন ভেদাভেদ করিনি। সব কথা সাবিনার জানার কথা নয়, তাই হয়তো সে এ বিষয়ে সঠিক জানতো না। তবে যাই হোক, সাবিনার সাবলিল লিখনির আমি খুব ভক্ত। ওর জন্য আমার চিরদিন ভালবাসা আর শুভেচ্ছা চলমান থাকবেই।
সালাম, স্যার! আপনি যে আমার সামান্য ব্লগ পোস্টগুলো পড়ছেন এবং তা জানান দিতে এখানে মন্তব্য করছেন তাতে আমি ভীষণ সম্মানিত বোধ করছি। আমার এলেবেলে লেখালেখি স্বার্থক বলতে হবে।
আপনি জানেন যে তের বছর বয়েসী বালিকার মত অভিমানী আর বিদ্রোহী কেউ নাই এই জগত সংসারে। তার সদা ক্ষুব্ধ মনে অভিযোগের অন্ত নাই; এবং পৃথিবীর সকলে যে কেবল তাকেই উপেক্ষা করছে সেটি কি আর অজানা কারো? মা বড় ভাইকে মাছের মুড়ো কেন দিয়েছে এ নিয়ে যেমন তার অভিযোগ আছে তেমনি আপত্তি আছে ছোট বোনটিকে কেন বাবা মেলায় নিয়ে গেল একাকী সেটি নিয়েও! কলেজে কত কারণেই তো মনে কষ্ট পেয়েছি; আবার কত অসংখ্য কারণে প্রজাপতির মত উড়েঘুরে বেড়িয়েছি আনন্দে! আমার লেখাটি একটি অষ্টম শ্রেণীর ক্যাডেটের স্মৃতিচারণ বৈ অন্য কিছুই নয়। আমার জেনে ভাল লাগলো যে আপনি সনাতন রীতিনীতির পরোয়া করেন নাই কলেজে এবং সবার প্রতি সমান মনোযোগ দিয়েছেন। আমার লেখায় কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করা হয়নি, কিংবা কাওকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোও হয়নি। আপনি যেমন আপনার নীতিনির্ধারণে এবং সেটির বাস্তবায়নে সৎ ছিলেন তেমনি তের বছরের বালিকারাও তাদের মান অভিমান, অভিযোগ এবং মনোঃকষ্টের প্রেক্ষিতে সামান্য ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারে!
ক্যাডেট কলেজে তিনশো জনের মাঝে টিকে থাকবার যে সংগ্রামের গল্পটি অনেকাংশেই অলিখিত থেকে যায়। আমি এখানে আমাদের সংগ্রাম কিংবা সনাতন বন্ধুতার গল্প বলতে আসি নাই। অনেককিছুই ভুলে গেছি আজ, আবার অনেক কিছু আজো স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল! আমি সতত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলি, আপনি সহ আমাদের অন্যান্য শিক্ষকেরা আমাদের কলেজটি প্রতিষ্ঠিত করতে যে পরিশ্রম করেছেন তার ঋণঝুঁকি আজীবন থেকেই যাবে। শোধ হবে না।
স্যার, এমজিসিসির প্রশাসক হিসেবে আমার লেখাটি পড়েছেন জানি, এবার একজন এক্স ক্যাডেট হিসেবে আর একবার এই লেখাটি পড়ে দেখুন, তখন মনে হলেও হতে পারে, এটি আপনার স্মৃতিচারণ নয়তো? আজ সূর্য যখন মধ্য গগনে তখন ফিরে তাকাবার গল্পই হলো এই ক্যাডেট কথিকা। এটি অভিযোগ কিংবা অনুযোগের কাহিনী নয়! এটি আমাদের বোধের গল্প, আমাদের বেড়ে ওঠার গল্প। কিশোরী থেকে তারুণ্যের যাত্রার গল্প!
ভিন্নমত এবং ভিন্নপথের গল্প শুনতে আমি দারুণ উপভোগ করি। আপনি বলেছিলেন আপনার গল্প লিখবেন অচিরেই। আমি অপেক্ষায় রইলাম, স্যার।
বয়েজ কলেজের নিলুফার আপারা কাটখোট্টা হয়। :/ :awesome:
‘আফনেরে দ্যাখলে তো ভালা মানুষই লাগে; কি করছিলাইন যে এক্কেরে হুস্টেলে দিয়া দিল?’ =)) =)) =)) :bash: :bash: :pira2: :duel:
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য