মার্চের কুড়ি, উনিশশো তিরাশি। গতকাল বাবা মায়েরা আমাদের কলেজে রেখে গেছেন। রাতে প্রায় কারোর ভাল ঘুম হয়নি। অচেনা একটি ভোরবেলায় ঘন্টা বাজলো ঢং ঢং করে। প্রথমে ঠাহর করতে পারি না কোথায় আছি। চোখ রগড়ে ইতিউতি তাকাতে মিলি আপাকে দেখতে পেলাম। আমাদের বেডগুলো খাট আর চৌকির মাঝামাঝি কিছু একটা। পাশ ফিরে শুলে বেশ একটা ক্যাচর ম্যাচর আওয়াজ হয় দেখি। আটজন ক্যাডেটের ডর্মে দুই বাথরুম আর দুটো টয়লেটে সকালবেলা বেশ একটু নীরব ঠেলাঠেলি হলো আমাদের মাঝে। এই হট্টগোলের মাঝে কারো কারো সময় এতো বেশী লাগলো যে আমি ভাবছিলাম হয়তো দাঁত না মেজেই বাইরে যেতে হবে। আমাদের তখন সাদা সালোয়ার কামিজই ভরসা। পাখীর বাসার মত চুলগুলোতে কোন রকমে চিরুণী চালিয়ে তৈরী হতে না হতে বাঁশীর তীক্ষ্ণ আওয়াজে নীচতলায় যাবার ডাক পরলো। আমরা ছুটতে ছুটতে নীচে নেমে হাউসের সামনে কলাপসিবল গেটের পাশে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকি। অচিরেই কান অবধি লম্বা চুল ঝাঁকিয়ে, পেনসিল হিলে ছন্দময় আওয়াজ তুলে মুনিম ম্যাডাম হাজির হলেন। তার পরনে সাদা শাড়ি আর চোখে বড় ফ্রেমের চশমা। আমাদের উদ্দেশে ছোটখাট একখানা বক্তৃতা দিয়ে বললেন, নাও ইউ আর গোয়িং টু দ্য প্যারেড গ্রাউন্ড ফর মর্ণিং এক্সারসাইজ। বাইরে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি পরছে তখন। খুব জরুরী কাজ না পরলে বৃষ্টিতে আমরা বাইরে যাবার কথা কেউ ভাবতে পারিনা। পিটি করা কি এতোটাই জরুরী? আমরা বাতাসের দু’একটা ঝাপটা দেখতে পাই গাছের পাতার নাচনে। কেউ একজন খুব মৃদু কন্ঠে বললো, বাইরে ‘বিষ্টি’ পড়ে ম্যাডাম! মুনিম ম্যাডাম খানিক উঁচু লয়ে উত্তর দিলেন, সো হোয়াট!
আমরা বাবা মায়ের আদরের কন্যারা জীবনে সো হোয়াটের মুখোমুখি হই নাই কখনো। আকাশে মেঘ করলে বাবা ছাতা ধরেছে মাথায়, দু’চারটে বৃষ্টির ফোঁটা পরলে অতি ব্যাকুল মা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিয়েছে। বারো বছর অব্দি যে মেয়ে এক গেলাস জল তুলে নিজে পান করে নাই, সেই মেয়ে এক সো হোয়াটে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি উপেক্ষা করে পিটি করতে দৌড়ে গেল গ্রাউন্ডে। কলেজে আসার চব্বিশ ঘন্টারও কম সময়ে সুনিপুণ কাঁধ ঝাঁকুনির এক ‘সো হোয়াট’ আমাদের অকস্মাৎ অন্য মানুষ বানিয়ে দিয়ে গেল!
সাদা সালোয়ার কামিজ আর ক্যানভাস শ্যু পরে যেদিন আমরা একাডেমিক ব্লকে গেলাম সেদিন অনেকের মাঝেই বেশ একটা ঈদ ঈদ ভাব চলে এলো। হাজার হোক ক্যাডেট কলেজে তো আমরা পড়াশোনা করতেই এসেছি, নাকি? প্রতি ব্যাচেই অতি সিরিয়াস কিছু ক্যাডেট থাকে, তাদের ধ্যানী চোখে বইয়ের পাতারা নিয়ত ডাংগুলি খেলে একমনে। আমাদের মাঝেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এসে অবধি পড়াশোনার কোন কথাবার্তা হয় নাই। অনেকেই দেখি উশখুশ করছে এই নিয়ে। একাডেমিক ব্লকে দোতলার বড় একটা রুমে আমরা সবাই এসে জড়ো হলাম। এই প্রথম ক্লাসের সবাইকে একসাথে পাওয়া গেল। আমাদের প্রাথমিক পরিচিতির পর প্রথমেই ফর্ম আলাদা করা হলো। ফর্ম ভাগাভাগির ব্যাপারটি শেষে দেখা গেল আমাদের সদাচার হাউসের সবাই এ ফর্মে পরেছি। যাদের সাথে এক হাউসে থাকি তাদের আবার এক ফর্মে পেয়ে যারপরনাই খুশী হলাম। আমাদের এ ফর্মের ক্লাসরুমটি বেশ প্রশস্ত, সেখানে অনেকগুলো কাঁচের জানালা আছে। জানালায় চোখ রাখলে পায়ে হাঁটা পথ চোখে পরে। অদূরে একটা পুকুর, একটা নিঃসঙ্গ ইউক্যালিপটাস গাছ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। বিদ্যাময়ী স্কুলে আমাদের ক্লাসটিতে অনেক মেয়ে ছিল, এক বেনচে্ তিন বা চারজন চাপাচাপি করে বসতে হতো। এখানে আমাদের সবার আলাদা ডেস্ক আছে। বইপত্তর ডেস্কে রেখে তার ডালাটি লাগাতে হয়; বেশ মজাতো!
ঈদের আনন্দ বেশী দিন চললো না। তৃতীয় দিন ভিপি স্যার এসে বললেন, ক্যাডেটস গেট আ ফ্রেশ পিস অফ পেপার এ্যান্ড আ পেন। ইন টু মিনিটস ইয়োর ফার্স্ট টেস্ট উইল বিগিন! স্যারের কথা শুনে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পরবার উপক্রম হলো। রুবাইয়া বললো, স্যার আমরা তো সিলেবাস জানি না, কি করে পরীক্ষা দিবো? রুবাইয়া আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। তার মতামতের একটা দাম আছে। ওর দেখাদেখি আমরা প্রায় সবাই মিনমিন করে রুবাইয়ার কথায় সায় দিয়ে বললাম, পড়া ছাড়া পরীক্ষা ক্যামনে দেই? আমাদের কথা শেষ হওয়ার আগেই স্যার ডান হাত তুলে বললেন, গেট এ পিস অব পেপার নাও! পরীক্ষা হলো বাংলা, ইংরেজী আর অংকে।
আমাদের এ ফর্মে ঝর্ণা ম্যাডামকে পেলাম ফর্ম টিচার হিসাবে। ছিপছিপে লম্বা, দীঘল চুলের ম্যাডাম তাঁর মৃদু হাসি আর আন্তরিকতা দিয়ে প্রথমদিনই আমাদের সবাইকে আপন করে নিলেন । আমি ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে ক্যাডেট কলেজে পড়তে এসেছি। আমাদের জেলা শহরে বিদ্যাময়ী স্কুলের নামডাক যথেষ্ট। সেখানে আমাদের বাংলা ক্লাসে লাকী আপা বাংলা পড়ান, অংক ক্লাসে আলম স্যার অংক কষান কিন্তু সব ক্লাসের সমন্বয়কারী কেউ ছিলনা। লাকী আপা জানতেন না আলম স্যারের ক্লাসের গল্প, আবার আলম স্যার ঘুণাক্ষরেও বলতে পারতেন না লাকী আপার বাংলার গল্প। কলেজে ঝর্ণা ম্যাডাম আমাদের ক্লাসের সমন্বয়কারী শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে এলেন। দিনের শুরুতে ম্যাডামের সাথে আমরা গল্প করি। আমাদের সেই গল্প কখনো বিষয়ভিত্তিক হয় আবার কখনো বা ম্যাডাম নিজেই নানারকম গল্প বলেন। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুনো তরুণী ঝর্ণা ম্যাডাম ক্যাডেট কলেজের নিত্য খিঁচে থাকা কালাকানুন আর পদে পদে ভুল ধরে ভুরু কুঁচকানোর সময়টিতে ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া হয়ে এলেন!
আমরা তিন তলার বাসিন্দা ছিলাম বলে কলেজের চারপাশের রুপটি দেখতে পেতাম অন্যদের থেকে খানিক বেশী। আমাদের সেই দেখাটি পাখীর চোখে নদী দেখার মত হলেও সেটিই আমাদের জন্য অনেক ছিল। হাউসের সামনের ব্লকে দাঁড়ালে যত দূর চোখ যায় সবুজ ধানের ক্ষেত চোখে পড়তো। ডানে খানিক দূরে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা বিশাল উঠোনে ধান শুকাতো। পায়ের পাতা ডোবা জলে মেয়েরা ধান বুনতো বাঁশের ঝুপি কাঁধে নিয়ে। বিকালের মরে যাওয়া আলোয় কিশোরীর দল পরষ্পরের চুল আঁচড়ে দিতো বাড়ির আঙিনায় বসে। আমাদের বয়সী মেয়েগুলো এক একজন হেসে গড়িয়ে পরে পার্শ্ববর্তিনীর গায়ে। অদূরে তিনতলার হলওয়েতে দাঁড়িয়ে আমরা কি তাদের দেখে খানিক ঈর্ষান্বিত হই? আটপৌরে লাল হলুদ শাড়িপরা শহরতলীর বৌ ঝিরা কখনো খালি পায়ে মাড়িয়ে দিত ধান, কখনো বা বাঁশের কুলায় ফসলাদি ঝেড়ে কুড়োগুলো আলাদা করতো নিপুন হাতে। শেষ বিকেলের ক্ষয়ে যাওয়া আলোয় আমাদের নাগরিক চোখ অনভ্যস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো দূরে কোথাও! যে শহরটিতে আমি জন্মেছি এবং যে আলো হাওয়ায় বেড়ে উঠেছি সেই চিরচেনা পরিবেশ থেকে এসে সব কিছু নতুন লাগতো সেখানে।
ক্লাসের অবসরে সোমা আমাদের গান শোনায়। কী অদ্ভুত সুন্দর ওর কন্ঠ! ওর গানে ভরা পূর্ণিমার রাতে চাঁদ উছলে পরতো! সোমা যখন ‘প্রথম প্রদীপ জ্বালো’ গাইলো আমি খুব আফসোস করলাম মনেমনে। আহা! ওস্তাদজী সুনীল ধর কত বকাঝকাই না করেছেন তবুত্ত যদি একটু গলা সাধতাম! এ ফর্মে সোমা গান গায়, কেউ কবিতা শুনতে না চাইলেও আমি স্বরচিত কবিতা পড়ি। এ্যানি এমনিতে হাউসে মুখচোরা কিন্তু ক্লাসে দারুণ সব জোকস্ বলে। ও ম্যাডামদের নকল করে কথা বলতো অনর্গল। মুনিম ম্যাডামের মত ঈষৎ গ্রীবা নাড়িয়ে, চুল ঝাঁকিয়ে কথা বলতো এ্যানি। হাঁটতো খানিক দুলে আর ম্যাডামের মতই রিনরিনে গলায় ইংরেজী বাংলার মিশেলে কথা বলে বলে হাসাতো।
বি ফর্ম নাটক করেছিল ক্লাসে। নুসরাত ম্যাডাম ওদের ফর্ম টিচার। ক্লাসের সামনের বেনচ্ সরিয়ে সেখানে অভিনয় করবে ওরা। আমরা কয়েকজন ক্লাস পালিয়ে বি ফর্মের নাটক দেখতে গেলাম। নাটকের নাম সিরাজউদ্দৌলা। সবাই দেখি খুব সিরিয়াস, রাত জেগে সংলাপ মুখস্ত করেছে পড়া ফেলে। নাটকে কাকলীর একটি সংলাপের পর কনকের পালা এলো। কনক যাত্রা পালার মত চমৎকার সুর করে বললো, ‘নাআ নাআ নাআআ এ হতে পারে নাআ’! কনকের সংলাপ শেষ হতে না হতে, কাকলী বলে উঠলো, ‘কেন হতে পারে না কনক, আমি তো ঠিকই বলসি’! কাকলীর ‘আমি তো ঠিকই বলসি’ র সেই কাচুমাচু অভিব্যক্তি দেখে পুরো ক্লাসের সাথে আমরা ক্লাস পালানো পার্টিও হাসতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেলাম!
সকালবেলা নীচতলায় কলাপসিবল গেটের পাশে আদা কুচির সাথে ভেজা ছোলা মিশিয়ে রাখা হতো। আমরা প্যারেড গ্রাউন্ডে ফল ইন হওয়ার আগে এক মুঠো ছোলা হাতে নিয়ে দৌড় লাগাতাম। একদিন শর্মী বললো, দ্যাখ কলেজ আমাদের কেমন ঘোড়ার খানা খাওয়াচ্ছে সকাল সকাল! এরপর থেকে ছোলা না খেয়ে পকেটজাত করে রাখতাম আমরা। গ্রাউন্ডে বন্ধুদের কারো দৃষ্টি আকর্ষণের দরকার পরলে লুবনা এ্যাডজুটেন্ট বা আপাদের চোখ এড়িয়ে মুখ বরাবর ছোলা ছুঁড়ে মারতো। লুবনার ছিল ঈগলের ক্ষিপ্রতা, মুহূর্তের মাঝে ছুঁড়ে মারার কর্মটি করে দিব্যি সে ভাল মানুষের মুখোশটি পরে ফেলতো। লুবনা পড়াশোনায় চৌকশ, জ্ঞানত সে কোন প্রকার ঝুট ঝামেলাপূর্ণ কাজে জড়ায় না। টিচারদের কাছে তার নিরেট ভাল মানুষের প্রতিমূর্তি। সে নিয়ম করে আমাদের জুতা মাড়িয়ে, ঝুঁটিত্তয়ালা চুল খুলে আর গোসলে গেলে বাথরুমের আলোটি সবার অগোচরে নিভিয়ে দিয়ে আপন মনে পড়তে বসতো। ওর নামাজ পড়ার কায়দাকানুন ছিল অদ্ভুত। আমাদের প্রেয়ার রুম ছিল তিনতলায়। সন্ধ্যায় আমরা যখন বিড়বিড় করে ধীরেসুস্থে জায়নামাজের দোয়া পড়ছি, লুবনা ততোক্ষণে তিন রাকাত ফরজ নামাজ শেষ করেছে একশো মাইল ঝড়ের গতিতে। এদিকে নামাজ শেষ করে দোয়া পড়তে গিয়ে আবেগে চোখে পানি চলে আসতো বলে সে দোয়া আর শেষ হতে চাইতো না।
ও আল্লাহ্ তুমি বাবাকে ভাল রাখো,
মা কে ভাল রাখো,
আপা, নিন্টু আর ভাইয়াকে ভাল রাখো,
আল্লাহ্ তুমি ছাদের টবে বেশী বেলীফুল ফুটিয়ে দাও,
টমির পা ভাল করে দাও- ইত্যকার নানা দোয়া খায়ের করতে করতে প্রেপের হুইসেল বাজার উপক্রম হতো!
বিকেলে গেমস শেষে দেখতাম, ছোট দুটো ড্রামে লবণপানি রাখা আছে, পাশে টিনের দু’খানা গেলাস। ঘামঝরা শরীরে ঠান্ডা লেবু-লবণ পানি খেতে বেশ লাগতো। ডাইনিং হলে টি ব্রেকের স্ন্যাক্স সবার পছন্দ ছিল। আমাদের নিজেদের বেকারীতে পাউরুটি, কেক বানানো হতো। টি ব্রেকে সমুসা, প্যাটিস, নিমকি, ক্রিম রোল, বালুসাই কিংবা চিড়ার পরিজ ইত্যাদি থাকতো চায়ের সাথে। আমার পছন্দ ছিল প্যাটিস। অনেকটা ডোনাটের মত দেখতে বালুসাই খেতে ভালবাসতো অনেকে।
আমাদের বাড়ির সবাই ছিল চা-খোর। দুধের শিশু বোতল ছেড়ে এ বাড়িতে চা পান করতে শেখে। দিনের মাঝে বাবা কতবার যে চা পান করবেন তার কোন হিসেব নেই।
মাথা ব্যাথা? কড়া এক কাপ চা খাও
দাঁত ব্যাথা? লবঙ্গ দিয়ে লাল চা বানাও
গলা ব্যাথা? আদা চা নইলে চলবে কেন?
শীত পরেছে? মালাই চা!
ঘুম পেয়েছে? চা গরম
ঘুম পাচ্ছেনা? চা খাইনি যে বিকেলে!
কলেজে এসে অন্য খাবার ভাল না লাগলেও বিকেলের টি ব্রেকটা আমার পছন্দের ছিল। গেমসের পর আমরা ক্ষুধাকাতর হয়ে পরতাম; মাঝেমধ্যে মনে হতো, প্যাটিস একটার বদলে দুটো কেন দেয়না? আমাদের কান্তি খেতে ভালবাসতো। ও কেমন করে যেন ডাইনিং হলের লিয়াকত ভাই আর সুরাইয়া বুয়ার সাথে ভাব করে নিল। ফলশ্রুতিতে এক টুকরো কেক কি চারটে প্যাটিস কিংবা দুটো বালুসাই নিয়ে সে রুমে চলে আসতো।
এক রাতে ভূমিকম্প হলো। খুব ভ্যাপসা গরম পরেছে তখন। মাথার ওপর একখানা পাখা কতই বা ঠান্ডা বাতাস দেয়, আমরা যে যার মতো কেউ শেমিজ, কেউ ম্যাক্সি আবার কেউবা একেবারে পিটির টি শার্ট আর ট্রাউজার্স পরে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ চারদিকে হৈচৈ আর চিৎকার। শান্তি হাউস নীচতলায়, ওরা চট করে বাইরে চলে গেল। আপারা চেঁচিয়ে সবাইকে নীচে নামতে বলছে। দোতলার সত্য হাউসও ফাঁকা হয়ে এলো প্রায়। আমরা এমনিতেই দূর হাউসের বাসিন্দা, তার ওপর আছে আমাদের ঘুম রোগ। হৈ চৈ করে নামতে গিয়ে কেউ আছাড় খেয়ে পড়লো, কেউ একজন আতংকগ্রস্ত হয়ে রেলিং বেয়ে নামার চেষ্টা করলো। সবাই বেড়িয়ে যাচ্ছি অথচ লুবনা তখনো ঘুমিয়ে আছে দেখে ধাক্কাধাক্কি করে তাকে জাগানোর চেষ্টা করলাম। সে চোখ না খুলেই ঝাড়ি লাগালো একটা, ‘এতো অস্থির হওয়ার কি আছে? ভূমিকম্প থেমে যাবে এখনই, আমি যাবো না’ বলে সে চোখ বুজে থাকলো। লুবনাকে রেখেই হুড়মুড় করে আমরা নেমে এলাম নীচতলায়। সবার চোখে মুখে আতংক স্পষ্ট। করিমউদ্দীন স্যার লুংগী আর স্যান্ডো গেন্জী পরে তাঁর মেয়েদের দেখতে চলে এসেছেন। একে একে ভিপি স্যার, এ্যাডজুটেন্ট স্যার আর হাউস টিউটররাও এলেন। আমরা তখন ভূমিকম্পের ভয়ের চাইতে টি শার্ট আর ট্রাউজার্স পরে ঘুমানোর অপরাধের কথা ভেবে কাঁপাকাঁপি করছি!
আমাদের একটা সবুজ রঙের বাস ছিল। বাসের গায়ে কলেজের লোগোর সাথে বাংলা অক্ষরে এমজিসিসির নামটি লেখা ছিল। করিমউদ্দীন স্যার কি মনে করে বাসের জানালায় সবুজ পর্দা লাগিয়ে দিলেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম টার্মে আমরা দেড়শো ক্যাডেট কলেজে আঠার দিন ছিলাম। এই আঠার দিনে কলেজ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়ে গেলাম। অনেকে ভাবতে শুরু করলো ক্যাডেট কলেজে পড়াশোনার পাটটি হলো গৌণ, এখানে শারিরীক শিক্ষা আর ডিসিপ্লিনটাই হলো আসল। পুরো বাংলাদেশ থেকে ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া মেয়েরা এখানে অনেক আশা নিয়ে এসেছে। ক্যাডেট কলেজের অতি কড়া কায়দাকানুন অনেকের পছন্দ হলো না। আমার প্রিয় বন্ধু ঊর্মি সহ আরো বেশ কয়েকজন ছুটিতে বাড়ি গিয়ে আর ফিরে এলো না।
কলেজ ছুটিতে আমরা যারা ময়মনসিংহের ক্যাডেট ছিলাম তারা চট করে বাড়ি চলে যেতাম। আমাদের বাড়ি যাবার গল্পটি ছিল অনেকটা পাঠ্য বইয়ের নিরস পাতার মতো; সেখানে না ছিল কোন রহস্য রোমান্টিকতা, না ছিল কোন স্বপ্নচর পাখীর উড়াল! ঢাকাবাসী ক্যাডেটরা কলেজের সবুজ বাসে চড়ে বাড়ি যেতো। তাদের যাত্রাপথের গল্পে নানা বর্ণের হাতি ঘোড়ার উপস্থিতি এতোটাই প্রকট ছিল যে আমরা জুলজুল চোখে ওদের গল্প শুনতাম। ওরা গলা ছেড়ে গান গাইতো, গল্প বলতো টানা, চানাচুর খেতো আর রাস্তায় ছেলেদের মুগ্ধ চোখে দেখতো।
লুবনার বাড়ি ছিল ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়াতে। ওরা কলেজ ছুটির আগের রাতে ডিনার খেয়ে ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন থেকে ট্রেনে চেপে বসতো। সেই সময়ে ওদের এই একা একা বাড়ি ফিরবার ব্যাপারটি আমাদের কাছে বিস্ময়কর লাগতো। কী সাহস! কী সাহস! একাই নিজের একখানা ব্যাগ নিয়ে পথে নামতো ওরা। দীর্ঘ ভ্রমণ পথে খাওয়ার জন্য কলেজ থেকে ওদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার সরবরাহ করা হতো। লুবনা অবশ্য একলা বাড়ি ফিরবার মাঝে কোন রোমান্টিকতার খোঁজ পেতো বলে মনেহয় না। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কেবল তার ঘুমটা গাঢ় হতো!
আমাকে নিয়ে যেতে বাবা আসতো কলেজে। সকালে কেউ নাস্তা খেতো না। আমি বাড়ি এলে পরোটা গোস্তের সাথে মুক্তাগাছার মন্ডা খাবো সবাই মিলে। মা সকাল সকাল গোসল সেরে ভেজা চুলে টেবিলে খাবার সাজায়। বোনেরা দোতলার বারান্দায় উৎসুক চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই আমার গল্প শুনবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। অন্যান্য মায়েদের মত আমার মায়ের চোখেও আমি ইথিওপিয়া কি সোমালিয়ার হাড্ডিচর্মসার মানুষ। কলেজের প্রথম দিনগুলোতে আমিও অনেকের মত পিটি, প্যারেড, পড়াশোনা, বাথরুমের লাইন কিংবা ডাইনিং হলের আধা সেদ্ধ সব্জীর সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পরেছিলাম। আঠারো দিন পর মা আমাকে জড়িয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো!
সাবিনা,
তুমি লিখে যাও। মনে হচ্ছে, আমিও তোমার সাথে ৮৩ তে ফিরে গেছি, সবকিছু দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি। সাবলিল তোমার লিখনি।
খায়রুল আলম বেলাল।
🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂
আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা যে খায়রুল আলম বেলাল স্যার আমার ব্লগে মন্তব্য করেছেন! আজ বলতে বাঁধা নেই; আমাদের জীবনের প্রথম সুপার হিরো আপনি ছিলেন, স্যার। ক্যাডেট কলেজে ঈশ্বরের ঠিক পরের আসনটিতে এ্যাডজুটেন্ট থাকেন। আমার অবশ্য মাঝেমধ্যে স্বয়ং বিধাতাপুরুষের চাইতেও পরাক্রমশালী মনে হতো আপনাকে! ছোট মানুষ ছিলামতো; তাই কল্পনায় সবই বিশাল ছিল! কত কলাকৌশল করেই না স্যার আপনি আমাদের শক্তসমর্থ মানুষ হিসেবে বড় করেছেন। জীবনে যতো বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি ততোবারই মনে হয়েছে, এ আর এমন কী; প্রিন্সিপালস্ হাউস ইন্সপেকশন তো নয় যে; বেলাল স্যার এসেই সুইচবোর্ডের নীচে হাত ঘষে দেখবেন কতটা ধূলিকণা জমেছে!
আপনার মন্তব্য পেয়ে সম্মানিত বোধ করছি। আমার সামান্য লেখাটি পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ, স্যার।
ওয়াও!!!
মারহাবা, মারহাবা...
চমতকার এগুচ্ছে।
এই দুর্দান্ত গল্প এতদিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল???
:boss: :boss: :boss: :boss: :boss:
Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.
🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂
কলেজের গল্পের ঝুলিটি এবার নিয়ে বসেছি, ভাইয়া। দেখি কত দূর যেতে পারি। পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
অপূর্ব ...চোখের সামনে সব স্পষ্ট দেখতে পারছি..কে বলে এত গুলো বছর পার হয়ে গেছে? মনে হচ্ছে এ যেন গতকালের ঘটনা...এতটুকু মলিন হয়নি...কোনদিন মলিন হবে না ...
🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂 🙂
নাহিদ, তোমার মন্তব্য আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করবে খুব। আমাদের সবার স্মৃতিচারণে একটি সময়ের ছবি আঁকা হবে ধূলিকণার ক্যানভাসে! আমাদের সাথেই থেকো।
অপূর্ব।
খুব প্রাণবন্ত লেখা।
পড়ে মনে হলো, আমাদের সবার ক্যাডেট জীবনটা তো এরকমই চমৎকার ছিল। চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম সব।
গার্লস এক্সক্যাডেটদের কি কি গল্পের উপন্যাসের বই আছে বাজারে?
🙂 🙂 🙂 🙂
পড়বার জন্য অনেক ধন্যবাদ, ফেরদৌস। ফেনী আর জয়পুরহাটের এক্স ক্যাডেটদের কথা বলতে পারিনা, তবে এমজিসিসির অনেকেই লেখালেখি করছেন জানি। ইতোমধ্যে অনেকের বই বেরিয়েছে। আমাদের ব্লগেও এমজিসিসির লেখা আছে অনেক।
ক্যাডেট কলেজের জীবন নিয়ে অনেকে লিখেছে এবং এখনও লিখছে। যখনই এমন কোন লেখা চোখে পড়ে, সাথে সাথে পড়ে ফেলি। আমি নিজেও এসব স্মৃতিচারণ নিয়ে একটা সিরিজ লিখেছিলাম। লিখে বুঝেছি, এসব চর্বিত চর্বণের এখনো অনেক পাঠক রয়েছে, আগামীতেও থাকবে। তবে কোন গার্লস ক্যাডেট কলেজ নিয়ে লেখা কোন স্মৃতিচারণ এই প্রথম পড়ছি। আমি নিশ্চিত, আমার মত আরো অনেকেই তা এই প্রথম পড়ছে। এবং লেখার গুণের সাথে একই রকমের একটা অন্য জগত সম্পর্কে পাঠকের স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসার কারণে এ লেখা অনেক জনপ্রিয় হবে।
কলেজে আসার চব্বিশ ঘন্টারও কম সময়ে সুনিপুণ কাঁধ ঝাঁকুনির এক ‘সো হোয়াট’ আমাদের অকস্মাৎ অন্য মানুষ বানিয়ে দিয়ে গেল! -- আবারও আব্দুল্লাহ আল আমিন স্যারের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি হাউজ মাস্টার হিসেবে তাঁর হাউজের ক্যাডেটদেরকে ছুটিতে যাবার আগে বলতেন, তারা যেন বাড়ী গিয়ে গুরুজনদের সাথে ‘সো হোয়াট’ কথাটা না বলে।
ক্যাডেটরা কলেজে গিয়ে সপ্তম শ্রেণীতেই প্রথম যে কথাটা সাধারণতঃ gesture করে বলতে শিখে এবং সেভাবে বলে নিজের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাসের সন্ধান করে, তা হচ্ছে ‘সো হোয়াট’। আর ওই ক্যাডেটরাই ছয় বছর পরে যখন কোন মিলিটারী একাডেমীতে যোগদান করে, তখন তাদের বুলিতে আরেকটা শব্দ যোগ হয়ে তা হয়ে যায় ‘সো ব্লাডি হোয়াট’? 🙂
🙂 🙂 🙂 🙂
আপনি বড় ভালবাসেন ভাইয়া, তাই বোধকরি আমাদের চেনা গল্পগুলোও পড়তে ভাল লাগছে। ছেলেদের চাইতে আমাদের গল্প একটু আলাদা জানি, কিন্তু গল্পের মূল সুর একই রয়ে গেছে। চিরনতুন এই গল্পের পাঠকের অভাব হবে না কখনোই।
আপনার পর্যালোচনা আমাকে বরাবর সম্মানিত করে।
গল্পে গল্পে যুগ পার, এ তো কিচ্ছু নয় - ২৫ / ৫০ / ১০০ বছর পরেও কলেজের স্মৃতি বুঝি একই ঔজ্জ্বল্যে দীপ্যমান থাকবে।
🙂 🙂 🙂 🙂
ঘুরেফিরে সেই একই গল্প, একই চর্বিতচর্বণ তবুত্ত চিরনতুন যেন!
আপনার মন্তব্য আমাকে সম্মানিত করে, ভাইয়া। অনেক ধন্যবাদ পড়বার জন্য।
করিমউদ্দীন স্যার কি মনে করে বাসের জানালায় সবুজ পর্দা লাগিয়ে দিলেন।??? পর্দাপ্রথা নাকি? 😛
মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য